আমরা যোগ সাধনা করব কেন

লেখক
পত্রিকা প্রিতিনিধি

একটি ফুলের কুঁড়ি থেকে সুন্দর একটি ফুল ফুটে ওঠে৷ ফুলের সৌন্দর্য নির্ভর করে তার সমস্ত পাপড়ি গুলির সম্পর্কে বিকাশের ওপর মনে করা যাক, একটি ফুলের তিনটি এই তিনটি পাঁপড়ি যদি ঠিকমত ফুটে ওঠে, তবে ফুলটিকে সুন্দর দেখায়, তেমনি আমাদের জীবনপুষ্পের তিনটি পাঁপড়ি–দেহ, মন ও আত্মা৷ এই তিনেব যদি সুষ্ঠু বিকাশ না হয়, তাহলে জীবনের সুষ্ঠু বিকাশ বা চলে না বা তাকে জীবনের প্রকৃত উন্নতি বলা চলে না৷ আর তাই জীবনের যথার্থ উন্নতির জন্যে তার জীবনকে যথার্থ আনন্দময় করে গড়ে তুলতে হলে দৈহিক, মানসিক ও আত্মিক–তিনেরই উন্নতি একান্ত প্রয়োজন৷ জীবনের এই ত্রিস্তরীয় উন্নতি সম্পর্কে–আমাদের যথার্থভাবে চেতন হতে তহবে৷ সেজন্যেই আনন্দমার্গের প্রবক্তা শ্রীশ্রীআনন্দমূর্ত্তিজী বলেছেন, ‘‘We should be physically fit, mentally strong and spritually elevated’’–আমাদের দৈহিক সুস্থতা অর্জন করতে হবে, মানসিক শক্তি অর্জন করতে হবে ও আধ্যাত্মক উন্নতি ঘটাতে হবে৷ যোগসাধনা মানুষের এই ত্রিস্তরীয় উন্নতি ঘটায়৷ প্রকৃতপক্ষে এটা যোগের বৈশিষ্ট্য৷

দৈহিক সুস্থতা মানে বিভিন্ন রোগ থেকে দেহকে মুক্ত রাখা৷ বলা হয়–‘‘Prevention is the better than cure’’ অর্থাৎ রোগ হওয়ার পর চিকিৎসা করার চেয়ে রোগের প্রতিরোধের ব্যবস্থা গ্রহণই শ্রেয়৷ বিভিন্ন রোগ শরীরে বাসা বাঁধলে আমরা চিকিৎসকের কাছে যাই–দামী দামী ওষুধ খাই, বিজ্ঞানীরা বলেন, এই সব ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াতেও আবার নোতুন নোতুন রোগের সৃষ্টি হয়৷ কিন্তু নিয়মিত যোগ সাধনা করলে অধিকাংশ ক্ষেত্রে আমরা বিভিন্ন রোগ থেকে দূরে থাকতে পারি৷

জৈব মনোবিজ্ঞান ও দৈহিক সুস্থতা (Biopsychology)

আমাদের শরীরে বিভিন্ন অন্তঃক্ষরা গ্রন্থি আছে৷ এই অন্তক্ষরা গ্রন্থিগুলি হ’ল পিনিয়ালে পিটুইটারী, থাইরয়েড, থাইমাম, এ্যাড্রিন্যাল, গোনাড্স (ওভারিজ ও টিষতকস) প্রভৃতি৷ এগুলি থেকে রসক্ষরণের (normal secretion) ওপর শরীরের সুস্থতা ও অসুস্থতা নির্ভর করে৷ যোগাসনের দ্বারা এই রসক্ষরণকে স্বাভাবিক করা যায়–যা শরীরকে সুস্থ রাখে বা সুস্থ করে তোলে৷ বিভিন্ন আসন ও মুদ্রার অভ্যাসের দ্বারা এই সব অন্তঃক্ষরা গ্রন্থি সহ অন্যান্য গ্রন্থি নায়ু, স্নায়ুকোষ, স্নায়ু, পেশী ও শরীরের বিভিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গ সুস্থ ও সবল করা হয়৷

