ভারতীয় শিক্ষার প্রাণ ধর্ম

লেখক
শ্রী রবীন্দ্রনাথ সেন

বন্ধ ছিল আমার দুয়ার, অন্ধ ছিল নয়ন আমার৷

আচম্বিতে প্রাণের স্রোতে হিয়া ভরালে৷৷

আঁাঁধার নিশার অবসানে জ্যোতি ঝরালে৷৷’’

                                                     প্রভাত সঙ্গীত৷

একটি ক্লাসে চারটি ছেলে একই সঙ্গে পড়তে বসল৷ শিখতে লাগল একই জিনিস একই শিক্ষকের কাছ থেকে৷ পরীক্ষায় লিখল চার জনে চার রকম৷ পরীক্ষায় কেউ প্রথম হল, কেউ দ্বিতীয়, কেউ বা তৃতীয়৷ এর কারণ কী? এর কারণ তিনটি– প্রথমতঃ শিক্ষা গ্রহণে ইন্দ্রিয় দ্বারের সামর্থ্য সবাইকার সমান নয়৷ দ্বিতীয়তঃ স্নায়ু তন্তুর স্পন্দন ভেদে, স্পন্দন গ্রহণের মাত্রা ভেদে, স্নায়ু তন্তুর সামর্থ ভেদে স্পন্দনের মাত্রা ভেদ হয়ে যায়৷ তৃতীয় স্তরে স্নায়ুকোষে ও স্পন্দনের তারতম্য দেখা দেবে৷ স্নায়ু কোষের সামর্থ্য ও চার জনের এক রকম নয়৷ তাই চার জনের শিক্ষা হল চার রকমের৷ শুধু তাই নয়, স্নায়ু কোষ থেকে যে উৎসারণ অর্থাৎ স্মৃতি থেকে বাইরে টেনে আনা নির্ভর করে স্নায়ু কোষের সামর্থ্য, আজ্ঞা নাড়ীর সামর্থ্য ও বহিঃকর্ণের সামর্থ্যের উপর৷

‘‘অনুভূত বিষয়াসম্প্রমোষঃ স্মৃতি’ – অর্থাৎ যে বিষয়টি একবার অনুভূত হয়েছে তাকে আবার নোতুন করে স্পন্দনের মাধ্যমে যে জাগিয়ে তোলা তাকে বলে স্মৃতি৷ তাই স্মৃতি ও সবাইকার সমান নয়৷ সেই জন্যে উত্তর পত্রে সবাই সমভাবে উত্তর দিতে পারবে না৷

প্রশ্ণ ওঠে শিক্ষা কী? আমরা কী ভাবেই বা শিক্ষা গ্রহণ করি৷ এ বিষয়ে বিভিন্ন মনীষী তাঁদের মত ব্যক্ত করেছেন৷ স্বামী বিবেকানন্দের মতে – শিক্ষা হল মানুষের অন্তর্নিহিত পূর্ণতার বিকাশ৷ মহান শিক্ষাবিদ    শ্রীপ্রভাতরঞ্জন সরকার বলেন –‘আমরা যখন কারো প্রমুখাৎ বা অন্য কোনো সূত্র থেকে বা অভিজ্ঞতা থেকে ইন্দ্রিয় দ্বারের মাধ্যমে কোন কিছু গ্রহণ করি, স্নায়ু তন্তুতে আসে তদ্ভাবাত্মক একটা স্পন্দন...স্নায়ুকোষ ও তদ্ভাবে স্পন্দিত হয়৷ তখন সেটাকে বলি শিক্ষা৷’’

বৈদিক শিক্ষ্ ধাতু থেকে বাংলায় শিক্ষা শব্দটি পাই যার ইংরেজী প্তন্দ্ব্ত্রব্জুনুন্ধ৷

ঋগ্বেদীয় ‘জ্ঞা’ ধাতুর অর্থ জানব৷ এই ‘জ্ঞ’ থেকে প্রাচীন লাতিনে হচ্ছে ‘কিঞ’ বা কেনো (ন্ন্দ্বুপ্স)৷ এই ন্ন্দ্বুপ্স থেকে ইংরেজী ‘নুপ্সভ্র’ ধাতুটি এসেছে৷

