সততা, সেবা, নিষ্ঠা, মানবিক মূল্যবোধ সম্বন্ধে যদি সমাজের বুকে বেশকিছু ব্যষ্টির আন্তরিকতা ও আগ্রহ না থাকে তা হলে সমাজের কল্যাণ হয় না আর কল্যাণকামী মানসিকতারও প্রতিফলন সম্ভব নয়৷
আলোচনা প্রসঙ্গে বলি, বর্ত্তমানে সমাজ বলতে যা বোঝায় তা নেই৷ আজ যে যা পারে তাই করে বেঁচে থাকার লড়াই করছে৷ অন্যদিকে বৈশ্য যুগের ভয়ংকর আগ্রাসনে মানুষ বিভ্রান্ত, নিপীড়িত ও শোষিত হচ্ছে৷ ধনতান্ত্রিক তথা তথাকথিত সাম্যবাদী ব্যবস্থায় মূলতঃ শোষণ ও ঘৃণা প্রাধান্য পাচ্ছে৷ সেই কারণে কোন না কোন ভাবে মানুষ শোষিত ও বঞ্চিত হয়৷ ধনীর লক্ষ্যই হলো মুনাফা অর্থাৎ লাভ করা৷ এ লাভ শব্দটাই মূলতঃ বঞ্চনা ও শোষণের ওপর দাঁড়িয়ে আছে৷ শোষক পুঁজিপতির সঙ্গে সখ্যতা ও যোগসূত্রটা রয়ে গেছে দৃঢ়ভাবে এক শ্রেণীর পুরোহিত, মোল্লা, পাদ্রী গোষ্ঠীর৷ মানুষে মানুষে ভেদাভেদটা নানাভাবে সৃষ্টি করে চলেছে এরাই৷ তথাকথিত পাপ–পুণ্য, জাত–পাত ও নারী–পুরুষ বিভেদ নানা কুসংস্কারের জাল বিস্তার করে মানুষকে দিশেহারা করে বসে ধর্মমতের ভাবজড়তায়৷ আর সেই দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে সমাজের ওপরতলার সুযোগ সন্ধানীরা নানা ভাবে যুগ যুগ ধরে শোষণ চালিয়ে গেছে৷ তাছাড়া আগের যুগে শোষণ ও অত্যাচার করার ব্যাপারে রাজা ও পুরোহিত গোষ্ঠীর সঙ্গে গাঁট ছড়া বাঁধা ভালই ছিল৷
সেই মধ্যযুগে যখন বিজ্ঞানের উন্নতি হয়নি তখন যেমন ‘দৈববাণী’, ‘দৈবাদেশ’–এর নামে নারকীয় কাণ্ড ঘটানো হতো ঠিক তেমনি জমিদার, উচ্চ বর্ণের লোকদের অত্যাচার ও নির্মমতার শেষ ছিল না৷ নারী নির্যাতনটা ছিল সেদিন মানুষের সমাজে যেন ডাল ভাত৷
মানুষ বছরের পর বছর অত্যাচার সহ্য করে এগিয়ে এসেছে৷ রাজতন্ত্র গেছে, নোতুন শাসক এসেছে, কিন্তু নানা কুসংস্কারের লৌহ শিকল, ধর্মমতের অন্ধ কুসংস্কার থেকে মানুষ আজও বেরুতে পারেনি৷ সেই সাদাকালো, জাতপাত, উচ্চ–নীচ, নারী পুরুষ–এর ভেদাভেদের বেড়া আজও মানুষকে আষ্টেপিষ্টে বেঁধে রেখেছে৷
আজ প্রচণ্ড জড়বাদ আর ভোগবাদে প্রেষিত হয়ে কি শাসক আর কি তথাকথিত বুদ্ধিমান মানুষ সমাজকে ধবংসের পথে টেনে নিয়ে চলেছে৷
এরই মধ্যে শোষণের জ্বালা থেকে মুক্তি পেতে বেশকিছু নরনারী আপ্রাণ চেষ্টা করছে ও এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে চলেছে৷ প্রতিবাদী মনগুলি কিন্তু থেমে নেই তাই আশার আলোক যেন টিম্ টিম্ করে জ্বলছে এই গ্রহের এখানে সেখানে৷
পৃথিবীর সব মানুষ পথভ্রষ্ট নয়, যাঁরা সত্যের পূজারী, আদর্শবাদী তাঁদের সংখ্যা যদিও নগণ্য তাঁরা কিন্তু সেই জাগ্রত প্রহরীর মতো বিবেক চৈতন্যকে জাগিয়ে রাখার কঠিনতম কাজ করে চলেছেন৷
