আস্তিত্বিক প্রাণিনতার উৎস

Baba's Name
শ্রী প্রভাতরঞ্জন সরকার

আমাদের আস্তিত্বিক সম্ভাবনার সবটাই অণুচৈতন্য থেকে উৎসারিত৷ ভৌতিক স্তরে তা’ জ্ঞানেন্দ্রিয় ও কর্মেন্দ্রিয়ের মাধ্যমে কাজ করে৷ মানসিক স্তরে তা’ চিত্তবৃত্তির মাধ্যমে কাজ করে আর আধ্যত্মিক স্তরে তা মানসাধ্যাত্মিক পদ্ধতির দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়ে এগিয়ে চলে৷ এ সমস্ত কিছু মিলেই তৈরী করছে জীবের আস্তিত্বিক প্রাণিনতা৷

এখন প্রশ্ণ হচ্ছে, এই যে আস্তিত্বিক প্রাণিনতা এর উৎসটা কী এটা কী ভাবপ্রবণতা(sentiment), যুক্তি(logic), লক্ষ্য(desideratum), অথবা কর্মৈষণা (actional faculty)?

বস্তুতঃপক্ষে উত্তরটা হচ্ছে ‘‘এদের কোনটাই নয়৷’’ প্রকৃতপক্ষে আমাদের আস্তিত্বিক প্রাণিনতার যথার্থ উৎস অণুচৈতন্য ছাড়া আর কিছুই নয়৷

বস্তুতঃপক্ষে উত্তরটা হচ্ছে ‘‘এদের কোনটাই নয়৷’’ প্রকৃতপক্ষে আমাদের আস্তিত্বিক প্রাণিনতার যথার্থ উৎস অণুচৈতন্য ছাড়া আর কিছুই নয়৷

যে কোন সত্তার সংস্থিতি নিহিত রয়েছে চিত্তাধারে, চিত্ত অহংতত্ত্বের মাঝে ও অহংতত্ত্বের মাঝে ও অহংতত্ত্ব মহৎতত্ত্বের মাঝে৷ কিন্তু মহৎতত্ত্বের এই ‘‘আমি আছি’’ ৰোধটা জীবাত্মার সাক্ষিত্ব ব্যতিরেকে বিপর্যস্ত হয় না৷ ‘‘আমি আছি’’ ৰোধের অস্তিত্ব সিদ্ধির জন্যে আমাদের দরকার হয় ‘জ্ঞ’ ৰোধের অর্থাৎ ‘‘আমি জানি আমি আছি’’৷ প্রথমে আসে ‘‘আমি জানি’’ এই ৰোধটা৷ তারপরই না প্রশ্ণ উঠছে ‘‘আমি আছি’’ এই ৰোধের৷ সুতরাং আস্তিত্বিক সত্তার মূল উৎস ‘‘আমি জানি আমি আছি’’ এর ‘‘আমি’’র ওপর নিহিত৷ আর সেই চরম পরিণতিই হচ্ছে আমাদের আত্মা, আমাদের অণুচৈতন্য বা জীবাত্মা৷

এখন এই যে এইমাত্র চার ধরণের মানসপ্রবণতার (ভাব-প্রবণতার, যুক্তি, লক্ষ্য ও কর্মৈষণা) কথা বললুম তাদের সীমাৰদ্ধতা কোথায়?

ভাবপ্রবণতা ঃ অভিব্যক্তির জন্যে মনকে বিশেষ বিশেষ ধরণের চিত্তাণুসঞ্জাত বিষয়কে গ্রহণ করতে হয়৷ এই মানস বিষয়গুলো (ভালবাসা, ঘৃণা, ভয় ইত্যাদি) ‘বৃত্তি’ নামে পরিচিত৷ মনের বৃত্তির এক একটা বিশেষ ধরণের অভিব্যক্তিকে বৃত্তি আখ্যা দেওয়া যেতে পারে৷ মানসিক স্তরে এই বিষয়গুলোকে ৰলা হয় অভিব্যক্ত ভাবপ্রবণতা৷ সংক্ষেপে ভাবপ্রবণতা হচ্ছে মানসিক শক্তির বাহ্যিক প্রক্ষেপ যা যুক্তিপূর্ণ হতেও পারে, নাও পারে৷ ফলতঃ যেকোন মুহূর্তে ভাবাবেগ ভাবজড়তার দ্বারা আচ্ছন্ন হয়ে যেতে পারে৷ এই ধরণের এক অনিশ্চিত সত্তা আমাদের আস্তিত্বিক প্রাণিনতার উৎস হতে পারে না৷

যুক্তিবাদ ঃ যুক্তিবাদ তিনটে জিনিসের ওপর দাঁড়িয়ে আছে--- প্রত্যক্ষ, অনুমান ও আগম৷ আগম উদ্ভূত হয় প্রামাণ্য পুস্তক বা প্রামাণ্য ব্যষ্টি থেকে৷ দুর্ভাগ্যবশতঃ জ্ঞানের এই উৎসত্রয়ের কোনটাই সম্পূর্ণভাবে সামর্থ্যের সীমিতত্ব নিৰন্ধন ভুল সিদ্ধান্ত গৃহীত হতে পারে৷ জ্ঞানেন্দ্রিয়সমূহে ত্রুটির কারণে বা পারিপার্শ্বিকতায় ত্রুটি থাকলেও সিদ্ধান্ত ভুল হয়ে যায়৷ যথেষ্ট ও প্রকৃত উপকরণ না থাকার ফলে অনুমানওভুল হতে পারে ৷ শেষ পর্যন্ত আগম ও কালিক ও পাত্রিক প্রভাব মানুষকে ভুল পথে পরিচালিত করতে পারে ও করেও৷

