ভৌতিক সম্পদ সঞ্চয় প্রসঙ্গে প্রাউটের নীতি

লেখক
পত্রিকা প্রিতিনিধি

বাংলায় প্রবাদ আছে– ‘জীব দিয়েছেন যিনি–আহার দেবেন তিনি’ সৃষ্টিকর্তা অফুরন্ত সম্পদে ভারে দিয়েছেন প্রাকৃতিকে৷ তাই প্রতিটি মানুষের জীবন ধারণের নূ্যনতম প্রয়োজন–অন্ন, বস্ত্র, শিক্ষা, চিকিৎসা ও বাসস্থানের অভাব থাকার কথা নয়৷ কিন্তু প্রাকৃতিক সম্পদের যথার্ত উপযোগ গ্রহণ না করা ও এক শ্রেণীর মুনাফাখোর ধনকুবেরদের সীমাহীন সঞ্চয়ের লোভ পৃথিবীতে ধনবৈষম্য সৃষ্টি করেছে৷ তাই একদিকে যেমন আজও অনাহারে অ–চিকিৎসায় মানুষ মারা যাচ্ছে, অপরদিকে মুষ্টিমেয় কিছু ধনকুবের অগাধ সম্পদ সঞ্চয় করে ভোগ–লালসায় উশৃঙ্খল জীবন–যাপন করে ধনবৈষম্য সৃষ্টি করছে ও সমাজকে দুষিত করছে৷

যেহেতু সঞ্চয়ই কৃত্তিম অভাব ও ধনবৈষম্য সৃষ্টি করছে তাই প্রাউট ব্যষ্টির সঞ্চয়ের ওপর নিয়ন্ত্রণের পক্ষপাতি৷ তাই প্রাউটের উপযোগ নীতির প্রথম সিদ্ধান্তেই বল হয়েছে–

কোনো ব্যষ্টিই সমবায়িক সংস্থার ন্তুপ্সপ্তপ্তন্দ্বন্তুব্ ত্ব্প্সস্তুম্ভগ্গ সুস্পষ্ট অনুমোদন ছাড়া ভৌতিক সম্পদ সঞ্চয় করতে পারবে না৷

ভৌতিক সম্পদ মানে ধান, চাল, টাকা–পয়সা প্রভৃতি যে সমস্ত স্থূল জাগতিক আমরা পঞ্চেন্দ্রিয়ের সাহায্যে অনুভব করি৷ অর্থাৎ এখানে মানসিক সম্পদ বা আধ্যাত্মিক সম্পদের কথা বলা হচ্ছে না৷

জগতের স্থূল জাগতিক সম্পদ (পাঞ্চভৌতিক সম্পদ) সীমিত৷ কারণ পৃথিবীটাই তো সীমিত, তাই পার্থিব সম্পদ তো সীমিত হতে বাধ্য৷ কিন্তু মানুষের অভাব (এখানে মনের অভাব বোধের কথা বলা হচ্ছে) অসীম৷ মানেুষর চাওয়ার শেষ নেই৷ তাই মানুষ চায়, যে কোনো সম্পদ যত পারবে সঞ্চয় করে তার মনের আকাঙক্ষা মেটাতে৷

যেমন, ধরা যাক, কোথাও ২০ খানা রুটি আছে ও ১০ জন মানুষ আছে৷ সেক্ষেত্রে গড়ে প্রত্যেককে ২টো করে  রুটি দেওয়া সম্ভব হবে৷ এক্ষেত্রে কেউ অসুস্থতার জন্যে ২টো রুটি  না খেলে সেক্ষেত্রে যার ক্ষুধা বেশি তাকে ৪টে রুটি দেওয়া যেতে পারে৷ কিন্তু কেউ যদি গায়ের জোর বা কূটবুদ্ধির জোরে সবগুলো রুটি নিজের কুক্ষিগত করে নেয়, তাহলে বাকীরা তো খেতেই পাবে না৷ এটা মোটেই ন্যায়সঙ্গত হবে না৷