যখনই অশুভ শক্তি প্রবলতম হয়ে বিশ্বের সবকিছুকে ধবংস করে দিতে উদ্যত হয় তখনই সেই মহান পরমাত্মিক শক্তি পবিত্র আধারে নিজেকে জাগ্রত করে বিশ্বকে রক্ষা করে থাকেন৷ এই চরম সত্যকে অস্বীকার করার উপায় নেই৷ গত বিংশ শতাব্দীর দু’দশকের প্রথম দিকে এই ভারতবর্ষের বুকে ঠিক তেমনই এক মহাসম্ভুতির আর্বিভাব ঘটেছিল৷ তাঁরই নাম শ্রদ্ধেয় শ্রীপ্রভাতরঞ্জন সরকার যিনি আধ্যাত্মিক জগতে শ্রীশ্রীআনন্দমূর্ত্তিজী নামে বিশেষ পরিচিত৷ শ্রদ্ধেয় সরকার বিশ্বের সকল সৃষ্টিকে রক্ষার জন্যে প্রগতিশীল উপযোগ তত্ত্ব দিয়ে গেছেন যা প্রাউট নামে সমধিক পরিচিত৷ তাঁর দৃষ্টিতে বিশ্বের বুকে মানুষের সমাজ এক ও অবিভাজ্য৷ কিন্তু বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্যকে স্বীকার করে আঞ্চলিক শ্রীবৃদ্ধির পথ ধরে বিশ্বৈকতার লক্ষ্যে সঠিক উন্নয়নের পথে এগুতে হবে৷ এটাই তাঁর বাণী কিন্তু এই যে এগুতে হবে এই এগিয়ে চলতে যেটা সবচেয়ে প্রয়োজন সেটা হলো মানসিক বিস্তৃতি৷ এই মানসিক বিস্তৃতি ঘটাতে চাই আত্মিক সাধনা৷ সেই আত্মিক সাধনাই মানুষ উপলব্ধি করাবে সৃষ্টি রহস্যকে৷ মানুষের তখনই মানবিক মূল্যবোধ জাগবে আর সততা, সেবা ও নিষ্ঠায় প্রতিষ্ঠিত হবে৷
সত্যকথা বলতে কি পৃথিবীতে প্রকৃত অভাব হলো এই ধরণের সৎ মানুষ৷ শ্রীশ্রীআনন্দমূর্ত্তিজী আজীবন কঠোর পরিশ্রম করে গেছেন একটি সর্বাঙ্গ সুন্দর মানুষের সমাজ গড়ে তুলতে৷ যাঁরা যম–নিয়মে প্রতিষ্ঠিত হবে, তাঁরা মনে প্রাণে মানুষ তথা পৃথিবীর সকল জীবজন্তুকে ও গাছপালাকে সেবা দিয়ে তাদের সার্বিক বিকাশে ব্রতী হবে৷
যারা শোষণ করছে, বিভেদ সৃষ্টি করছে, বিশ্ব ধবংস করছে তাদের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হয়ে রুখে দাঁড়াবে৷ বাঁচ ও বাঁচতে দাও’ এটাই হোক সারা পৃথিবীর মানুষের শ্লোগান৷
ভেদাভেদের প্রাচীর গুঁড়িয়ে দিয়ে সকলকে নিয়ে এগিয়ে চলাই হলো সমাজ৷ মনে রাখতে হবে সারা পৃথিবী যেন একটি একান্নবর্ত্তী পরিবার৷ সেই পরিবারের যিনি মালিক তিনিই হলেন বিশ্ব স্রষ্টা৷ একে যারা নিছক মেকী দুষ্টবুদ্ধির দ্বারা অস্বীকার করে হিংস্র জন্তু জানোয়ারের মতো পৃথিবীর সীমিত ভৌতিক সম্পদকে নিজেদের কব্জায় আনতে শোষণ চালায় তারাই হ’ল সমাজের শত্রু৷ এই শত্রুদের বিরুদ্ধে ওই সব নীতিবাদী সৎ মানুষদের সংগ্রাম করে যেতে হবে৷
এই সংগ্রাম কোনদিনই বন্ধ হবে না বা থামবে না৷ তাই সৎ নীতিবাদী আধ্যাত্মিক সৈনিকদের বিশ্রামের কোন অবকাশ নেই৷ সংগ্রামই জীবন, তবে এই সংগ্রাম যেন অপরকে লুটে পুটে খাবার জন্যে সংগ্রাম না হয়৷ তাই আজ দরকার সেই সব সৎমানুষের ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধ গড়ে তোলা৷ তবেই মানুষের সমাজের প্রগতি ও উন্নতি ঘটবে৷
- Log in to post comments