বিপজ্জনক উক্তি

লেখক
মনোজ দেব

রাজ্য রাজনীতিতে হঠাৎ গজিয়ে ওঠা কিছু নেতা এক-এক সময় কাণ্ডজ্ঞানহীন মন্তব্য করে বসেন৷ সব সময় যে অজ্ঞতার কারণে এই ধরণের কথাবার্ত বলেন তা নয়, বরং এটা তাদের রাজনৈতিক কৌশল৷ প্রচারের আলোতে আসার জন্যে ইচ্ছাকৃত ভাবেই অশালীন অভব্য মন্তব্য করেন৷ অনেক সময় অবাস্তব আজগুবি কথা বলে  বাজার মাত করে যাতে আসল সমস্যা থেকে মানুষের মন সরে যায়৷ চারিদিকে হৈ-চৈ পড়ে যায়৷ সংবাদ মাধ্যমে প্রচার চলতে থাকে৷ কাণ্ডজ্ঞানহীন নেতা এক ধরণের আত্মতৃপ্তিতে আপ্লুত হয়ে পড়েন৷ কিন্তু অপরিণামদর্শী এই নেতারা বোঝেন না, তার একটা মন্তব্য যে কোনও সময় জনমানসে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে না, অনেক অঘটন ঘটিয়ে অনেক অনাসৃষ্টি বাধায়৷

এই মুহূর্ত্তে রাজ্য রাজনীতিতে ‘ভাঁড’ বলে পরিচিত, রাজ্যের প্রধান বিরোধী দলের প্রধান মুখ৷ তিনি একজন সাংসদ৷ মাঝে মাঝে এমন সব মন্তব্য করে বসেন! যা শুনে ছোটবেলার হারিয়ে যাওয়া একটা দৃশ্য মনে পড়ে৷ পাড়ার ফাজিল ছেলেরা কারো বাড়ীর রাস্তার ধারে বারান্দা (রক) থাকলে সেখানে বসে আড্ডা দিত৷ ভদ্র ঘরের ছেলেমেয়েরা ওদের সামনে দিয়ে যাওয়ার উপায় থাকত না৷ বয়স্কদের কিছু বলার সাহস থাকত না৷ পাড়ার রকে বসে আড্ডা দিত বলে ওদের রকবাজ বলা হ’ত৷ আজকাল ওই আড্ডাটাও উঠে গেছে৷ রক্বাজ শব্দটিও আর শোনা যায় না৷ রাজ্য রাজনীতির কিছু নেতার কথাবার্তায় মাঝে মধ্যে রক্বাজ চেহারা ফুটে ওঠে৷ রাজনীতির সঙ্গে দুর্নীতি যেমন ওতঃপ্রোতঃভাবে জড়িয়ে পড়েছে যা মানুষের গা-সওয়া হয়ে পড়েছে তেমনি নেতাদের মুখে রক্বাজী কথাবার্তায়ও মানুষের গা-সওয়া হয়ে যাচ্ছে৷ যেমন অতি সম্প্রতি  মুর্শিদাবাদের এক শিক্ষক খুন নিয়ে জঘন্য সাম্প্রদায়িক খেলা খেলেছে রাজ্যের প্রধান বিরোধী দল, সত্যটা সামনে আসতে অবশ্য চুপ হয়ে গেছে৷ কাশ্মীরে জঙ্গীদের হাতে এ রাজ্যের পাঁচজন খুন হওয়ার পর বিরোধী দলের কিছু নেতা এমন মন্তব্য করেছে যা অমানবিক ও বিজ্জনক৷ গণতন্ত্রে বাক্ স্বাধনতা আছে বলে যা খুশী মন্তব্য করা যায় না৷ সমালোচনা করারও অধিকার সকলেরই আছে৷ তবে সব কিছুর একটা সীমারেখা আছে৷ সেই সীমারেখা অতিক্রম করার ফল ভয়ঙ্কর হতে পারে৷ একজত্রন সাংসদের একটি মন্তব্য অগ্ণিস্ফুর্লিঙ্গের মত ছড়িয়ে পড়তে পারে৷

