সম্প্রতি সিংভূম জেলার পটমদা থানার ভূলা–পাবনপুর গ্রামে ও তার পাশেই কমলপুর থানার বাঙ্গুরদা গ্রামে ও তার দক্ষিণ–পশ্চিম দিকে চাণ্ডিল থানার জায়দা গ্রামে জৈন যুগের বেশ কিছু নিদর্শন পাওয়া গেছে৷ তার সঙ্গে পাওয়া গেছে সেই যুগের বেশ কিছু বাংলা লিপি৷ এই লিপি অবশ্যই ১৭০০ বছর বা তার চেয়েও কিছু অধিক পুরোনো কারণ ওই সময়টাতেই রাঢ়ে শৈবাশ্রয়ী জৈনধর্মের স্বর্ণযুগ গেছে৷ ভগ্ণ মূর্তিগুলিও সমস্তই দিগম্বর জৈন দেবতাদের৷ যে লিপিমালা পাওয়া গেছে তা শুশুনিয়া লিপির চেয়ে পুরোনো তো বটেই, হর্ষবর্দ্ধনের শীলমোহরে প্রাপ্ত শ্রীহর্ষ লিপির চেয়েও পুরোনো হতে পারে৷ এই লিপি শ্রীহর্ষ লিপির স্বগোত্রীয় কিন্তু শ্রীহর্ষের চেয়েও বেশ পুরোনো৷ হতে পারে, এই লিপি ক্ষ্রাহ্মী থেকে এসেছে অথবা এমনও হতে পারে যে এই লিপি ক্ষ্রাহ্মী লিপি থেকে আসে নি–এই লিপি পূর্ব ভারতের নিজস্ব লিপি৷
অশোকের সময় রাা মগধ সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল৷ রাজা শশাঙ্কের তিরোধানের পরেও রাা থান্বীশ্বর রাজবংশের (হর্ষবর্দ্ধনের) অঙ্গীভূত ছিল৷ কিন্তু এর মানে এই নয় যে হর্ষবর্দ্ধনের শীলমোহরে যে ধরনের শ্রীহর্ষ লিপি পাওয়া গেছে তা প্রত্যন্ত রাজ্য রাঢ়েও প্রচলিত ছিল৷ অবশ্যই অনুমান করা যেতে পারে, রাঢ়ের লিপি শ্রীহর্ষ লিপির স্বগোত্রীয় হলেও তার থেকেও প্রাচীন৷ অশোক তাঁর শিলালিপিতে ক্ষ্রাহ্মী লিপি ব্যবহার করেছেন কিন্তু ক্ষ্রাহ্মী লিপিতে উৎকীর্ণ অশোকের একটিও শিলালিপি রাঢ়ে পাওয়া যায় না৷ রাা অশোকের শাসনাধীনে ছিল....রাঢ়ে পাহাড়–পর্বতের অভাব নেই যে সেখানে পাথরের অভাব হবে...রাঢ়ে স্থানীয় প্রস্তরে নির্মিত অনেক ভাঙ্গা মুূর্ত্তিও পাওয়া গেছে৷ তবু কেন অশোক রাঢ়ে কোন ধর্মশাসন চিহ্ণিত স্তম্ভ নির্মাণ করান নি? এতে দৃৃভাবে দু’টি অনুমান আমাদের সামনে এসে যায়৷ একটি হচ্ছে, অশোকের সময় রাা ক্ষ্রাহ্মী লিপির ব্যবহার ক্ষন্ধ করে দিয়ে নিজস্ব লিপির প্রবর্তন করেছিল ও তার ব্যবহারও শুরু করেছিল৷ তাই অশোক সেখানে আর ক্ষ্রাহ্মীলিপির ব্যবহার করেন নি৷ দ্বিতীয়টি হচ্ছে, রাঢ়ে মগধের মত ক্ষৌদ্ধধর্মের প্রাক্ষল্য অশোকের সময় ছিল না ও তার পরেও হয়নি৷ রাঢ়ে চলেছিল জৈন প্রভাব৷ তাই ক্ষৌদ্ধধর্মের ধর্মশাসন রাঢ়ের প্রস্তরগাত্রে উৎকীর্ণ করা হয়নি৷ ভুলা–পাবনপুর–বাঙ্গ্ গ্রামগুলিতে প্রাপ্ত লিপি রাঢ়ে সেই শৈবাশ্রয়ী জৈনধর্মের স্বর্ণযুগের ধ্বংসাশেষ৷ এ থেকে আমরা সিদ্ধান্তে পৌঁছুতে পারি, বাংলা লিপি বেশী না হোক অন্ততঃ ১৭০০ বছরের পুরোনো৷ এই আবিষ্কারের পর বাংলা লিপি যে ১১০০ বছরের পুরোনো নয়, তার থেকে অনেক বেশী পুরোনো ও বর্তমান ভারতীয় লিপিগুলির মধ্যে সর্ব পুরাতন তাতে কোন সংশয় থাকছে না৷ যে লিপিকে শ্রীহর্ষ লিপি নাম দেওয়া হয়ে থাকে ও যাকে সর্বপ্রাচীন বলে বাংলা অক্ষরকে শ্রীহর্ষ নামে অভিহিত করা হয়ে থাকে, এই আবিষ্কারের পরে সেই শ্রীহর্ষ লিপি কিছুটা অর্বাচীন বলে প্রমাণিত হচ্ছে৷ অর্থাৎ এই অবস্থায় আর বাংলা লিপিকে শ্রীহর্ষ লিপি বলে চালানো সম্ভব হবে না, কেননা বাংলা লিপি শ্রীহর্ষ লিপির স্বগোত্রীয় হলেও তার চেয়ে অনেক পুরোনো৷
এই লিপিগুলো সব কটিই পাওয়া গেছে পশ্চিম রাঢ়ের দালমা পাহাড় (বিন্ধ্য পর্বতেরা দক্ষিণ–পূর্ব শাখা যা পশ্চিম রাঢ়ের শবরভূমে এসে শেষ হয়েছে) ঘেরা বিভিন্ন নদী–উপত্যকায়৷ তাই আমার মতে এর নামকরণ হওয়া উচিত ‘দালমা লিপি’৷ এই দালমা লিপি ক্ষ্রাহ্মী লিপি সঞ্জাত কিনা সে বিষয়ে গবেষণার যথেষ্ট অবকাশ রয়েছে৷ অর্থাৎ বাংলা ভাষা লিখিত হয়েছে শ্রীহর্ষতে নয়, শ্রীহর্ষেরই স্বগোত্রীয় কিন্তু প্রাচীনতর দালমা লিপিতে৷
এতক্ষণ ‘অ’ নিয়ে আলোচনা চলছিল৷ বাংলা ‘অ’ অক্ষরটির সঙ্গে ক্ষ্রাহ্মী ‘অ’ অক্ষরটির কিছুটা সম্পর্ক রয়েছে৷ শ্রীহর্ষ লিপির ‘অ’ অক্ষরের সঙ্গেও বেশ ভাল সম্পর্ক রয়েছে৷ আসলে এটি দালমা লিপিরই ‘অ’ অক্ষরের আধুনিকতম রূপ ৷*
(‘‘বর্ণবিচিত্রা’’ দ্বিতীয় খণ্ড থেকে গৃহীত৷–সম্পাদক৷)