সমাজ মানে সবাইকে নিয়ে একসঙ্গে চলা৷ সেক্ষেত্রে জনসাধারণকে বঞ্চিত করে মুষ্টিমেয় কয়েকজন সমাজের সম্পদ প্রয়োজনাতিরিক্ত ভাবে সঞ্চয় করবে, তা তো মোটেই মেনে নেওয়া যায় না৷

আর একটা কথা, মানুষ প্রকৃতপক্ষে বিশ্বের কোনো সম্পদের প্রকৃত মালিকানার দাবী করতে পারে না৷ মানুষ বলতে পারে না, আমার বুদ্ধির জোরে আমি যত ইচ্ছা সম্পদ  সঞ্চয় করব, আমি আমার ইচ্ছামত এই সম্পদের ব্যবহার করব, তাতে কার কী বলার আছে৷ এসব তো আমার৷ আমি এর মালিক৷

প্রাউট–প্রবক্তা বলছেন, মানুষ প্রকৃতপক্ষে বিশ্বের কোনো সম্পদের মালিক নয়৷ এই সমস্ত সম্পদের মালিক একমাত্র বিশ্বস্রষ্টা পরমব্রহ্ম৷ কারণ, মানুষ কোন মৌলিক পদার্থ সৃষ্টি করতে পারে না৷ মানুষ কেবল ঈশ্বরসৃষ্ট মৌলিক পদার্থ নিয়ে তারই সাহায্যে কোনো মিশ্র বা যৌগিক পদার্থ হ্মড়ম্ভব্দন্ন্তুত্রপ্ত্ প্পন্প্রব্ধব্ভব্জন্দ্ব গু ন্তুড়ন্দ্বপ্পন্ন্তুত্রপ্ ন্তুপ্সপ্পহ্মপ্সব্ভুস্ত্ তৈরী করতে পারে৷

তাই জগতের সমস্ত সম্পদের মালিক পরমপিতা পরম ব্রহ্ম৷  পরম পিতার সন্তান হিসেবে এই সম্পদে প্রতিটি মানুষের পৈত্রিক অধিকার রয়েছে৷ মানুষের উচিত মিলেমিশে তাদের পৈত্রিক সম্পত্তির রক্ষণাবেক্ষণ ও ভোগ করা৷ তাই ঈশ্বর সৃষ্ট সম্পদ কেউ বিপুল পরিমাণ সঞ্চয় করে বিলাসিতায় জীবন অতিবাহিত করবে, অন্যেরা অভাবে শুকিয়ে মরবে–তা হতে পারে না৷  তাই এই সমস্ত দিক বিবেচনা করেই প্রাউট–প্রবক্তা ব্যষ্টির অতিমাত্রায় সঞ্চয় নিয়ন্ত্রণ করতে বলেছেন৷

মানুষের নিজের ও নিজের পরিবারের প্রতিপালন ও সামাজিক দায়িত্ব পালনের জন্যে যা আবশ্যক ততটা সম্পদ সংগ্রহ ও সঞ্চয় করার তার অধিকার আছে৷ সেক্ষেত্রে যাতে কারুর অসুবিধা না হয় সেই অনুসারে সঞ্চয়ের একটা সীমা বেঁধে দেওয়া হবে৷ বিশেষ ক্ষেত্রে কঠিন রোগ, দুর্ঘটনা, ছেলেমেয়েদের উচ্চশিক্ষা সরকারী দায়িত্বে থাকবে৷

মানুষ তো এতেও সন্তুষ্ট হতে চায় না৷ আগেই বলেছি, মানব মনস্তত্ত্ব হল, মানুষের অসীম আকাঙক্ষা৷ এক্ষেত্রে, প্রাউট স্পষ্টভাবে বলেছে মানুষের অনন্ত–সীম আকাঙক্ষা সীমিত জাগতিক ভোগ্যবস্তু দিয়ে মেটানো সম্ভব নয়৷ সেক্ষেত্রে মানুষকে তার অন্তরের অখণ্ড অভাব মেটানোর জন্যে মনকে অনন্ত আধ্যাত্মিক  সম্পদ তথা ঈশ্বরের দিকে চালিত করতে হবে৷

