ধর্মমতের বিভেদ ভুলে মানুষ মানবধর্মে প্রতিষ্ঠিত হোক

লেখক
আচার্য মন্ত্রসিদ্ধানন্দ অবধূত

বর্তমানে ধর্মের নামে নানান ধরণের গোঁড়ামী, জাত–পাতের ভেদ ও সাম্প্রদায়িক বিভেদ ও বিদ্বেষ চলছে৷ অন্ধবিশ্বাস আর কুসংস্কারের জালে জড়িয়ে আঁতুড় ঘর থেকে শশ্মানঘাট পর্যন্ত শোষনের জাল বোনা হয়েছে৷ অপ্রয়োজনীয় সামাজিক আচরণের বোঝাকে ধর্মের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ বলে বলা হচ্ছে৷ তা কিন্তু  মোটেই ঠিক নয়৷

মহাসম্ভূতি শ্রীশ্রীআনন্দমূর্ত্তি সুস্পষ্ট ভাবে দেখিয়েছেন, এই সব জাত–পাত–সম্প্রদায় সঙ্গে বা অন্ধবিশ্বাস বা কুসংস্কারের সঙ্গে প্রকৃত ধর্মের কোনোমাত্র সম্পর্ক নেই৷ ইংরেজীতে যাকে ‘রেলিজন’ ত্মন্দ্বপ্তন্ন্ধন্প্সুগ্গ্ বলে, ধর্ম তা নয়৷ ধর্মের ঠিক ইংরেজী প্রতিশব্দ নেই৷ তবে ‘ধর্মে’র জন্যে ইংরেজী ব্দহ্মন্ব্জন্ব্ধব্ভ্ত্রপ্ (আধ্যাত্মিকতা) শব্দটি ব্যবহার করা যেতে পারে৷ শ্রীশ্রীআনন্দমূর্ত্তিজী ধর্মের প্রকৃত স্বরূপ কী–তা সুস্পষ্ট ভাবে মানুষের সামনে তুলে ধরেছেন, যা বুঝলে ধর্মের প্রতি আজ মানুষের কোনোপ্রকার বিদ্বেষ বা নাসিকাকুঞ্চন ভাব থাকবে না৷ শ্রীশ্রীআনন্দমূর্ত্তিজী ধর্মের ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে বলেছেন, ‘ধৃ’ ধাতুর উত্তর মন্ প্রত্যয় করে ‘ধর্ম’ শব্দের উৎপত্তি৷ তাই ধর্ম মানে হ’ল, প্রতিটি সত্তা এমন কিছু বিশেষ গুণ বা বৈশিষ্ট্য ধারণ করে রেখেছে যা সেই সত্তার পরিচিতি বহন করছে৷ আগুনের ধর্ম দহন করা, অর্থাৎ দহন করার এই যে ক্ষমতা–এই বিশেষ বৈশিষ্ট্যই আগুনকে চিনিয়ে দিচ্ছে৷ দহন করার এই ক্ষমতা না থাকলে, তাকে আগুন বলা যাবে না৷ তাই আগুনের ধর্ম দাহিকাশক্তি বা সহজ কথায় ‘দহন করা’৷ জলের ধর্ম ‘ভিজিয়ে দেওয়া’, অর্থাৎ জলের প্রধান বৈশিষ্ট্য হ’ল ভিজিয়ে দেওয়া৷ চিনির ধর্ম মিষ্টত্ব৷ মিষ্টত্ব না থাকলে তা চিনির মত দেখতে হলেও তাকে চিনি বলা যাবে না৷ তাই চিনির ধর্ম মিষ্টত্ব৷ এখন, আমরা যে  শুরুতেই ‘ধর্ম’ সম্পর্কে আলোচনার সূত্রপাত করেছি, প্রকৃতপক্ষে আমরা কার ধর্মের কথা বলতে চাই? মানুষের ধর্ম৷ সমাজ বলতে সাধারণভাবে যেমন বোঝাই মানুষের সমাজকে, তেমনি আমাদের যে আলোচ্য বিষয় ‘ধর্ম’–তা হ’ল মানুষের ধর্ম৷ ধর্মের শব্দের অর্থ বোঝাতে গিয়েই আগুনের ধর্ম, জলের ধর্ম, চিনির ধর্ম–এই প্রসঙ্গগুলো তোলা হ’ল৷ এখন মানুষের ধর্ম কী? মানুষের ধর্ম তাকেই বোঝাবে–যা মানুষের স্বকীয় বৈশিষ্ট্য ব্দন্দ্বপ্তন্দ্র ন্তুড়্ত্রব্জ্ত্রন্তুব্ধন্দ্ বা হ্মব্জপ্সহ্মন্দ্বব্জব্ যা অন্যান্য জীবের নেই৷ এই যে ‘ধর্ম’ বা সত্তাগত বৈশিষ্ট্য–একে চেনা যায় কেমন করে?–মানুষের আচরণ বিশ্লেষণ করলেই তা বোঝা যাবে৷

