প্রাচীনকালের মানুষ যাঁদের গঙ্গা–যমুনার উপর খুব শ্রদ্ধা–ভক্তি ছিল তাঁরা ভাবতেন ঈশ্বরের করুণাই অবস্থান্তর প্রাপ্ত হয়ে গঙ্গাধারার রূপ পরিগ্রহ করে থাকে কারো গঙ্গাস্নানের আকর্ষণ কর্ত্তব্যের প্রেরণায়, কারো বা ধর্মোন্মাদনার প্রেষণায় কেউ বা গঙ্গাস্নান করেন ডগমা বা ভাবজড়তার বশবর্ত্তী হয়ে, আর কেউ বা পুরাণের কাহিনীকে গুরুত্ব দেন ৰলে৷ সত্যিই গঙ্গা ‘‘পতিত পাবনী’’ এ কথা ঠিকই যে গঙ্গা সুবিশাল আর্যাবর্ত্তের স্তন্যদাত্রী জননী৷ এও ঠিক যে নদীর বহমান ধারায় স্নান করলে তা শরীর মনকে স্নিগ্ধ করে৷ তবে গঙ্গাস্নানে কোন বিশেষ গুণ আছে কি না তা পণ্ডিতেরা বিচার করে দেখতে পারেন৷ তবে আপাতঃদৃষ্টিতে তেমন গুণ আছে ৰলে মনে হয় না কারণ মীন ও অজস্র জীবজন্তু গঙ্গায় স্নান করে থাকে, তাদের মল–মূত্র নিত্য গঙ্গায় পতিত হয়৷ তারা গঙ্গা স্নান করে কতটা বৈকুণ্ঠের কাছে পৌঁছোয় তা কেউই হলফ করে ৰলতে পারৰে না৷ তবে একথা ৰলৰ যে গঙ্গাস্নান হিসাবে মন্দ নয় যদি সেখানে জলৰিদূষণ না হয়ে থেকে থাকে৷ পৌরাণিক কাহিনী অনুযায়ী বৈকুণ্ঠে নারায়ণের চরণোদক থেকে গঙ্গার উৎপত্তি৷ ৰাঙলার রাজা ভগীরথ তাঁর তপস্যার ৰলে গঙ্গাকে মর্ত্ত্যে আনয়ন করেন৷ আকাশ থেকে নীচে নাৰবার সময় গঙ্গার তোড়ে বসুন্ধরা যাতে বিদীর্ণা না হন তাই শিব তাঁকে জটায় আশ্রয় দিয়ে তাঁর গতিবেগ বা তোড় কমিয়ে দেন৷ কাহিনী অনুযায়ী গঙ্গা চতুর্ধারায় বিভক্ত হয়েছিল৷ তার একটি ধারা মর্ত্ত্যে চলে আসে ঃ
‘‘স্বর্গেতে অলকানন্দা মর্ত্ত্যে ভাগীরথী
দেৰলোকে মন্দাকিনী পাতালে ভোগবতী৷’’
সুতরাং গঙ্গাস্নান মানে বিষ্ণুর চরণোদকে স্নান৷ এই ভেবে ভক্ত পুণ্যার্থী গঙ্গাস্নানে আকৃষ্ট হৰেন ৰৈ কি তাঁরা গঙ্গাকে বিষ্ণুর করুণার বিগলিত রূপ হিসেবে ভাবৰেন ৰৈ কি
অন্য কাহিনী অনুযায়ী গঙ্গা শিবের পত্নী৷ শিবজায়া গঙ্গার জলবিধৌত হতে কোন্ শৈব, কোন্ শাক্ত না চাইৰেন তাই গঙ্গা যে কেবল বৈকুণ্ঠনিবাসী নারায়ণের পাদোদক তাই নয় শাক্ত শৈবের কাছে গঙ্গা পুণ্যতোয়া৷
‘‘হরিপাদপদ্মবিহারিণ্
গঙ্গে হিমবিধুমুক্তাধবলত্৷
* * *
তব তটনিকটে যস্য নিবাসঃ
খলু বৈকুণ্ঠে তস্য নিবাসমঃ৷
* * *
ভাগীরথি সুখদায়িনি মাতস্তব
জলমহিমা নিগমে খ্যাতঃ৷
* * *
‘‘দেবি সুরেশ্বরি ভগবতি
গঙ্গে ত্রিভুবনতারিণি তরলতরঙ্গে৷
শঙ্করমৌলিনিবাসিনি বিমলে,
মম মতিরাস্তাং তব পদকমলে৷৷’’
* * *
নাহং জানে তব মহিমানং,
ত্রাহি কৃপাময়ি মামজ্ঞানম্৷’’
* * *