তাই যোগাসন ও মুদ্রার সহায়তায় অজীর্ণ, অম্লরোগ, আমাশয়, কোষ্ঠকাঠিন্য, রক্তচাপ প্রভৃতি বিভিন্ন রোগ–যা সচরাচর আমাদের হয়ে থাকে–তাদের থেকে সহজে নিরাময় লাভ করতে পারি৷

মানসিক উন্নতি

শুধু শারীরিক সুস্থতা নয়, যোগের দ্বারা মানসিক দুর্বলতাও দূর করা, মনকে নিয়ন্ত্রণ করা, মনঃশক্তি অর্জন করা প্রভৃতিও সম্ভব৷

আমরা ভাল–মন্দ যা কিছু কাজ করি, প্রকৃতপক্ষে মনই এই সমস্ত কাজ করে৷ মন যদি ভাল হয়–শুভবুদ্ধিম্পন্ন হয়, তাহলে সম্ত কাজও ভাল হবে, আর মন যদি মন্দ হয়, অর্থাৎ অশুভবুদ্ধিম্পন্ন হয় তাহলে কাজও মন্দ হবে৷ মন মতিক, সুষুম্নাকাণ্ড, বিভিন্ন গ্রন্থি, স্নায়ুকোষ, সংজ্ঞানাড়ী, আজ্ঞা নাড়ী তথা শরীরের বিভিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গের মাধ্যমে সমস্ত কাজ করে৷

মনের আবার বিভিন্ন বৃত্তি রয়েছে৷ এগুলির সংখ্যা প্রধানত ৫০৷ এগুলি মস্তিষ্কে ও সুষুম্নাকাণ্ডে অবস্থিত বিভিন্ন চক্রে (plxus)  অবস্থিত বিভিন্ন গ্রন্থিগুলির দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়৷ যেমন, লজ্জা, ঘৃণা, ভয়, লোভ, ক্রোধ, আশা, চিন্তা, চেষ্টা, বুদ্ধি, বোধি প্রভৃতি সাধারণত মানুষের মধ্যে হীন বৃত্তিগুলি প্রবল ও উন্নত বৃত্তি অস্ফূট থাকে৷

যোগের যম–নিয়ম, আসন, প্রাণায়াম, ধ্যান প্রভৃতি প্রক্রিয়ার অনুশীলনের সাহায্যে বৃত্তি গুলিকে নিয়ন্ত্রণ করা যায়৷ বৃত্তিগুলিকে যতই আমরা নিয়ন্ত্রণ করবো ততই মনের একাগ্রতা বৃদ্ধি পাবে৷ মনের একাগ্রতা যতই বৃদ্ধি পাবে, ততই মনের শক্তিও বৃদ্ধি পাবে৷

বিক্ষিপ্ত সূর্য রশ্মিকে আতস (অতসী) কাঁচের সাহায্যে কেন্দ্রীভূত করলে যেমন আগুন জ্বলে ওঠে, তেমনি যোগের সাহায্যে মনকে একাগ্র করলে মনের মধ্যে অপরিসীম শক্তির জাগরণ ঘটে৷ এই শক্তিকে শুভপথে লাগালে আমরা জীবনে অনেক বড় কাজ করতে পারি ও সহজেই অভীষ্ট সিদ্ধ করতে পারি৷

যারা পড়াশুনা করে তারা নিয়মিত যোগ অভ্যাস করলে বুদ্ধি তীক্ষ্ণ হবে ও স্মৃতিশক্তিও বৃদ্ধি পাবে৷

বিশেষ করে জীবন ধারা প্রতি মূহুর্ত্তে আমরা মানসিক চাপের (mental stress) শিকার হই৷ মানসিক চাপ বৃদ্ধি পেলে সব সময় মানসিক অশান্তি খিটখিটে মেজাজ, মাথাধরা, প্রভৃতি দেখা দেয়৷ ক্রমাগত এই মানকি চাপ থেকে গ্যাসট্রিক ডিসর্ডার, টিবি, হূদ্রোগ প্রভৃতি রোগেরও সৃষ্টি হয়৷ শুধু এই রোগগুলিই নয়, আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞানীদের মতে অধিকাংশ রোগেরই উৎস এই মানসিক চাপ৷ এই মানসিক চাপ থেকে সাময়িক ভাবে রেহাই পেতে মানুষ সাধারণতঃ ধূমপান, মদ্যপান, মাদক দ্রব্য সেবন প্রভৃতি মারাত্মক নেশার দিকে ঝোঁকে৷ আর এর ফলে মানুষ ক্যানসার প্রভৃতি জটিল ও দূরোরোগ্য ব্যধির কবলে পরে৷

