রাজনৈতিক সাম্প্রদায়িক ও ভৌগোলিক বিভাজনের পর ভারতীয় উপমহাদেশে নতুন উৎপাত---স্বাধীনতার বিভাজন৷ ভাগবতের প্রথম কথাটির মধ্যে কিছু সারবত্তা আছে৷ ১৯৪৭ সালে ভারতবাসী রাজনৈতিক স্বাধীনতাই পেয়েছে৷ কিন্তু সামাজিক অর্থনৈতিক দিকে নতুন করে শোষণ ও অবদমনের শিকার হয়েছে৷ এই শোষণ ও অবদমনের খলনায়করাই ভাগবতদের আর্থিক গুরু৷ তাই ভুলেও কোনদিন ভাগবতরা জনগণের আর্থিক মুক্তির কথা বলেননি৷ তবে ১৯৪৭ সালের রাজনৈতিক স্বাধীনতাকে তিনি অস্বীকার করেননি৷ অত্যন্ত সচেতন ভাবে ভাগবত রাজনৈতিক স্বাধীনতার কথা স্বীকার করেছেন৷ এই রাজনৈতিক স্বাধীনতার জোরেই ভাগবত সাম্প্রদায়িক স্বাধীনতার কথা ঘোষণা করেছেন৷
এই রাজনৈতিক স্বাধীনতাই ১৯৪৭ পরবর্তী শোষণ ও অবদমনের প্রধান হাতিয়ার৷ দেশ ভেঙে যে স্বাধীনতা অর্জিত হয়,৭৭ বছর ধরে সেই স্বাধীনতা জনগণকে শুধু দল ভাঙ্গা ও দল গড়ার অধিকার দিয়েছে৷ ১৯৪২ সালে প্রথম লোকসভা নির্বাচনে ১৪টি জাতীয় দল ও ৩৯টি আঞ্চলিক বা অন্যান্য দল অংশগ্রহণ করেছিল৷ ২০২৪ সালে নির্বাচন কমিশনে নথিভুক্ত স্বীকৃত জাতীয় দলের সংখ্য ৬টি, নথিভুক্ত ও স্বীকৃত আঞ্চলিক দলের সংখ্যা ৫৮টি ও নথিভুক্ত কিন্তু স্বীকৃত নয়, এমন দলের সংখ্যা ২৭৬৩টি৷ ৭৭ বছর ধরে রাজনৈতিক স্বাধীনতার বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে পাল্লা দিয়ে রাজনৈতিক দলের সংখ্যা বেড়েছে, জনগণের ওপর শোষণ, অবদমন ও নিপীড়ণ বেড়েছে৷ জনগণ খণ্ডিত দেশের ছোট ছোট রাজনৈতিক ও সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীবদ্ধ জীবে পরিণত হয়েছে৷ নিজের ভালোমন্দ বোধটাও অনেকের নেই, সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক চেতনা আজও দেশের সিংহভাগ জনগণের নেই৷ জনগণের এই অচেতনাকে মূলধন করে জীবিকা নির্বাহ করছে ধনকুবেরের দল ও তাদের পোষ্য রাজনৈতিক ও সাম্প্রদায়িক দাদারা৷ ৭৭ বছরে জনগণের আর্থিক মুক্তির কথা কোন নেতার মুখ থেকে একবারও উচ্চারিত হয়নি৷
অখণ্ড ভারতে প্রথম পূর্ণ স্বাধীনতার দাবী করেছিলেন নেতাজী সুভাষচন্দ্র বোস৷ তবে শুধু ব্রিটিশ তাড়িয়ে ক্ষমতা দখলের স্বাধীনতার স্বপ্ণ তিনি দেখেননি, জনগণের আর্থিক মুক্তির স্বপ্ণও তিনি দেখেছিলেন৷ ১৯৩৮ সালে প্রথমবার জাতীয় কংগ্রেসের সভাপতি নির্বাচিত হওয়ার পর সুভাষচন্দ্র লণ্ডনে ভারতীয় ছাত্রদের সামনে এক সভায় বলেছিলেন দেশীয় পুঁজিপতিরা ভারতে ব্রিটিশ শাসককে শক্তি জোগাচ্ছে৷ আমাদের এদের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে, শুধু রাজনৈতিক স্বাধীনতা নয়, জনগণকে অর্থনৈতিক স্বাধীনতাও দিতে হবে৷