এই যে ‘জ্ঞ’ ধাতু এর অর্থ হল বাহ্যিক তত্ত্বের অভ্যন্তরীণ তত্ত্বে রূপান্তরণ, কর্মভাবের কর্ত্তৃভাবে রূপান্তরণ (ব্দব্ভত্ব্ন্দন্দ্বন্তুব্ধ্ প্সন্দ্র ন্দ্বপ্রব্ধন্দ্বব্জুত্র প্সত্ব্ন্দন্দ্বন্তুব্ধন্ল্)৷ এই যে বাহিরকে ভিতরে আনা এটাই হল জানা৷ এই জানা বা জ্ঞান ক্রিয়া যখন স্বভাবগত হয়ে দাঁড়ায় তখন তা এসে বায়ু বিদ ধাতুর আওতায়৷ যিনি এই জ্ঞানকে স্বভাবগত করেছেন তাঁর গুণটা বিদ্যা৷ আর তিনি হলেন ‘বিদ্বান’ স্ত্রী লিঙ্গে ‘বিদ্বতী’৷

বৈয়ষ্টিক তথা সামূহিক জীবনে সুসংহত জীবন যাত্রা ও শিক্ষার মাধ্যমে মনের অন্তর্নিহিত গুণাবলীর বিকাশ ঘটিয়ে তুলতে পারা যায়৷ বৈয়ষ্টিক জীবনে মনোরাজ্যের এই যে এক অভ্যন্তরীণ শৃঙ্খলা (ঢুব্ধন্দ্বব্জুত্রপ্ত ড্ডন্ব্দন্তুন্হ্মপ্তনুন্) একেই বলে ব্যষ্টি জীবনের প্রাণ ধর্ম৷ আবার যখন জাতীয় (ব্ধন্প্সুত্রপ্ত) গুণগত বৈশিষ্ট্য গুলো এক বিশেষ পথ ধরে প্রকাশিত হয়ে ওঠে তাকে বলে জাতির প্রাণ ধর্ম৷

বহু প্রাচীন কাল থেকেই ভারতবর্ষ তার নিজস্ব প্রাণ ধর্মের অনুশীলন করে আসছে৷ জগৎ ও জীবন সম্বন্ধে ভারত অবশ্যই অন্তর্মুখী৷ প্রতিটি চিন্তা ও কাজকে তারা আধ্যাত্মিক সাধনার অঙ্গ মনে করেই তা করে থাকে৷ এই কারণে সমগ্র ভারতীয় জীবন ধারাটাই হয়ে পড়েছে আধ্যাত্মিক৷ এই অন্তর্মুখী জীবন ধারাই হল ভারতের প্রাণ ধর্ম৷ ভারতীয় শিক্ষা ব্যবস্থাও এই মূল প্রাণ ধর্মের ওপরেই প্রতিষ্ঠিত ছিল৷ ফল স্বরূপ, ভারতীয় বিদ্যার্থী হয়ে উঠে ছিল শ্রদ্ধাশীল, বিনয়ী ও উন্নত আচরণ পরায়ণ৷

বৈদিক যুগে বিশেষ কোনো শিক্ষা পদ্ধতির প্রচলন ছিল না৷ সাধারণতঃ শিক্ষার্থীরা পাঁচ বছর বয়সে গুরুগৃহে অধ্যয়ন করতে যেত আর চব্বিশ বৎসর বয়সে পড়াশুনা শেষ করে বাড়ীতে ফিরে আসত৷ গুরু বা জন সাধারণের কাছ থেকে অর্থ সংগ্রহ করে চতুষ্পাঠীর ব্যয়ভার বহন করতেন৷ তখন লিপির প্রচলন ছিল না৷ বিদ্যার্থীরা গুরুর মুখ থেকে শুনে শুনে বিষয় মুখস্থ করত৷ এই কারণে বেদের অপর নাম শ্রুতি৷

