আনন্দমার্গ আদর্শের বাস্তবায়নই হোক মহাপ্রয়ান দিবসের শপথ

লেখক
আচার্য মন্ত্রসিদ্ধানন্দ অবধূত

মানুষ সাধারণতঃ চলে আত্মসুখকেন্দ্রিক দর্শন বা জীবন সম্পর্কিত দৃষ্টিভঙ্গী, জড়কেন্দ্রিক দর্শন বা দৃষ্টিভঙ্গী কিংবা ভাবজড়তা কেন্দ্রিক দর্শন বা দৃষ্টিভঙ্গী নিয়ে৷ আত্মসুখকেন্দ্রিক দর্শনের অনুগামী বলতে বোঝায় যারা নিজের সুখ, নিজের স্বার্থ ছাড়া আর কিছু বুঝতে চায় না৷ তারা যা করে, নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির জন্যে নিজেদের সুখের জন্যে করে৷ তারা বলে ‘আপনি বাঁচলে বাপের নাম’৷ তাদের সমস্ত কার্যকলাপের পেছনে আছে এই আত্মসুখের বাসনা৷ পুঁজিবাদী দর্শন এই পর্যায়ে পড়ে৷

জড়কেন্দ্রিক দর্শন হল যারা জড়পদার্থের বাইরে কিছু বোঝে না বুঝতে চায় না৷ এরা বলে জড় বস্তু থেকে সবকিছু এসেছে, আর জড়বস্তুই অন্তিম পরিণতি৷ তারা ভৌতিক (বস্তুগত) চাহিদা ছাড়া অন্য চাহিদার কোনো মূল্য দিতে চায় না৷ মাকর্সবাদ এর উদাহরণ৷

ডগমাকেন্দ্রিক বা ভাবজড়তা কেন্দ্রিক দর্শন অযৌক্তিক কুসংস্কার ও ত্রুটিপূর্ণ ভাবাবেগের ওপর প্রতিষ্ঠিত৷ বিভিন্ন সম্প্রদায় ভিত্তিক ধর্মমতের গোঁড়ামি এসেছে এই ডগ্‌মাকেন্দ্রিক দর্শন থেকে৷

বিজ্ঞানভিত্তিক অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে শিক্ষিত মানুষেরা ধীরে ধীরে ভাবজড়তা কেন্দ্রিক দর্শন বা দৃষ্টিভঙ্গীর বন্ধন ছিঁড়ে বেরিয়ে আসছে৷ যদিও তারা সাধারণতঃ এখন জীবনের প্রকৃত লক্ষ্য ও কর্তব্য ব্যাপারে অন্ধকারে হাতড়াচ্ছে৷

আত্মসুখতত্ত্ব আধারিত পুঁজিবাদী সমাজ ব্যবস্থাই আজ প্রায় সর্বত্র চলছে৷ জড়বাদী দর্শনের অনুগামীরা শেষ পর্যন্ত এদের কাছে পরাভূত হয়ে কোনঠাসা হয়ে পড়েছে৷ বলা চলে, মাকর্সবাদের অপমৃত্যু ঘটেছে৷ বিশেষ করে রাশিয়া অর্ধেক ইয়ূরোপে কম্যুনিষ্ট  সরকার কায়েম হলেও জনসাধারণের মোহভঙ্গ হবার সঙ্গে সঙ্গে সবাই প্রায় এক সঙ্গেই কম্যুনিজমকে ডাষ্টবিনে নিক্ষেপ করেছে৷ বুঝতে পেরেছে, সাম্যবাদের নাম নিয়ে এ হল চরম অত্যাচারী ডিক্টেটরী শাসন৷

চীনেও চলছে স্বৈরতন্ত্রী সরকার৷ আমেরিকা ও ইউরোপের বহুজাতিক সংস্থার বিনিয়োগই চীনা অর্থনীতির প্রধান স্তম্ভ৷ চীন কম্যুনিজমের অর্থনীতিকে বিসর্জন দিয়ে  পুঁজিবাদী অর্থনীতিকেই আঁকড়ে ধরেছে৷ অন্যদিকে ডগমাকেন্দ্রিক দর্শনগুলিও মানুষের অজ্ঞতার সুযোগে মানুষের ওপর শোষণের হাতিয়ার হয়ে উঠেছে৷

