সে আজ অনেকদিন আগেকার কথা৷ সেটা সম্ভবতঃ খ্রীষ্টপূর্ব ৫৩৪ সাল৷ রাঢ়ের রাজকুমার বিজয় সিংহ জলপথে সিংহলে আসেন–সঙ্গে নিয়ে আসেন সাত শত–র মত অনুচর৷ তখন রাঢ়ের রাজধানী ছিল সিংহপুর (বর্তমানে হুগলী জেলার সিঙ্গুর)৷ আর বন্দর ছিল সিংহপুরেরই নিকটবর্তী একটি স্থানে৷ পরবর্তীকালে সেই স্থানটির নাম হয়ে যায় সিংহলপাটন (স্থানটি সিঙ্গুরেরই কাছে)৷ বিজয় সিংহ লঙ্কা জয় করেন৷ তিনি ও তাঁর অনুচরেরা স্থায়ীভাবে লঙ্কায় বসবাস করেন৷ এঁরাই হলেন বর্তমান সিংহলী জনগোষ্ঠীর পূর্ব–পুরুষ৷ এই সিংহলীরা চালচলনে রীতিনীতিতে, আচারে ব্যবহারে বাঙালীদের খুবই নিকট৷ মুখাবয়ব বাঙালীদের মতই৷ কথা না বললে কে বাঙালী কে সিংহলী চেনা দায়৷ সিংহলী ভাষা বাংলারই মতই আর্য–ভারতীয় গোষ্ঠীর ভাষা, লিপিও তাই৷ আজকাল অধিকাংশ সিংহলীই হীনযানী বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী হলেও তাঁদের সাবেকী রীতি–রীবাজ বাঙলারই কাছাকাছি৷ সেনানায়ক, জয়বর্দ্ধন, গুণতিলক, ভাণ্ডারনায়ক (অনেকে ভুল করে ‘বন্দরনায়ক’ বলে থাকেন৷ ‘ভাণ্ডারনায়ক’ মানে যিনি সামরিক বিভাগের ভাণ্ডারের অধিকর্তা অর্থাৎ ষ্টোর কীপার), দেশনায়ক প্রভৃতি নাম ও পদবী সিংহলীদের৷
বিজয়সিংহের সন্তানাদি ছিল না৷ তিনি রাঢ় থেকে তাঁর জনৈক ভ্রাতুষ্পুত্র পাণ্ডু বাসুদেবকে এনে তাঁকে সিংহাসনের উত্তরাধিকারী করেন৷ এই সিংহলে বসবাসকারী মানুষেরাই পরবর্তীকালে মালাবার উপকূলের দক্ষিণাংশ (আজকাল যাকে বলি কেরল) অধিকার করেন ও সেখানে বসতি স্থাপন করেন৷ এঁরাই হলেন বর্তমান নায়ারদের আদিপুরুষ৷ নায়াররা আচার–ব্যবহারে, চালচলনে, মুখের ছাঁচে হুবহু বাঙালীদের মত৷ এঁরা বুদ্ধিবৃত্তিতে অত্যন্ত প্রখর৷
পাহাড় ও সমুদ্রবেষ্টিত কেরল রাজ্য তাঁর নিকটবর্তী তামিলনাড়ু ও কর্ণাটক থেকে কিছুটা পৃথক৷ যেখানে পার্শ্ববর্তী তামিল ভাষায় সংস্কৃত শব্দের শতকরা হার খুবই কম (বিপ্র তামিলে শতকরা প্রায় ২০ভাগ ও সাধারণ তামিলে শতকরা প্রায় ৫ ভাগের মত), তুলু ভাষায় শতকরা হার তামিলের তুলনায় কিছুটা বেশী হলেও তাও খুব বেশী নয় (বিপ্র তুলুতে শতকরা ৫০ ভাগের মত ও সাধারণ তুলুতে ২০ ভাগের মত), সেখানে মালায়ালাম ভাষায় সংস্কৃত শব্দের শতকরা হার প্রায় ৭৫ ভাগ৷ সম্ভবতঃ বাঙলার সঙ্গে সম্পর্ক থাকার ফলে এরকমটা হয়েছে৷ সিংহলী ভাষাতেও মালায়ালামের মত সংস্কৃত শব্দের শতকরা হার অত্যন্ত বেশী৷