এ কারণেই মানুষকে আধ্যাত্মিক শিক্ষা দেওয়া জরুরী৷

এখানে আধ্যাত্মিক শিক্ষা মানে রিলিজিয়ন ভিত্তিক বা সাম্প্রদায়িক ভিত্তিক শিক্ষা নয়৷ প্রাউট–প্রবক্তা আধ্যাত্মিকতা বলতে হিন্দু, মুসলীম, খ্রিষ্টান প্রভৃতি বিভিন্ন ধর্মমতের সংকীর্ণতা বা গোঁড়ামীর কথা বলছেন না৷

প্রাউট–প্রবক্তা বলছেন, সকল মানুষের ধর্ম এক, আর তা হ’ল মানব ধর্ম, মানুষ মানুষ ভাই ভাই৷ আর প্রকৃত আধ্যাত্মিকতা হল, যা পূর্বেই বলেছি, মনকে ক্রমশঃ পরিশুদ্ধ করে আত্মার সঙ্গে মনের মিলন৷ আত্মা অনন্ত চৈতন্য প্রবাহ, (‘আনন্দধারা বহিছে ভূবনে’)৷ মানুষের অনন্ত আকাঙক্ষা কেবল মিটতে পারে অনন্ত আধ্যাত্মিক সম্পদের সঙ্গে মনের সংযোগ ঘটিয়ে৷ মনের সঙ্গে আত্মার এই সংযোগের নামই ‘যোগ’৷ এই আধ্যাত্মিক অনুশীলন মানুষের মনের মধ্যে নৈতিক দৃঢ়তা আনে, মনকে ক্ষুদ্র স্বার্থের ঊর্ধ্বে উঠিয়ে বিশ্বমুখী করে তোলে৷

তাই মানুষের মধ্যে অতিরিক্ত ধনসঞ্চয়ের বাসনা প্রশমিত করা যাবে প্রকৃত আধ্যাত্মিক শিক্ষার দ্বারা৷ যদি কেউ আধ্যাত্মিক শিক্ষাকে উপেক্ষা করে ধনসঞ্চয়ের নেশায় মেতে উঠতে চায়, তাহলে বুঝতে হবে সে মানসিক রোগগ্রস্ত৷ সেক্ষেত্রে এই রোগ সারানোর জন্যে ব্যবস্থা করতে হবে৷ মোট কথা মানুষের হূদয়ের পরিবর্তনের প্রয়াসের সঙ্গে সঙ্গে বাহ্যিক চাপ – অর্থাৎ পর্যাপ্ত আইনগত চাপও রাখতে হবে৷

এখানে যে ‘সামবায়িক সংস্থা’র কথা বলা হয়েছে, তা হ’ল নীতিবাদীদের দ্বারা গঠিত (প্রাউটে যাদের ‘সদবিপ্র’ বলা হয়েছে) সামাজিক সংস্থা, যাঁরা সমাজের সমস্ত মানুষের স্বার্থে দেশের অর্থনীতি পর্যালোচনা করে সঞ্চয়ের সীমা বেঁধে দেবেন৷

আবার সঙ্গত কারণে কারুর যদি এই সীমার বাইরে কোনো অর্থের নিতন্তই প্রয়োজন হয়, তা বিবেচনা করে, তা সংগ্রহের  জন্যে সামবায়িক সংস্থা অনুমোদন দেবে –এটা প্রাউট স্বীকৃত৷ অর্থাৎ কোনো ব্যাপারে মানুষের যথার্থ প্রয়োজনকে উপেক্ষা করে আইনের েেদাহাই দেওয়ার ক্ষেত্রেও প্রাউট সাবধান করে দিচ্ছে৷  আর একটা কথা, এই নীতি ভৌতিক সম্পদের সঞ্চয় নিয়ন্ত্রণের কথা বলা হয়েছে, মানসিক বা আধ্যাত্মিক সম্পদ নয়৷ মানসিক বা আধ্যাত্মিক সম্পদ কেউ বেশি সঞ্চয় করলে অন্যের কম পড়বে না, বরং তাতে সবাই উপকৃত হবে৷