প্রতিটি মানুষের মধ্যেই অভাব রয়েছে৷ আর এই অভাবের শেষ নেই৷ এই অভাব মেটানোর জন্যে সে অনবরত কিছু না কিছু করে চলেছে৷ অভাব মেটানোর তাগিদই হচ্ছে আকাঙক্ষা৷ জীব মাত্রেরই সাধারণ বৈশিষ্ট্য বা জৈব ধর্ম হ’ল–আহার, নিদ্রা, ভয় ও বংশবৃদ্ধির আকাঙক্ষা৷ মানুষের আকাঙক্ষা কিন্তু এই গণ্ডির মধ্যে আবদ্ধ নয়৷ মানুষ অন্যান্য জীবের মত কেবল আহার, নিদ্রা, ভয় ও বংশবৃদ্ধির চৌহদ্দির মধ্যে সন্তুষ্ট থাকতে চায় না৷ সে আরও চায়–তার চাওয়ার শেষ নেই৷ রবীন্দ্রনাথের ভাষায়, ‘‘আমি যাহা চাই তাহা ভুল করে চাই, যাহা পাই তাহা চাই না৷’’ মানুষের চাহিদা অনন্ত–অশেষ৷

অন্যান্য জীবজন্তুর দৈহিক অভাব মিটলেই হ’ল৷ তার আর কিছু চাহিদা থাকে না৷ কিন্তু মানুষের দেহের অভাব বা দেহের ক্ষুধা মিটলেও মনের অসীম ক্ষুধা থেকে যায়–যা কোনো সীমিত বস্তুতে মেটে না৷ মানুষ জাগতিক সম্পদ যতই লাভ করুক না কেন তার এই অভাব মেটে না৷ তার কারণ হ’ল এই যে, জগৎটা সীমিত৷ সীমিত জাগতিক ভোগ্যবস্তুর সহায্যে অসীম অভাব মিটতে পারে না৷ তাহলে অসীম অভাব বা অসীম আকাঙক্ষা মিটবে কেমন করে? অসীম আকাঙক্ষা তো কেবলমাত্র অসীম কছু পেলেই মিটতে পারে৷ আর ‘ব্রহ্ম’ ছাড়া কোনো কিছুই অসীম নয়৷ জাগতিক ভোগ্যবস্তুর একটা সীমা আছে৷ ‘ব্রহ্ম’ কথাটির মানেই হ’ল, ‘বৃহত্বাদ্ ব্রহ্ম’–ব্রহ্ম হ’ল তা–ই যা বৃহৎ৷ সংস্কৃতে দু’টো শব্দ আছে–বিশাল ও বৃহৎ৷ যা বিশাল তা যতই বড় হোক না কেন–তার সীমা আছে৷ যেমন পৃথিবী বিশাল, সূর্য বিশাল৷ কিন্তু ‘বৃহৎ’ মানে এত বড় যে তার কোনো সীমা নেই৷ সীমারেখা তাকে বাঁধতে পারে না৷ অর্থাৎ অসীম–নন্ত৷ ব্রহ্মই একমাত্র অসীম–অনাদি অনন্ত চৈতন্য সত্তা৷

সীমিত বস্তু থেকে মানুষ পায় সীমিত সুখ৷ অনন্ত সত্তা–পরমব্রহ্ম থেকে মানুষ পায় অনন্ত সুখ৷ সবাই অভাব মিটিয়ে সুখ পেতে চায়, সীমিত বা অল্প সুখ নয়, অনন্ত সুখ৷ ‘সুখম্ অনন্তম্ আনন্দম্’–অনন্ত সুখকেই দর্শনে বলা হয় আনন্দ৷ প্রতিটি মানুষ সেই আনন্দ–পরম শান্তি পেতে চায়৷ তা একমাত্র ব্রহ্ম থেকেই পাওয়া সম্ভব৷ তাই শ্রীশ্রীআনন্দমূর্ত্তিজী বলেছেন, ‘‘বৃহদেষণা প্রণিধানঞ্চ ধর্ম’’ (আনন্দসূত্রম্)–‘‘জ্ঞাতসারে হোক্ আর অজ্ঞাতসারেই হোক, মানুষ অনন্তের পানে জুটে চলেছে৷ মানুষ যখন জ্ঞাতসারে এই বৃহৎকে পাবার চেষ্টা করে ও তজ্জন্য ঈশ্বর প্রণিধান করে তখন তার সেই ভাবের নাম ধর্ম ও সেই প্রচেষ্টার নাম ধর্ম সাধনা৷’’

বিশ্বের সমস্ত আগুনের যেমন এক ধর্ম, সমস্ত জলের যেমন এক ধর্ম, তেমনি বিশ্বের সমস্ত মানুষেরও এক ধর্ম৷ তাই আনন্দমার্গ বলে, সকল মানুষের ধর্ম এক, আর তা হ’ল মানবধর্ম৷ তাই অনেক ধর্মের কোনো প্রশ্ণ ওঠে না৷ ‘রেলিজন’ বা ‘ধর্মমত’ বা ‘উপধর্মে’র সংখ্যা অনেক হতে পারে, কিন্তু ধর্ম সকল মানুষেরই এক৷ ‘রেলিজন’ নানান্ অন্ধবিশ্বাস ভিত্তিক আচার অনুষ্ঠানের সমষ্টি৷ তাই বিভেদমূলক রেলিজনকে নয়, যথার্থ ধর্মকেই আনন্দমার্গ উৎসাহ দেয়৷ আনন্দমার্গ চায়, সংকীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গী ভুলে মানুষ এই এক মানবধর্মে উদ্বুদ্ধ হোক৷ অন্ধবিশ্বাস বা কুসংস্কার থেকে মুক্ত হয়ে মানুষ যুক্তি ও বিজ্ঞানসম্মত পথ ধরে এগিয়ে চলুক৷ জাত–পাত–সম্প্রদায়ে সংকীর্ণ গণ্ডী অতিক্রম করে মানুষ সর্বপ্রকার কুসংস্কারমুক্ত মানবধর্মের আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে বিশ্বৈকতাবাদে প্রতিষ্ঠিত হোক৷