কশ্মীরে পাঁচজন বাঙালী হত্যার পর রাজ্যের প্রধান বিরোধী নেতা যিনি একজন সাংসদও বটে, তার রাজ্যে পাঁচজন ভিন রাজ্যে গিয়ে খুন হয়ে গেল, তাদের আত্মীয়-স্বজনদের প্রতি সহানুভুতি না দেখিয়ে নিহতদের জাতি বিচার করছেন৷ কিন্তু তিনি যে বিপজ্জনক মন্তব্যটি করেছেন---পাঁচজন খুন হওয়ার জন্যে দায়ী রাজ্য সরকার৷ একজন সাংসদের এরকম দায়িত্বজ্ঞানহীন উক্তি করার আগে ভেবে দেখা উচিত ছিল কশ্মীর কেন্দ্রশাসিত একটি অঞ্চল, এখানকার আইন শৃঙ্কলা রক্ষা করার দায় কেন্দ্রীয় সরকারের৷ কশ্মীরে যে পাঁচজন খুন হয়েছে তার দায় কেন্দ্রীয় সরকারকেই নিতে হবে৷ কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে কেন্দ্রের শাসকদলের কোন নেতা বা মন্ত্রী, এমনকি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রীও সামান্য দুঃপ্রকাশও করেননি৷ দিল্লীর শাসক দলের এ রাজ্যের নেতারাও মৃতদের পরিবারের প্রতি সামান্য সৌজন্য দেখাননি৷, উপরন্তু দায়িত্বজ্ঞানহীনের মত অমানবিক, অশালীন মন্তব্য করে চলেছেন৷ ভারতবর্ষ একটি যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো৷ এখানে এক রাজ্যের মানুষ রুটি-রুজির জন্যে আর এক রাজ্যে যায়৷ প্রতিবছরই পশ্চিমবঙ্গ থেকে বহু মানুষ ভিন্ রাজ্যে পাড়ি দেয়৷ সেটা যদি এ রাজ্যের ব্যর্থতা হয়, জীবিকা অর্জনের জন্যে অন্য রাজ্যে গিয়ে এ রাজ্যের কেউ খুন হলে তার দায় যদি এখানকার রাজ্য সরকারের হয়, তবে মাননীয় সাংসদ দিলীপ ঘোষের মনে রাখা উচিত এরাজ্যেও প্রায় দু’কোটী মানুষ আছে, যারা জীবিকার্জনের জন্যে এ রাজ্যে এসেছে৷ এদের অধিকাংশই বিজেপি শাসিত রাজ্য থেকে এসেছেন৷ এদের চলে আসাটা কি সেই সব রাজ্যের ব্যর্থতা নয়? আজ যদি এদের কেউ এখানে খুন হয়, তার দায় কি ওইসব রাজ্যের সরকারের ওপর বর্তাবে না? এটা নিশ্চিত  পশ্চিমবঙ্গে এই মুহূর্ত্তে যদি ভিন রাজ্যের কোন বাসিন্দা খুন হয়, দিলীপ ঘোষ এ রাজ্যের আইন-শৃঙ্খলার অবনতি নিয়ে গলা ফাটাবে৷ রাজনীতির এই দ্বিচারিতাই আজ নির্লজ্জ বেহায়া নেতাদের আদর্শ হয়ে গেছে৷ জম্মু-কশ্মীরে এ রাজ্যের মানুষ মরলে এ রাজ্যের সরকার দায়ী৷ আবার এ রাজ্যে ভিন রাজ্যের মানুষ যদি মরে তার দায়ও বিরোধীরা এখানকার সরকারকে চাপাবে৷ এই ধরণের বিরোধিতা ভারতবর্ষের সংহতির পক্ষে বিপজ্জনক৷ শাসক দলের সমালোচনা করতে গিয়ে এদের মন্তব্য যে কোন সময় সাম্প্রদায়িকতা বা প্রাদেশিকতার আগুন জ্বালাতে পারে৷ তাই এই ধরণের বিপজ্জনক উক্তি থেকে নেতাদের সংযত হওয়া দরকার৷