লক্ষ্য ঃ প্রথম কথা হচ্ছে মানুষের লক্ষ্যকে অবশ্যই অভ্রান্ত হতে হবে৷ যদি কেউ কল্পনা করে যে তার জীবনের লক্ষ্য হচ্ছে ধনোপার্জন প্রসিদ্ধিলাভ অথবা কেউ যদি তার মৃত্যুর পর পুরাণ-বর্ণিত স্বর্গরাজ্যে যাবার ছাড়পত্র পেতে চায় তবে তাও নিশ্চিতরূপে ভীষণ বিপজ্জনক হতে পারে৷ কিন্তু লক্ষ্য যদি ঠিকও থাকে অর্থাৎ পূর্ণতাপ্রাপ্তি বা পরমপুরুষের সঙ্গে একাত্ম হয়ে যাওয়া যদি ঠিকও থাকেন তবু তা’ আমাদের আস্তিত্বিক প্রাণিনতার স্থায়ী উৎস হতে পারে না৷ ধরো, কোন মানুষ তার জীবনতরীকে ভব-সমুদ্রে পরমপুরুষরূপী ধ্রুবতারার সাহায্যে পরিচালিত করছে৷ সেটা ঠিক৷ কিন্তু যদি তার চিত্তাকাশ পাশরিপুরূপী মেঘে সমাচ্ছন্ন হয়ে যায় তবে কী হবে? বস্তুতপক্ষে অনেক মেঘই আছে যেমন বৃত্তি, সংসার, পাশ ও রিপু৷ এইভাবে দেখা যায় লক্ষ্য ঠিক থাকলেও তা’ নির্ভরযোগ্য নয়৷

কর্মৈষণা ঃ কাজের উদ্দেশ্যেই কাজ করে গেলে তা’ মুক্তি আনে না৷ বরং মানুষ তাতে অধিক থেকে অধিকতর কর্মৰন্ধনে আবদ্ধ হয়ে পড়ে৷ প্রতিটি কর্মের সংস্কার থাকবেই৷ যখন সংস্কার বাড়তে থাকে (তা সেগুলো ‘সু’ বা ‘কু’ যে সংস্কারই হোক, তা সে স্বর্ণশৃঙ্খল বা লৌহশৃঙ্খল যাই হোক) তখন মন সহজেই স্থূলত্ব প্রাপ্ত হয়ে যায়৷ এ জীবনের কোন মানুষ পরবর্ত্তী জীবনে পশু, বৃক্ষ, এমনকি ইট-কাঠ-পাথর হয়েও জন্মাতে পারে৷ তাহলে কর্মৈষণা কীভাবে আমাদের আস্তিত্বিক প্রাণিনতার উৎস হিসেবে স্বীকৃত হতে পারে৷

তাহলে স্পষ্টভাবে দেখা যাচ্ছে ভাবপ্রবণতা, যুক্তিবাদ, লক্ষ্য ও কর্মৈষণা---এই চারটের কোনটিই আমাদের আস্তিত্বিক প্রাণিনতার মূল উৎস নয়৷ তবে যাই হোক না কেন আমরা এই ত্রুটি থাকা সত্বেও তারা অবশ্যই আস্তিত্বিক প্রাণিনতার ৰোধগম্যতার ক্ষেত্রে আমাদের সহায়তা করতে পারে৷

ভাবপ্রবণতা যখন নব্যমানবতাবাদের দ্বারা পরিচালিত হয় তখন ভক্তিমার্গ মানবতাকে উন্নীত করতে পারে৷ তর্কশাস্ত্র যখন বিচারপ্রবণ মানসিকতার দ্বারা পরিচালিত তখন তা’ সমাজে ভৌম-ভাবপ্রবণতার প্রভাবকে নির্মূল করে দিতে পারে আর যখন তা’ ৰোধির দ্বারা পরিচালিত তখন তা’ জীবনের সর্বক্ষেত্রে আলোকবর্ত্তিকার ভূমিকা নিতে পারে৷

মানসাধ্যাত্মিক সাধনার দ্বারা আমাদের জীবনাকাশ থেকে সমস্ত মেঘকে সরিয়ে দেওয়া যেতে পারে৷ আর সেই ক্ষেত্রে লক্ষ্য সম্বন্ধে আমাদের স্বচ্ছ ধারণা অভ্রান্তভাবে যুক্তির পথে চলতে সাহায্য করে৷ এইভাবে শেষ পর্যন্ত সমস্ত কর্মৰন্ধনই ত্রিবিধ উপায়ে শেষ হয়ে যাবে৷ এই ত্রিবিধ উপায় হচ্ছে মধুবিদ্যা, কর্ত্তৃত্ত্বাভিমান ও ফলাকাঙ্ক্ষা ত্যাগ৷

শেষে বলি, কী ভাবে এই চারটে তত্ত্বকে যথাযথভাবে কাজে লাগাতে পার৷ এই প্রশ্ণের উত্তরে ৰলৰ, প্রমাসংবৃদ্ধি, প্রমাসিদ্ধি ও প্রমা সিদ্ধির পথে চলতে গেলে এই চারটে তত্ত্বকে কাজে লাগানো যাৰে৷