এবার বাঙলা জাগবে

লেখক
আচার্য মন্ত্রসিদ্ধানন্দ অবধূত

ছোটবেলায় মুখে মুখে শুনতাম ‘বর্গী এলো দেশে’৷ এই বর্গীরা কারা ও  তাদের বাঙলায় আসার কারণটি কী? সে প্রায় ২৮০ বছর আগের কথা৷ এই বর্গীরা ছিল পশ্চিম ভারতীয়, তৎকালীন মারাঠা রাজ্যের৷ এই বর্গীদের সর্দার মারাঠা দস্যু ভাস্কর পণ্ডিত নামে পরিচিত৷ মূলত তাঁরা সম্পদ ও নারী লুট করতো, এক কথায় তাদের আমরা লুটেরা বলতাম৷  এদেরকে  সাহায্য করতেন একশ্রেণীর অর্থ পিশাচ মীরজাফর অথবা রাজাকার বাঙালী, যারা জাতির কলঙ্ক--- বাঙালী জাতির বিশ্বাসঘাতকের দল৷ বাঙালীস্থান অতীতে ছিলো এখনো আছে সুজলা সুফলা শস্য শ্যামলার দেশ৷ তাই কবি বলেছিলেন---

‘এমন দেশটি কোথায় খুঁজে পাবে নাকো তুমি,

সকল দেশের রাণী সে-যে আমার জন্মভূমি৷’

কবি এখানে আমার জন্মভূমি বলতে বাঙালীস্তানের কথাই বলেছেন৷ তাই ভারতবর্ষে বাঙালীস্তানের বাঙালীদের ওপর বারবার  এই বর্গীরা আঘাত করেছে৷ কিন্তু বাঙলার সম্পদের ভাণ্ডার কখনো শেষ করতে পারেনি৷ আধুনিক সমাজবিজ্ঞানী তাদের সমাজশাস্ত্র লিখতে গিয়ে বলেছেন একটি জাতিসত্তাকে পৃথিবী থকে বিলুপ্ত করতে হলে সেই জাতির প্রথমে অর্থনৈতিক মেরুদণ্ড ভেঙে দেওয়া, তাঁরা যেন দাঁড়িয়ে প্রতিবাদ করে না৷ দ্বিতীয় ধাপে ভাষা সংস্কৃতি ও শিক্ষা তথা নৈতিকতার  উৎসের শেকড় উঠিয়ে ফেলতে হবে৷ এতেও কাজ না হলে  নিজেদের  মধ্যে জাতিদাঙ্গা ক্রমান্বয়ে বাধিয়ে রাখতে পারলেই সেই জাতিটার জাতীয়তাবোধ লুপ্ত হবে ও জাতীয় একতা ভেঙে যাবে৷ তখন সেই জাতিকে চরমভাবে শোষণ করা যাবে৷ আজও সেই পশ্চিমী বর্গীরা বৈশ্যরা শোষকের রূপ ধরে বাঙলাকে লুন্ঠন করছে ধনে প্রাণে৷  বর্তমান যুগের আধুনিক বর্গীরা বাঙালীর উন্নত আধ্যাত্মিক ও মানসিক চেতনাকে শেষ করা সহজ নয় ভেবেই তাঁরা তাদের রূপ-রং পাল্টে নতুনভাবে আমাদের সামনে এসেছে৷ সম্পদের শোষণের সঙ্গে সঙ্গে তাঁরা বাঙালীকে মানসিক দিক দিয়ে দুর্বল করতে ও নৈতিক মেরুদণ্ড ভাঙতে ধর্মীয় মতবাদের  আড়ালে বাঙালীর সহজাত আধ্যাত্মিকতা তথা অন্তর নিহিত ধর্মবোধের ও সাধনার ওপর চরম আঘাত করতে শুরু করেছে৷

আমরা দেখেছি এই বর্গীরা ব্রিটিশ আমলে বাঙলার বিপ্লবীদের ইংরেজ শাসকদের কাছে ধরিয়ে দিতো৷ সেই সময়ের কমিউনিষ্ট, আর.এস.এস আর কংগ্রেস বাঙালী মীরজাফরের ভূমিকায় থেকে বর্গীদের সাহায্য করেছে ও তারা ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের দালালি করেছে৷ আজ সেই মীরজাফররা ওই পশ্চিমী বর্গী হিন্দি সাম্রাজ্যবাদের দালালি করছে বাঙালীর মেরুদণ্ড ভেঙে দিতে৷ এই বর্গীরা বাঙলার দামাল মনস্তাত্ত্বিকের ওপর বার বার আঘাত হেনেছে৷ ভারতের স্বাধীনতায় যে বাঙালীরা রক্ত বেশী ঝরালো সেই বাঙালীদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে গিয়ে বাঙলা ভাগ করলো৷ ওই বর্গীরা আজ বলছে বাঙালীরা উদ্বাস্তু, বহিরাগত, অনুপ্রবেশকারী অথবা ঘুসপেটিয়া ইত্যাদি৷ ভারতের স্বাধীনতার ৭৫ বছর পরেও যে বাঙালীদের ভোটে কতগুলো কেন্দ্রে ও রাজ্যে সরকার ঘটন হয়ে ছিলো আজ সেই বাঙালীকেই প্রমাণ করতে হবে তাঁরা ভারতের নাগরিক কিনা! বর্তমান বর্গী বিজেপি সরকার আজ উঠে পড়ে লেগেছে সারা ভারতে কয়েককোটি বাঙালীকে বিদেশী বানাতে৷ কয়েক দিন আগে বিজেপি নামধারী এক বর্গীনেতা বাঙলার মতুয়া বা নমশূদ্রদের বলেছেন আপনাদের নাগরিকত্ত্ব না থাকলেও আমরা বঙ্গ জয় করলেই মতুয়ারা নাগরিকত্ত্ব পেয়ে যাবেন৷ যেমন বলে ছিলো অসমের গত বিধানসভার নির্বাচনের আগে৷ এই ধোঁকাবাজ বর্গীদের কথায় আজ কয়েক লক্ষ বাঙালী সবকিছু থেকেও ডিটেনশন ক্যাম্পে বন্দী বা নাগরিক হওয়ার জন্য দরজায় দরজায় ভিখিরির মত ঘুরে বেড়াচ্ছে৷  ভোটের আগে তাঁরা নাগরিক আর ভোট পেরিয়ে গেলে তাঁরা বহিরাগত, এ আবার কেমন তর কথা৷ আগামীতে বাঙলায় আরো কিছু ভিখারি বাঙালী তৈরী করতে চলেছে তারা৷ সাবধান বাঙালী সাবধান৷