বিংশ শতাব্দীতে নগ্ণভাবে প্রকটিত হ’ল ডগ্‌মাকেন্দ্রিক দর্শনগুলোর সঙ্গে সঙ্গে পুঁজিবাদ ও জড়বাদ কেন্দ্রিক দর্শনগুলিরও অন্তসারশূন্যতা৷ মানবতাবাদী মানুষ যুক্তিবাদী মানুষ এই তিন প্রকার শোষণ থেকেই মুক্তির জন্যে কাতরভাবে প্রতীক্ষা করছিল৷

শূন্যতা বেশি সময় থাকে না৷ তাই জগতের বুকে আদর্শগত এই শূন্যতা পূর্ণ করতেই শ্রীশ্রীআনন্দমূর্ত্তিজী আবির্ভাব৷ তিনি এমনি এক সর্বানুস্যুত দর্শন মানুষকে উপহার দিলেন, যাতে রয়েছে মানুষের আধ্যাত্মিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক  ও সাংস্কৃতিক সমস্ত সমস্যারই সুষ্ঠু সমাধান৷ এই নূতন সর্বানুসূ্যত দর্শন নিয়ে এক সর্বপ্রকার শোষণমুক্ত সর্র্বঙ্গ সমাজ গড়ার মিশন নিয়েই তাঁর আবির্র্ভব৷

১৯২১ সালের আনন্দপূর্ণিমা তিথিতে তাঁর আবির্ভাব৷ ১৯৩৯ সাল অর্র্থৎ যখন তাঁর বয়স ১৮ বছর---তখনই নোতুন মিশন নিয়ে ‘নোতুন পৃথিবী’ গড়ার স্বপ্ণ নিয়ে তাঁর যাত্রা শুরু হয়৷ কারণ এই বছর তিনি একজন সমাজের উন্মার্গগামী ডাকাত কালীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়কে দীক্ষা দিয়ে তাঁকে সেবাব্রতী সর্বত্যাগী সাধক বানিয়ে তাঁর যাত্রা শুরু করেন৷ তারপর ১৯৫৫ সালে তিনি সংঘ প্রতিষ্ঠা করলেন৷ এর পর একে একে তিনি তাঁর আধ্যাত্মিক দর্শন, সামাজিক ও অর্থনৈতিক দর্শন ‘প্রাউট’ দিলেন , তারপর সর্বত্যাগী সন্ন্যাসী মিশনারী গড়ে তুলতে শুরু করলেন৷ তিনি মার্গের ‘শিক্ষা, ত্রাণ, জনকল্যাণ বিভাগ খুললেন, দেশে দেশে তাঁর সর্র্বনুস্যুত আদর্শকে ছড়িয়ে দেবার জন্যে বহির্ভারতে প্রচারক পাঠানো শুরু করলেন৷ এমনিভাবে সারা পৃথিবী জুড়ে তিনি তাঁর কর্মযজ্ঞের বিস্তার ঘটালেন৷ তিনি অভিনব, ভাব, ভাগ, সুর ও ছন্দের সমন্বয়ে সঙ্গীতেরও নোতুন ঘরানা সৃষ্টি করলেন, ৫০১৮টি ‘প্রভাত সঙ্গীত রচনা করে তাতে নিজেই সুরারোপণ করলেন ও সারা পৃথিবীতে তা ছড়িয়ে দেওয়ার জন্যে ‘রাওয়া’ সংস্থা গড়ে তুললেন৷ অবশেষে ১৯৯০ সালের ২১ শে অক্টোবর তাঁর অজস্র ভক্ত-অনুগামীর ওপর তাঁর আদর্শের বাস্তবায়নের দায়িত্ব দিয়ে তিনি তাঁর পাঞ্চভৌতিক দেহ ত্যাগ করলেন৷

আজ তাঁর পাঞ্চভৌতিক দেহ আমাদের সামনে না থাকলেও তিনি তো প্রকৃতপক্ষে চৈতন্যময় তারকব্রহ্ম৷ তিনি ছিলেন, আছেন ও থাকবেনও চিরকাল৷ চাই উপলব্ধি ভক্তি চাই আদর্শ নিষ্ঠা৷

তাঁর মহান্‌ আদর্শকে আমরা আমাদের জীবনে ও বিশ্বভুবনে প্রতিষ্ঠা করবই৷ এটাই আমাদের দৃঢ় সংকল্প৷ তাঁর কাছে আমাদের একান্ত প্রার্থনা, তাঁর আদর্শকে বাস্তবায়িত করতে তিনি আমাদের শক্তি দিন৷