‘‘তোমারই অনন্ত কাননে
ক’রি কুসুম চয়ন
তোমারই রাঙা শ্রীচরণে
সেবকের বিনম্র তর্পণ৷ ’’
ঈশ্বরের সর্বশ্রেষ্ঠ সৃষ্টি মানুষ৷ প্রাগৈতিহাসিক যুগের অরণ্য সঙ্কুল প্রাকৃতিক পরিবেশ থেকে চলা শুরু করে বিভিন্ন বিবর্তন ও জৈবিক সংগ্রামের মধ্য দিয়ে মানুষ আজ সভ্যতার চরম শিখরে উপনীত৷ জীবন পথের বিভিন্ন বাঁক পেরোতে গিয়ে জাগতিক নিয়মেই সে আজ মায়ার বাঁধনে আবদ্ধ৷ প্রতিনিয়ত জীবন সংগ্রামে ব্যাপৃত থাকলেও মাঝে মাঝেই হৃদয়ে অনুভব করে এক অজানা আকর্ষণ---কোন এক অচিনপুরের বংশীধবনি তার মনকে উদাস করে দেয়৷ জ্যোৎস্নাস্নাত কোন এক নির্জন সন্ধ্যায় তার মনের গভীরে শুণতে পায় অচেনা সঙ্গীত---উন্মুক্ত আকাশের নীহারিকা পুঞ্জের দিকে তাকিয়ে তার মন ক্রমশঃ সীমার সমস্ত বন্ধনকে ছিন্নভিন্ন করে’ ডানা মেলে উড়ে যায় বিরাটের অমোঘ আহ্বানে, অসীম অনন্তের রহস্য সন্ধানে৷
অনন্ত পথযাত্রী মানুষ ছুটে চলেছে পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্তে, গ্রহ থেকে গ্রহান্তরে, পর্বত শিখর থেকে মহাসমুদ্রের অতল গহ্বরে নোতুনের সন্ধানে৷ অজস্র আবিষ্কারের মধ্যেও তার খোঁজার শেষ নেই---শত-সহস্র প্রাপ্তি সত্ত্বেও তার মন অতৃপ্ত থেকে যায়---কী খঁুজে চলেছে তাও যেন তার অজানা৷ পরিশেষে একদিন পথশ্রান্ত হয়ে নিরালায় বসে ভাবতে থাকে, কোন উদ্দেশ্যে তার এই অনন্ত পথচলা!
ক্রমে বুঝতে পারে এতদিন সে বুঝি মরীচিকার পেছনেই ছুটে চলেছে৷ বস্তুতঃ সে যা চায়, যার খোঁজে সে দেশ-দেশান্তরে মরুপ্রান্তরে ঘুরে বেড়িয়েছে তিনি তো তার হৃদয়ের রাজা, অন্তরের দেবতা-প্রাণের মানুষ৷ সে যে তার হৃদয়ের গভীরে, অন্তরের অন্তঃস্থলে লুকিয়ে আছে৷ তার সন্ধান যে তাকে অন্তর্জগতেই করতে হবে৷
অনন্ত পিয়াসী মানুষ, তার চাওয়াও অনন্ত৷ ক্ষুদ্র খণ্ড বস্তুর মধ্যে সে কিছুতেই বাঁধা থাকতে চায় না, সর্বদাই ছুটে চলে অসীম অনন্তের পানে৷ ছোট ছোট পাওয়াগুলো তার অন্তরের তৃষ্ণা যেন আরও বাড়িয়ে তোলে৷ অসীমকে না পাওয়ার বেদনা প্রতি মুহূর্ত্তে তাকে বিদ্ধ করে৷ পার্থিব যন্ত্রণা সমূহ সহস্রমুখী নাগিনীর বিষাক্ত দংশনে তার অন্তর্জগৎকে, অস্তিত্বকে দুর্বিষহ করে তোলে৷ তার হৃদয় যেন প্রখর রৌদ্রতাপে জর্জরিত, তৃষিত ধরণীর মত পরম মঙ্গলময়ের করুণা-বারিধারার আশায় অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে থাকে৷
গ্রীষ্মের প্রচণ্ড দাবদাহে সমগ্র প্রকৃতির প্রাণ যখন ওষ্ঠাগত, মৃতপ্রায় জীবকুল একটুখানি বৃষ্টিপাতের জন্য চাতক-চাহনিতে অপেক্ষমান, তখনই কোনও এক শুভ মুহূর্ত্তে আকাশ জুড়ে দেখা দেয় কালো মেঘের ঘনঘটা, দিক্বিদিকে বিদ্যুতের চকিত চমক---প্রাকৃতিক নিয়মেই ধেয়ে আসে কালবৈশাখীর মত্ত প্রভঞ্জন৷ ধরিত্রীর সমস্ত পুরোনো জঞ্জাল উড়িয়ে অঝোর ধারাপ্রবাহে বিশুষ্ক প্রকৃতিকে করে সিক্ত, তৃপ্ত৷ একইভাবে মানুষের মন যখন জীবন যন্ত্রণার অভিঘাতে ঊষর মরুভূমির মত শুষ্ক, তৃষ্ণার্ত তখনই কোনও এক