এই মানসিক চাপ থেকে মুক্তির একমাত্র উপায় হ’ল নিয়মিত যোগ অভ্যাস৷ বিশ্বের খ্যাতনামা চিকিৎাবিদরাও এই মত পোষণ করেন৷

মনের বিস্তার

আমরা মনের যে অংশ নিয়ে প্রাত্যহীক কাজকারবার করি তা কিন্তু আমাদের মনের অতি ক্ষুদ্র অংশ৷ আমাদের মনের অতি বহৎ অংশ যেখানে রয়েছে বিপুল সংখ্যক ঐশ্বয্য–তা সাধারণতঃ অজ্ঞাতই থেকে যায়৷

এই মনের বিভিন্ন স্তর রয়েছে৷ এগুলিকে বলা হয় কোষ৷ মনের এই কোষগুলি হ’ল–কামময় কোষ, মনোময় কোষ, অতিমানস কোষ, বিজ্ঞানময় কোষ ও হীরন্ময় কোষ৷ কামময় কোষ হ’ল মনের স্থূল অংশ যাতে রয়েছে মনের বিভিন্ন স্থূল কামনা–বাসনা৷ তাই এই মনকে স্থূল মন বলা হয়৷ এই মন ইন্দ্র সমূহের মাধ্যমে বহির্জগতের সঙ্গে সম্পর্কিত৷ এরপর মনের যে সূক্ষ্মতর স্তর আছে–তা হ’ল মনোময় কোষ৷ এই মনকে সূক্ষ্মমনও বলা হয়৷ গভীরভাবে চিন্তন, মনন, গবেষণা প্রভৃতি মনের এই স্তরে করা হয়৷ অর্থাৎ যাঁরা জ্ঞানী, কবি, লেখক, বিজ্ঞানী তাঁদের এই মনোময় কোষ জাগ্রত৷ এরপর রয়েছে অতিমানস, তারপর বিজ্ঞানময় ও তারপর মনের সূক্ষ্মতম কোষ–হিরন্ময় কোষ৷ অতিমানস কোষে আধ্যাত্মিক চিন্তাভাবনারড় স্ফূরণ হয়৷ বিজ্ঞানময় কোষ জাগলে বিবেক সদাজাগ্রত হয়৷ তখন মানুষ সবসময় শুভ চিন্তা নিয়ে থাকে ও গভীর আধ্যাত্মিক অনুরাগ জাগে৷ হিরন্ময় কোষ জাগ্রত হলে মানুষ আধ্যাত্মিক স্তরের পরমানন্দে ডুবে থাকতে পারে৷

এরপরে উঠলে মন আত্মাতে সমাহিত হয়৷ তখন তাঁর পূর্ণ আত্মোপলব্ধি হয়৷ মন আত্মাতে সমাহিত হলে জীবাত্মার সঙ্গে পরমাত্মার মিলন ঘটে৷ ‘সংযোগো যোগ ইত্যুক্তো জীবাত্মা–পরমাত্মা নঃ’–অর্থাৎ জীবাত্মারড় সঙ্গে পরমাত্মার এই সংযোগই জীবের মূল কথা৷

সুস্থ শরীর ও সুস্থ শরীর ও শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মন ব্যতীত আত্মোপলব্ধি হয় না৷ আর তাই যম–নিয়ম, আসন, প্রাণায়াম, ধ্যান–এসবই যোগের অঙ্গ৷

