মানুষ সাধারণতঃ চলে আত্মসুখকেন্দ্রিক দর্শন বা জীবন সম্পর্কিত দৃষ্টিভঙ্গী, জড়কেন্দ্রিক দর্শন বা দৃষ্টিভঙ্গী কিংবা ভাবজড়তা কেন্দ্রিক দর্শন বা দৃষ্টিভঙ্গী নিয়ে৷ আত্মসুখকেন্দ্রিক দর্শনের অনুগামী বলতে বোঝায় যারা নিজের সুখ, নিজের স্বার্থ ছাড়া আর কিছু বুঝতে চায় না৷ তারা যা করে, নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির জন্যে নিজেদের সুখের জন্যে করে৷ তারা বলে ‘আপনি বাঁচলে বাপের নাম’৷ তাদের সমস্ত কার্যকলাপের পেছনে আছে এই আত্মসুখের বাসনা৷ পুঁজিবাদী দর্শন এই পর্যায়ে পড়ে৷
জড়কেন্দ্রিক দর্শন হল যারা জড়পদার্থের বাইরে কিছু বোঝে না বুঝতে চায় না৷ এরা বলে জড় বস্তু থেকে সবকিছু এসেছে, আর জড়বস্তুই অন্তিম পরিণতি৷ তারা ভৌতিক (বস্তুগত) চাহিদা ছাড়া অন্য চাহিদার কোনো মূল্য দিতে চায় না৷ মাকর্সবাদ এর উদাহরণ৷
ডগমাকেন্দ্রিক বা ভাবজড়তা কেন্দ্রিক দর্শন অযৌক্তিক কুসংস্কার ও ত্রুটিপূর্ণ ভাবাবেগের ওপর প্রতিষ্ঠিত৷ বিভিন্ন সম্প্রদায় ভিত্তিক ধর্মমতের গোঁড়ামি এসেছে এই ডগ্মাকেন্দ্রিক দর্শন থেকে৷
বিজ্ঞানভিত্তিক অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে শিক্ষিত মানুষেরা ধীরে ধীরে ভাবজড়তা কেন্দ্রিক দর্শন বা দৃষ্টিভঙ্গীর বন্ধন ছিঁড়ে বেরিয়ে আসছে৷ যদিও তারা সাধারণতঃ এখন জীবনের প্রকৃত লক্ষ্য ও কর্তব্য ব্যাপারে অন্ধকারে হাতড়াচ্ছে৷
আত্মসুখতত্ত্ব আধারিত পুঁজিবাদী সমাজ ব্যবস্থাই আজ প্রায় সর্বত্র চলছে৷ জড়বাদী দর্শনের অনুগামীরা শেষ পর্যন্ত এদের কাছে পরাভূত হয়ে কোনঠাসা হয়ে পড়েছে৷ বলা চলে, মাকর্সবাদের অপমৃত্যু ঘটেছে৷ বিশেষ করে রাশিয়া অর্ধেক ইয়ূরোপে কম্যুনিষ্ট সরকার কায়েম হলেও জনসাধারণের মোহভঙ্গ হবার সঙ্গে সঙ্গে সবাই প্রায় এক সঙ্গেই কম্যুনিজমকে ডাষ্টবিনে নিক্ষেপ করেছে৷ বুঝতে পেরেছে, সাম্যবাদের নাম নিয়ে এ হল চরম অত্যাচারী ডিক্টেটরী শাসন৷
চীনেও চলছে স্বৈরতন্ত্রী সরকার৷ আমেরিকা ও ইউরোপের বহুজাতিক সংস্থার বিনিয়োগই চীনা অর্থনীতির প্রধান স্তম্ভ৷ চীন কম্যুনিজমের অর্থনীতিকে বিসর্জন দিয়ে পুঁজিবাদী অর্থনীতিকেই আঁকড়ে ধরেছে৷ অন্যদিকে ডগমাকেন্দ্রিক দর্শনগুলিও মানুষের অজ্ঞতার সুযোগে মানুষের ওপর শোষণের হাতিয়ার হয়ে উঠেছে৷