অজানা ইঙ্গিতে তার হৃদয় জগৎ তোলপাড় করা আন্তরপ্রশ্ণের মাঝে হঠাৎ বিচ্ছুরিত আলোর ঝল্কানি সামনে আসে---যেন দীর্ঘ অন্ধ তমিস্রার শেষে নব আলোকমালা তার অন্তরকে উদ্ভাসিত করে দেয়, সম্বোধির উন্মেষে এক ঝট্কায় অবচেতন মনের দুয়ার খুলে যায়---উপলব্ধি করে এতদিন যার সন্ধানে পৃথিবীময় ঘুরে বেড়িয়েছে, সে তো তার অন্তঃস্থলেই বিরাজমান৷ পরম আনন্দময়, তার একান্ত আপনজন স্নিগ্দ হাসিমুখে দু’হাত বাড়িয়ে আনন্দ আলিঙ্গনে উন্মুখ৷
হৃদয়ের গভীরে পরমপ্রিয়, পরমধন, পরমপুরুষকে অনুভবের পর আর কোনও চাওয়া-পাওয়া, ক্ষণিকের সুখ-দুঃখ, ব্যথা-বেদনা তাকে প্রভাবিত করতে পারে না৷ নদী যেমন বিভিন্ন শহর-নগর ঘুরে, কত শত চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে মোহনায় এসে সাগরের প্রশান্ত গভীরে পরমাশ্রয় খঁুজে পায়, ঠিক তেমনি অন্তর্লোকের অনুভূতিতে পরমপুরুষকে খঁুজে পাওয়ার পর মানুষেরও সব খোঁজা, সব চলার হয় পরিসমাপ্তি---কোটি কোটি জনমের অনন্ত পথ পরিক্রমা শেষে অন্তরের দেবতাকে পেয়ে তাঁতেই নিজেকে সমাহিত করে সেই পরম লীলাময়ের নব নব রসতরঙ্গে ছন্দায়িত হয়ে এক অনাস্বাদিত আনন্দ সাগরে অবগাহন করতে থাকে৷ বিশ্ববিধাতার চরণে সর্বস্ব সমর্পণ করে মানুষ অন্তর্জগতে যে দিব্য আনন্দের ফল্গুধারা প্রবাহে ভাসতে থাকে সেই অন্তর্লোকের আনন্দানুভূতির বিচ্ছূরণ বহির্জগতেও অবলোকন করে৷ বিশ্বপ্রকৃতির সকল সত্তার মধ্যে পরমপুরুষের লীলায়িত বিশ্বরূপ দর্শনে সে এক অনাবিল আনন্দের আস্বাদ পায়---জীব-জড়, উদ্ভিদ-জঙ্গম, মানুষ-মনুষ্যেতর, সৃষ্টির সমস্ত অস্তিত্ব থেকে নির্গত অবিচ্ছিন্ন আনন্দধারা তার হৃদয়-মনকে আপ্লুত করে রাখে৷
পরমাগতি-পরমপিতার সঙ্গে মহামিলনে মানুষ একদিকে যেমন অপার আনন্দ প্রাপ্ত হয়, অন্যদিকে তার চিদাকাশ মঙ্গলময়ের দিব্যজ্যোতিতে ঝল্মলিয়ে ওঠে৷ পরমজ্যোতির্ময়ের শুভ্র রশ্মিচ্ছটায় অন্তরের পুঞ্জীভূত অন্ধকার বিদূরিত হয়ে তার সামনে অনন্ত সৃষ্টি রহস্য উন্মোচিত হতে থাকে৷ বিশ্বস্রষ্টা পরমব্রহ্মের মানস তরঙ্গেই সমগ্র বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সৃষ্টি-স্থিতি-লয় বিধৃত৷ পরমাপ্রকৃতির প্রভাবে ভূমাদেহের বিবর্ত্তনে বিশ্বসৃষ্টি, অনন্ত রসপ্রবাহে তার বিস্তার ও স্থিতি আর সব চলমানতার শেষে সঞ্চর-প্রতিসঞ্চর পরিক্রমার অন্তে সেই পরমতত্ত্বেই বিলীন হয়ে যাওয়া---এইভাবে অনন্তকাল চলেছে সৃষ্টি প্রবাহ৷ এই লীলা তরঙ্গ দর্শনে ভক্ত হৃদয়ে অনুভূত হয় যেন পরমপুরুষ তাঁর একাকীত্ব ঘোচাতে এই বিশ্ব চরাচরের গ্রহ-নক্ষত্র-নীহারিকা, জীব-জড় সকল সৃষ্টিকে নিয়ে পুতুল খেলা খেলে চলেছেন আর তাঁরই ইঙ্গিতে কখনও হেসে কখনও কেঁদে সমগ্র সৃষ্ট সত্ত্বা এক অশেষ অপূর্ব লীলানন্দে বিভোর হয়ে আছে৷ তারপর সব খেলা সাঙ্গ করে অনন্ত পথচলা শেষে পরম করুণাময়ের পরম আশ্রয়ে আত্মসমর্পণের মাধ্যমে শাশ্বতী শান্তি লাভ করে৷
- Log in to post comments