পরবর্তী ইতিহাস কারও অজানা নয়৷ ভারতে রাজনীতির রাশ যে দেশীয় পুঁজিপতিদের হাতে সেদিনই স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল৷ সুভাষচন্দ্র দেশ ছেড়ে গিয়ে আজাদ-হিন্দ বাহিনী নিয়ে বাইরে থেকে ব্রিটিশকে আক্রমণ করে দেশকে মুক্ত করতে চেয়েছিলেন, কিন্তু ব্যর্থ হন৷ আর দেশে ফিরে আসতে পারেননি৷ তাঁর দেশে ফিরে না আসার কারণ যাইহোক সে বিতর্কের মীমাংসা আজও হয়নে৷ তাঁর স্বপ্ণের স্বাধীনতা আজও অধরা৷ কোন একজন রাজনৈতিক নেতাও আজ পর্যন্ত অর্থনৈতিক স্বাধীনতার কথা মুখে উচ্চারন করেননি৷
৭৭বছর ধরে দেশীয় পুঁজিপতিরা শোষণের জাল বিছিয়ে অশ্লীল চলচ্চিত্র নাচ-গানের মাধ্যমে ছাত্র-যুব সমাজের মধ্যে বিকৃত ভাবনার বিকৃত মানসিকতার বিষ ঢুকিয়ে দিয়েছে৷ তাই না পেটে ভাত না জুটলেও, নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্যসামগ্রীর অগ্ণিমূল্য নিয়ে চিন্তা না করে, মন্দির নিয়ে উল্লাস করে৷ হাতরাস, উন্নাও, আরজিকর...এই বিকৃত মানসিকতার বিকৃত ভাবনার পরিণতি৷ অপরাধীর চরম শাস্তির দাবী সেও বিকৃত মানসিকতারই ভাবনা৷ অপরাধীর শাস্তি সবাই চাইবে এটা স্বাভাবিক৷ কিন্তু তাতে কি সামাজিক সুচিতা ফিরে আসবে৷ সামাজিক সুচিতা ফিরিয়ে আনার ভাবনা কোন প্রতিবাদীর মুখেও শোনা যায় না৷
সুভাষচন্দ্রের স্বপ্ণের স্বাধীনতা আজও অধরা৷ বিকৃত ভাবনার বিষে জর্জরিত রাজনীতি, ধর্মনীতি, অর্থনীতি শিল্প সাহিত্য সংস্কৃতি৷ তারই বিষময় ফল, দুর্নীতি বিশৃঙ্খলা অরাজকতা, রাজনৈতিক খুনোখুনি, সাম্প্রদায়িক হানাহানি৷ এই বিপর্যস্ত বিষাক্ত পরিবেশ থেকে মুক্তির চিন্তা নেই, কিন্তু মন্দির প্রতিষ্ঠায় স্বাধীনতার বিকৃত ভাবনা আছে৷
মুক্তির পথ অবশ্যই আছে৷ আনন্দমার্গ দর্শনের প্রবক্তা তাঁর আধ্যাত্মিক ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত নব্যমানবতাবাদ নির্ভর সামাজিক অর্থনৈতিক তত্ত্ব প্রাউটে সুষ্পষ্ট সুনির্দিষ্ট রূপরেখা তৈরী করে দিয়েছেন৷ এই পথেই, একমাত্র এই পথেই মানুষ অর্থনৈতিক স্বাধীনতা অর্জন করবে ও তার বুদ্ধির মুক্তি ঘটবে৷
- Log in to post comments