বিংশ শতাব্দীতে নগ্ণভাবে প্রকটিত হ’ল ডগ্মাকেন্দ্রিক দর্শনগুলোর সঙ্গে সঙ্গে পুঁজিবাদ ও জড়বাদ কেন্দ্রিক দর্শনগুলিরও অন্তসারশূন্যতা৷ মানবতাবাদী মানুষ যুক্তিবাদী মানুষ এই তিন প্রকার শোষণ থেকেই মুক্তির জন্যে কাতরভাবে প্রতীক্ষা করছিল৷
শূন্যতা বেশি সময় থাকে না৷ তাই জগতের বুকে আদর্শগত এই শূন্যতা পূর্ণ করতেই শ্রীশ্রীআনন্দমূর্ত্তিজী আবির্ভাব৷ তিনি এমনি এক সর্বানুস্যুত দর্শন মানুষকে উপহার দিলেন, যাতে রয়েছে মানুষের আধ্যাত্মিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক সমস্ত সমস্যারই সুষ্ঠু সমাধান৷ এই নূতন সর্বানুসূ্যত দর্শন নিয়ে এক সর্বপ্রকার শোষণমুক্ত সর্র্বঙ্গ সমাজ গড়ার মিশন নিয়েই তাঁর আবির্র্ভব৷
১৯২১ সালের আনন্দপূর্ণিমা তিথিতে তাঁর আবির্ভাব৷ ১৯৩৯ সাল অর্র্থৎ যখন তাঁর বয়স ১৮ বছর---তখনই নোতুন মিশন নিয়ে ‘নোতুন পৃথিবী’ গড়ার স্বপ্ণ নিয়ে তাঁর যাত্রা শুরু হয়৷ কারণ এই বছর তিনি একজন সমাজের উন্মার্গগামী ডাকাত কালীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়কে দীক্ষা দিয়ে তাঁকে সেবাব্রতী সর্বত্যাগী সাধক বানিয়ে তাঁর যাত্রা শুরু করেন৷ তারপর ১৯৫৫ সালে তিনি সংঘ প্রতিষ্ঠা করলেন৷ এর পর একে একে তিনি তাঁর আধ্যাত্মিক দর্শন, সামাজিক ও অর্থনৈতিক দর্শন ‘প্রাউট’ দিলেন , তারপর সর্বত্যাগী সন্ন্যাসী মিশনারী গড়ে তুলতে শুরু করলেন৷ তিনি মার্গের ‘শিক্ষা, ত্রাণ, জনকল্যাণ বিভাগ খুললেন, দেশে দেশে তাঁর সর্র্বনুস্যুত আদর্শকে ছড়িয়ে দেবার জন্যে বহির্ভারতে প্রচারক পাঠানো শুরু করলেন৷ এমনিভাবে সারা পৃথিবী জুড়ে তিনি তাঁর কর্মযজ্ঞের বিস্তার ঘটালেন৷ তিনি অভিনব, ভাব, ভাগ, সুর ও ছন্দের সমন্বয়ে সঙ্গীতেরও নোতুন ঘরানা সৃষ্টি করলেন, ৫০১৮টি ‘প্রভাত সঙ্গীত রচনা করে তাতে নিজেই সুরারোপণ করলেন ও সারা পৃথিবীতে তা ছড়িয়ে দেওয়ার জন্যে ‘রাওয়া’ সংস্থা গড়ে তুললেন৷ অবশেষে ১৯৯০ সালের ২১ শে অক্টোবর তাঁর অজস্র ভক্ত-অনুগামীর ওপর তাঁর আদর্শের বাস্তবায়নের দায়িত্ব দিয়ে তিনি তাঁর পাঞ্চভৌতিক দেহ ত্যাগ করলেন৷
আজ তাঁর পাঞ্চভৌতিক দেহ আমাদের সামনে না থাকলেও তিনি তো প্রকৃতপক্ষে চৈতন্যময় তারকব্রহ্ম৷ তিনি ছিলেন, আছেন ও থাকবেনও চিরকাল৷ চাই উপলব্ধি ভক্তি চাই আদর্শ নিষ্ঠা৷
তাঁর মহান্ আদর্শকে আমরা আমাদের জীবনে ও বিশ্বভুবনে প্রতিষ্ঠা করবই৷ এটাই আমাদের দৃঢ় সংকল্প৷ তাঁর কাছে আমাদের একান্ত প্রার্থনা, তাঁর আদর্শকে বাস্তবায়িত করতে তিনি আমাদের শক্তি দিন৷
- Log in to post comments