বৈদিক ভাষায় ব্যাকরণ ছিল না৷ পানিনিই প্রথম সুসংবদ্ধ সংস্কৃত ব্যাকরণ সঙ্কলন করেন৷

মহাভারতের যুগে শিক্ষা ব্যবস্থা কিছুটা নিয়মানুগ হয়েছিল৷ চতুষ্পাঠী গুলো রাজা ও প্রজাদের কাছ থেকে অর্থ সাহায্য পেত৷ মহাভারতের যুগে জন ভাষা ছিল প্রাকৃত৷ পড়াশুনার জন্যে শিক্ষার্থীদের গুরুগৃহে বাস করতে হত তথাপি বেশ কিছু অনাবাসিক পড়ুয়াও ছিল৷ তখন পড়ানো হত ব্যাকরণ, সাধারণ জ্ঞান পরে প্রবণতা অনুযায়ী অস্ত্র বিদ্যা বা শাস্ত্র৷ সে যুগে শিক্ষা ব্যবস্থা ও সমাজ ব্যবস্থার মধ্যে একটা যোগ সূত্র ছিল৷ ন্যায়, স্মৃতি, ব্যাকরণ, অধ্যাত্ম–বিজ্ঞান এই সমস্ত বিষয়েই পঠন–পাঠন চলত৷ বৈদিক যুগে দর্শনও ছিল না৷ পুস্তকও ছিল না, ছিল শুধু আধ্যাত্মিক শিক্ষা৷ মহাভারতের যুগে ছিল আধ্যাত্মিক শিক্ষা, ছিল পুস্তক কিন্তু ছিল না কোনো সুসঙ্কলিত দর্শন৷

তারপর এল পৃথিবীর প্রথম দর্শন মহর্ষি কপিলের সাংখ্য দর্শন৷ মহাভারতের যুগে সংস্কৃত ছিল শিক্ষার মাধ্যম ও লেখার জন্যে ব্যবহূত হত ভূর্জপত্র – তালপত্র নয়৷ বৌদ্ধ যুগে গড়ে উঠেছিল বড় বড় বিশ্ববিদ্যালয় যারা অন্যান্য ক্ষুদ্রায়তন শিক্ষা কেন্দ্রগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করত৷ যেমন রাজসাহীর বাণেশ্বরপুর বিহার, ভাগলপুরে বিক্রমশিলা বিহার, পটনায় নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় (বিহার)৷ বৌদ্ধ যুগে বিহারগুলো কেবল সরকারী সাহায্যের ওপর নির্ভর ছিল৷ জনসাধারণের আর্থিক অনুদান পেতনা৷ বৌদ্ধ রাজ্যগুলোর পতনের একশ বছরের মধ্যে সারা ভারতের বিহারগুলি একেবারে বন্ধ হয়ে গেল৷ এথেকে আমরা এই শিক্ষা পাই শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সবসময় জনসাধারণের সাহায্যের ওপর নির্ভর শীল হওয়া উচিত, সরকারী সাহায্যের ওপর নয়৷

মহাভারতের যুগে যেহেতু শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন পন্ডিতের ছত্রতলে একত্রিত হত৷ তাই তাদের ছাত্র নামে অভিহিত করা হল৷

মোগল ও পাঠান যুগে ভারতীয় প্রাণ ধর্মের ওপর পরোক্ষভাবে আঘাত হানার চেষ্টা করা হয়েছিল৷ তবে ভারতীয় প্রাণ ধর্মের খুব বেশী ক্ষতি তাঁরা করতে পারেন নি৷ বরং ইসালিমক প্রাণধর্ম ভারতীয় প্রাণ ধর্মের পাশাপাশি বাস করতে থাকল৷

ইংরেজ শাসকেরা ছিল সুচতুর৷ তারা ভারতীয় প্রাণ ধর্মে আঘাত হানতে কূটনৈতিক পথ অবলম্বন করলো৷ তারা নিজেদের দেশের অনুকরণে শিক্ষা পদ্ধতির প্রবর্তন করলেন, ফলে এদেশের মানুষ নিজেদের স্বকীয় বৈশিষ্ট্য ভুলে গিয়ে সম্পূর্ণ পাশ্চাত্ত্য মনোভাবপন্ন হয়ে পড়ল৷ ভারতীয় শিক্ষা পদ্ধতি এদেশের ছাত্রদের মনে ধর্মীয়, নৈতিক ও সামাজিক যে সমস্ত গুণাবলীর বিকাশ ঘটাতো, তা বন্ধ হয়ে গেল৷ বরং পাশ্চাত্যের জড়বাদী সভ্যতার মোহে অন্ধ হয়ে এদেশের যুব সমাজও হয়ে উঠলো সন্দেহবাদী, জড়বাদী ও নাস্তিক৷

             (এরপর পরবর্তী সংখ্যা)