বাঙলায় ওই বর্গীরা রাম রাজত্ব ও গুজরাট বানাবেন৷ যে গুজরাটে বহিরাগত অতিথি এলে উন্নয়ন ঢাকতে লজ্জায় পাঁচিল তুলতে হয়৷ বলুনতো সারা ভারতে যতগুলো বিজেপি রাজ্য আছে সেখানে অবশ্যই রামরাজত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়েছে? সাধারণ মানুষের অর্থনৈতিক মানে খুবই উন্নত, জিনিসপত্র দাম সাধারণ মানুষের ক্রয় ক্ষমতার মধ্যে ও আইনি ব্যবস্থা, শান্তিশৃঙ্খলায় সুস্থভাবেই চলছে, অথবা শান্তির পরিবেশ বিরাজমান? নিম্নবর্গের মানুষের ওপর কোনো প্রকারের নির্যাতন অথবা সরকারি সুযোগের নামে কাটমানি, বলপূর্বক জমি দখল কোন কিছুই চলছে না ইত্যাদি ইত্যাদি৷ এগুলো মনগড়া কিছু কথামাত্র, রাম রাজত্ব বলে পৃথিবীতে কিছু ছিলো না আজও নেই৷ বর্গীরা শোষণের তাগিদে  রূপ পালটেছে, কিন্তু শোষণ ও লুটপাটের মানসিকতা পালটায়নি৷

বাঙলা কেন বিজেপি বর্গীদের প্রয়োজন৷ হিন্দি সাম্রাজ্যবাদী বর্গীরা জানে বাঙালী ও বাঙলাকে যতই ঘৃণার চোখে দেখুক না কেন তাঁরা জানে সারা বিশ্বের দরবারে বাংলা ভাষার মাধুর্য, উন্নত সংস্কৃতি, আচার আচরণ,সাহিত্য,শিল্পকলা,মেধা,মননশীলতা, উন্নত চিন্তাভাবনা, বৈপ্লবিক চেতনা, পরিবর্তনশীল মানসিকতা, পরোপকারী মানসিকতা ও বাঙলা মায়ের গর্ভে লুকিয়ে থাকা দেশের জন্য বৃহৎ ত্যাগের ভাবনা৷ সাহিত্যে ও অর্থনীতি ছাড়াও নানা বিষয়ে নোবেলজয়ে বাঙালীরাই প্রথম যাহা ভারতের সকলের কাছে ঈর্ষার কারণ৷ দার্শনিক মাননীয় গোখলে বঙ্গভাষী না হয়েও বলেছেন বাঙলা আজ যাহা ভাবে ভারতীয়রা কাল তা ভাববে৷ তাই ভারতবর্ষে বাঙালীর নৈতিক, মানবিক জাতীয়তাবোধ ও জাতিসত্তার  ওপর আঘাত হানতে কিছু বাঙালী মীরজাফরদের নিয়ে টাকার মাধ্যমে বাঙলাকে জয় করার নেশায় মেতে উঠেছে পশ্চিমী বর্গীরা৷ কবির ভাষায় ‘মনন্তরে মরিনি আমরা মারি নিয়ে ঘর করি৷ আগামীতে মহান দার্শনিক শ্রীপ্রভাতরঞ্জন সরকারের সামাজিক অর্থনৈতিক দর্শন ‘‘প্রাউটের’ আলোকে উদ্ভাসিত হয়ে সে প্রমাণ করবে, অতীতে বাঙালী জাতি জীবিত ছিলো, বর্তমানে আছে ভবিষ্যতে দুরন্ত গতীতে জীবিত থাকবে৷

বর্গীদের সেই দশা হবে যা আলীবর্দী খাঁ করেছিলেন বর্গী দস্যু ভাস্কর পণ্ডিতকে৷ বাঙলা আবার মাথা তুলে দাঁড়াবেই৷