মনের বিস্তার নিয়ে বৈজ্ঞানিক গবেষণা

অন্যান্য শক্তিতরঙ্গের মত মনও তরঙ্গাকারে প্রবাহিত হয়৷ মনের যতই বিস্তার ঘটে এ তর দৈর্ঘ ততই বৃদ্ধি পায়৷ অপরপক্ষে মনের সংকোচন যত তবেশী হয়, ততই এ তরঙ্গ দৈর্ঘ হ্রাস পায়৷ স্পন্দনাঙ্ক বলতে বোঝায় সেকেণ্ডে কতগুলি তরঙ্গ উত্থিত হয়৷ বৈজ্ঞানিক গবেষণাগারে মনের এই স্পন্দনাঙ্ক সম্পর্কিত তথ্য পাওয়া যায় ইলেকট্রো–এনসেফালোগ্র্ (E.E.G) সাহায্যে৷ মনের এই তরঙ্গকে চার ভাগে ভাগ করা হয়৷–(১) বিটা তরঙ্গ, (২) আলফা তরঙ্গ, (৩) থিটা তরঙ্গ, (৪) ডেটা তরঙ্গ৷

(১) বিটা তরঙ্গ ঃ সাধারণতঃ মনের স্পন্দনাঙ্ক যখন হয় সেকেণ্ডে ১৩ বা তার চেয়ে বেশী সে অবস্থায় মনের চঞ্চলতা বেশী থাকে, মনে থাকে অশান্ত৷ মানসিক শক্তিও বেশী থাকে না৷

(২) আলফা তরঙ্গ ঃ এ অবস্থায় মনের তরঙ্গ দৈর্ঘ বৃদ্ধি পায় ও স্পন্দনাঙ্ক হ্রাস পেয়ে হয় সেকেণ্ডে ৮ থেকে ১২৷ এ অবস্থায় মনের স্থূলতা মনের শক্তিও বৃদ্ধি পায়৷

(৩) থিটা তরঙ্গ ঃ ধ্যানের দ্বারা মন যখন আরও স্থির ও শান্ত হয় তখন মনের তরঙ্গ দৈর্ঘের অধিকতর বিস্তার ঘটে৷ অপরপক্ষে মনের স্পন্দনাঙ্ক হ্রাস পেয়ে সেকেণ্ডে প্রায় ৪ থেকে ৭–এ পৌঁছয়৷ স্বাভাবিকভাবে মনের শক্তিও তখন বৃদ্ধি পায়৷

(৪) ডেটা তরঙ্গ ঃ ধ্যানের গভীরতায় মন আরও বিস্তার লাভ করে৷ মনের স্পন্দনাঙ্ক হ্রাস পেয়ে হয় সেকেণ্ডে ১ থেকে ৩৷ এ অবস্থায় মনে কোনও চঞ্চলতা থাকে না৷ মনে গভীর প্রশান্তি পরিলক্ষিত হয়৷

বলা বাহুল্য, কেবলমাত্র ধ্যানের সাহায্যেই এইভাবে মনের বিটা তরঙ্গকে ডেল্টা তরঙ্গে রূপান্তরিত করে আনন্দময় অবস্থায় পৌঁছানো যায়৷

যোগের মাধ্যমে সমাজের শুদ্ধি

বর্তমানে মানুষের মনে চরম অস্থিরতা ও নীতিবোধের অভাবের প্রতিফলন সমগ্র সমাজে দেখা দিচ্ছে৷ তাই সমাজে আজ প্রায় সর্বত্রই দুর্নীতি, অশান্তি ও নানান ধরণের ঘৃণ্য অপরাধ সংঘটিত হচ্ছে৷ প্রায় গোটা সমাজটাই আজ দূষিত হয়ে উঠেছে৷ আজকে এই সমাজের শুদ্ধি কেবল আইন ও প্রশাসনিক কঠোরতার দ্বারা সম্ভব না, তার সঙ্গে দরকার ব্যাপক নৈতিক ও সর্বসঙ্কীর্ণতামুক্ত আধ্যাত্মিক শিক্ষা৷ তাই চাই যোগের ব্যাপক চর্চা৷

এখানে বা বাহুল্য যোগের সঙ্গে জাত–পাত সম্প্রদায়ের কোনও সম্পর্ক নেই৷ যোগের আদর্শবলে, মানব সমাজ এক ও অবিভাজ্য৷ ‘মানুষ মানুষ ভাই ভাই, উঁচু কিংবা নীচু নাই৷’ তাই সমস্ত সঙ্কীর্ণতার ঊর্ধ্বে উঠে সর্বত্র ব্যাপক যোগচর্চা এক সর্বাঙ্গসুন্দর মানব সমাজ গড়ে তুলতে সক্ষম৷