পাহাড়–সমুদ্রের দ্বারা পৃথকীকৃত এই কেরলের ফ্লোরা ও ফনা (উদ্ভিদ ও জীবজন্তু) তার পাশ্ববর্তী রাজ্যগুলি থেকে আলাদা৷ এরাজ্যে পাওয়া যায়, নানান ধরনের ফুল–ফল ও যখন অরণ্য বেশী ছিল তখন পাওয়া যেত নানান ধরনের জীবজন্তু৷ কেরলের হাতী যদিও ভারতীয় বৃহদ্বর্গীয় হাতীরই একটি শাখা কিন্তু এদের চেহারায় কিছুটা বৈশিষ্ট্য আছে৷ তেকড়ি অভয়ারণ্যে গেলেই সেটা বোঝা যায়৷ সংস্কৃত ভাষার প্রতি এখানকার সব শ্রেণীর মানুষ শ্রদ্ধাশীল৷ খ্রীষ্টানরাও তো সংস্কৃত ভাষার রীতিমত চর্চা করেছেন ও করেন৷ শিক্ষিত মুসলমানেরা অনেকেই সংস্কৃত বেশ ভালোই জানেন৷ অর্থাৎ এর ব্যবহার কেবলমাত্র সমাজের উচ্চবর্ণীয় হিন্দু ব্রাহ্মণ (এখানকার বেশীর ভাগ ব্রাহ্মণ নম্বুদিরি ও পট্টীগোষ্ঠীভুক্ত৷ তবে তামিল ভূমির সীমান্ত জেলাগুলিতে তামিল ব্রাহ্মণেরা রয়েছেন যাঁরা বাড়ীর বাইরে মালায়লাম বলেন কিন্তু বাড়ীতে বিমিশ্র তামিল–মালায়লামে কথা বলেন৷ এখানকার নায়াররা কায়স্থ একথা আগেই বলেছি) ও কায়স্থদের মধ্যে সীমিত নয়৷ এই রাজ্যটি বিভিন্ন ধর্মমতের স্বাভাবিক সহিষ্ণুতার একটি অপূর্ব নিদর্শন৷ ইহুদীরা এখানে বাস করেছেন অতি প্রাচীনকাল থেকে৷ কারও মতে গত ১২০০ বছর থেকে৷ কারও মতে তারও আগের থেকে৷ এঁদের মাতৃভাষাও মালায়ালম৷ ধর্ম–শাস্ত্রকে তাঁরা মালায়ালামে অনুবাদ করে নিয়েছিলেন৷ সাম্প্রতিককালে এঁদের অনেকে ইসরায়েলে চলে গেছেন৷ অনেক সিনাগগ্ পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে রয়েছে৷
কেরলের সঙ্গে বাঙলার সাংস্কৃতিক যোগাযোগের কথা বলছিলুম৷ এখানকার মানুষও শুভকর্মে উলুধবনি/হুলুধবনি (পূর্ববাঙলায় যাকে বলে ‘জোকা’র দেওয়া) দেয়৷ কেরলে কেউ কেউ এই ধবনিকে বলে ‘মুখবাদ্যম্’৷ বাঙলার মতই কেরলেও আগে মাতৃগত কুলব্যবস্থা ছিল৷ বর্তমানে বাঙলায় যেমন মাতৃগত–পিতৃগত কুলব্যবস্থার মধ্যে একটা সন্তুলন করে নেওয়া হয়েছে, কেরলেও সেরকমটা হয়েছে ও হয়ে চলেছে৷ বৈদিক রীতিতে বিবাহ ব্যবস্থা ব্রাহ্মণরাই মেনে চলেন৷ বাকীরা অন্যান্য কোন না কোন স্বীকৃত রীতি মেনে চলেন৷ নায়ারদের মধ্যে সাধারণতঃ নায়ার, পানিক্কর, মেনন, কর্তা (বাঙলাতেও সম্মানিত মানুষকে ‘কর্তা’ নামে সম্বোধন করা হয়), পিল্লাই, কাইমাল প্রভৃতি পদবী রয়েছে৷
কেরলের প্রধান খাদ্য মাছ–ভাত৷ নারকোলের দুধ দিয়ে নানা ধরনের তরিতরকারী রাঁধতেও কেরলের গৃহিণীরা অভ্যস্ত৷ তবে রান্নার কাজে তাঁরা বাঙলার মত সর্ষের তেল ব্যবহার করেন না৷ নারকোল গাছ প্রচুর, তাই নারকোল তেলই রন্ধন কার্যে ব্যবহূত হয়৷ বর্তমানে কেরলের মেয়েরা শাড়ীর ব্যবহার শুরু করেছেন বটে, কিন্তু শাড়ী তাঁদের স্থানীয় পোশাক নয়৷
(শব্দ চয়নিকা, ৮/২৯)