সুতরাং সাধারণ মানুষই নয়, জ্ঞানী–গুণীরাও গঙ্গাকে ৰিগলিত করুণা হিসেৰে দেখেছিলেন৷ তাই গঙ্গা–মহিমাকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দেওয়া যায় না৷ অন্য নদীর সঙ্গে গঙ্গার গুণগত পার্থক্য খুব কম৷ বরং গঙ্গার তীরবর্ত্তী শিল্পকেন্দ্রগুলি যে পরিমাণ আবর্জনা গঙ্গাজলে নিক্ষেপ করে তাতে গঙ্গাস্নানে রোগ ৰৃদ্ধিও অৰশ্যই ঘটতে পারে৷
‘‘এক ডুৰ কাক ডুৰ দুই ডুৰ ৰ্যাঙ
তিন ডুৰে শরীর টান
চার ডুৰে গঙ্গা স্নান৷’’
‘‘জাহ্ণবী–যমুনা বিগলিত করুণা’’
ৰর্দ্ধমান জেলার ৰেশীর ভাগ অংশই অ–গঙ্গার দেশ, তাই দেখেছি গ্রামাঞ্চলের সাদামাঠা অনেক মানুষই ৰলে থাকেন মরণান্তে তাকে যেন তিরপুণী (ৰর্দ্ধমানের গ্রাম্য মানুষ ত্রিবেণীকে ‘তিরপুণী’ ৰলে৷ ৰর্দ্ধমানের গ্রাম্য ছড়ায় আছেঃ
‘‘চালভাজা খেতে খেতে গলা হয় কাঠ
হেথা কোথা জল পাৰ
সেই তিরপুণির ঘাট
তিরপুণির ঘাটাতে বালি ঝুরঝুর করে
সোনার গায় রোদ লেগেছে ডালিম ফেটে পড়ে৷’’) ঘাটে দাহ করা হয়, ছাইগুলো যেন গঙ্গাজলেই শেষ আশ্রয় পায়৷
মনে পড়ে গেল আমার ছোট বয়সের পাড়াতুত এক ঠাকুমার কথা৷ ঠাকুমা রোজ ট্রেনে করে ছয় মাইল দূরবর্ত্তী গঙ্গায় ডুৰ দিয়ে আসতেন৷ অতি ভোরে বেরুতেন, ফেরবার সময় হাতে ছাপ, কপালে ছাপ, বুকে তিলক, নাকে রসকলি লাগিয়ে ফিরতেন৷ সবই করতেন.... কেবল করতেন না টিকিট৷ ইষ্টিশানে চেকারৰাৰু যখন হাত পেতে শুধোতেন –মা, আপনার টিকিটটা? কোলকুঁজো ঠাকুমা বাঁ হাতটা উপরের দিকে কেৎরে দিয়ে ৰলতেন–আ মরণ মিনসের ছেলে পেছনে রয়েছে দেখছ না টিকিটটা তার হাতেই রয়েছে৷
চেকারৰাৰু কোন কোন দিন শুধু হাসতেন, কেবল ৰলতেন–মা, রোজই তো ৰলেন ছেলে পেছনে আসছে৷ কই, এক দিনও তো আপনার ছেলের টিকি দেখতে পাই না৷
ঠাকুমা একটু ঝাঁঝালো ভাষায় ৰলতেন–আমার ছেলে কি ভিনদেশী নাকি যে মাথায় টিকি রাখৰে ৰাঙালী পোলা মাথায় টিকি রাখে না মরণ....মিনসের মরণ
একদিন আমি ৰুকে ৰল নিয়ে সাহসে ভর দিয়ে শুধোলুম–হ্যাঁ গো ঠাকুমা, তুমি যে গঙ্গাস্নান করো, কষ্ট করো, তিলক–ছাপ, চন্দন–ছাপ, তিলক–মাটি লাগাও, সেই যে নাকে রসগোল্লা না কী একটা লাগাও এ তো পুণ্যি করা ঠিক, কিন্তু বিনা টিকিটে ট্রেন ভ্রমণ করায় সব পুণ্যি তো বরৰাদ হয়ে যাৰে....এ যেন সেই এক ভাঁড় গোদুগ্ধে এক ফোঁটা গোরোচনা৷
ঠাকুমা ৰললেন–খোকন, ওইখানেই তো ভুল করলি৷ বিনা টিকিটে ভ্রমণের পাপটার দিকে তাকিয়ে দেখলি কিন্তু গঙ্গাস্নানের পুণ্যিটার দিকে ভাল করে তাকালি না ৷ গঙ্গাস্নানে যে পরিমাণ পুণ্যি হয় বিনা টিকিটে ভ্রমণে সে তুলনায় পাপ একেবারেই অকিঞ্চিৎকর৷ তাই দু’য়ে যে গায়ে গায়ে শোধ হৰে তার জো নেই৷
‘‘একবার গঙ্গাস্নানে যত পাপ হৰে,
পাপীদের সাধ্য নাই তত পাপ করে৷’’
(শব্দ চয়নিকা)