অঙ্কের জগতে ‘১‘ এমন এক আশ্চর্যজনক আবিষ্কার যা চলার পথে মানব মন অজস্র জ্ঞান–বহুল অভিপ্রকাশকে জানাতে সক্ষম৷ আজকের আলোচ্য বিষয় এই ‘এক’–এর বহুবিধ অভিপ্রকাশকে নিয়েই৷
পরমপুরুষকে বলা হয়–তিনি এক ও অদ্বিতীয়, অর্থাৎ ‘একমেবাদ্বিতীয়ম’৷
(১) এ পর্যন্ত গণিতের অজস্র .....অগুনিত সংখ্যা আবিষৃকত হয়েছে৷ তা সত্ত্বেও পরমপুরুষের জন্যে আমরা ‘এক’ সংখ্যাটা ব্যবহার করি কেন এই যে আমরা ১,২,৩,৪ ইত্যাদি যে কোন সংখ্যা, এমনকি ‘অনন্ত’ ব্যবহার করি না কেন, এই সব সংখ্যাই, মনের এক এক ধরণের অঙ্কগত প্রক্ষেপ মাত্র৷ তাহলে পরমপুরুষের জন্যে আমরা ‘এক’, এই সংখ্যা ব্যবহার করি কেন কেন তিনি একমেবাদ্বিতীয়ম্৷ প্রকৃতপক্ষে পরমপুরুষের জন্যে কোন সংখ্যাই ব্যবহূত হতে পারে না৷ কারণ তিনি অনন্ত, অসীম৷ এই অসীম, অনন্ত সত্তাকে কোন সংখ্যা দিয়ে অভিহিত করা যায় না৷ যদি ব্যবহার করি তবে সেটা একটা শব্দ সম্ভারের আওতার মধ্যে এসে যায়৷ ১,২,৩–––––,১০, ১১, ১২, ..... ১০০,.... প্রভৃতি যে কোন সংখ্যাই ব্যবহার করা হোক না কেন, তা একটা শব্দ সম্ভারের সীমিত তত্বের বন্ধনের মধ্যে এসে যায়৷ তা সত্ত্বেও ‘এক’, সংখ্যা দিয়ে পরমপুরুষকে অভিহিত করি৷ বলি পরমপুরুষ এক ও অদ্বিতীয়৷ কিন্তু প্রশ্ণ ওঠে কেন
মানুষের মন যখন কুশাগ্র হয়ে পড়ে, তখন সেটা বিন্দুস্থ হয়ে যায় অর্থাৎ সেটা একটা ছোট্ট বিন্দুতে পর্যবসিত হয়৷ সে অবস্থায়, জীব পরমপুরুষের সঙ্গে মিলেমিশে এক হয়ে যায়৷ জীব তখন শিবত্বে মিশে গিয়ে এক হয়ে যায়৷ এই কারণেই ‘এক’ সংখ্যাটি ব্যবহূত হয়৷ ‘এক’ সংখ্যাটি ব্যবহার করা ছাড়া কোন বিকল্প নেই৷ এই বিশ্ব সৃষ্টির চরম নিয়ন্ত্রক বা মধ্যমনি হলেন পরমপুরুষ বা পরম–শিব (ন্তুপ্সুব্দন্তুন্প্সব্ভব্)৷ ঠিক তেমনি ভাবেই সমগ্র সংখ্যাজগতের মূল কেন্দ্র বা মধ্যমনি হল ‘এক’৷
এই ‘এক’ (১) হতেই ১,২,৩,৪ প্রভৃতি সংখ্যার উৎপত্তি হয়েছে অর্থাৎ যাকে আমরা বলছি ২, (দুই), আসলে এই ‘দুই’ সংখ্যাটি হ’ল দুটি ১–এর সমবায় মাত্র৷ তাই ঠিক এমনিভাবেই, যাকে ৩ বলা হচ্ছে, তা তিনটি ১–এর সমাহার ছাড়া কিছুই নয়, যত বড় সংখ্যাই হোক না কেন তা কিন্তু আসলে বহু ‘এক’–এর সমবায়৷ তাই বলা যেতে পারে–‘এক’ সংখ্যা অঙ্কশাস্ত্রের মূলকেন্দ্র৷ (২) শিবোপদেশেও ‘এক’ ও শূন্যের উল্লেখ পাওয়া যায়৷
আজ থেকে অনুমানিক সাত হাজার বছর আগে এই ধূলির ধরণীতে প্রাগর্যকুলে সদাশিব মানব শরীরে জন্মগ্রহণ করেছিলেন৷ শিব ছিলেন এক প্রচণ্ড পুরুষ৷ এই শিবই হলেন মানব সভ্যতার জনক৷ মানব মানব কল্যাণের জন্যে তিনি বহু উপদেশ দিয়ে গিয়েছেন৷ তিনি একটি উপদেশে, ‘এক’ ও ‘শূন্য’ ও ‘বিন্দু’র আধ্যাত্মিক সম্পর্ক ও তাৎপর্য উল্লেখ করেছেন৷ এই সম্পর্কে উপদেশে বলেছেন–‘‘একং জ্ঞানং নিত্যমদ্যন্ত শূন্যম......৷’’ অর্থাৎ শিব বলেছেন ‘‘একং জ্ঞানং’’ ও আদ্যন্ত শূন্যম৷’’
আজ থেকে প্রায় সাড়ে তিন হাজার বছর পূর্বে মহর্ষি কপিল তাঁর সাংখ্য দর্শন দিয়েছিলেন৷ আর এই সংখ্যা দর্শনই হ’ল পৃথিবীর আদিমতম দর্শন৷ কিন্তু এই সাংখ্য নামটিই প্রমাণ করে যে, সাংখ্য দর্শন দেওয়ার পূর্ব হতেই মানুষ সংখ্যাতত্ত্ব জানত৷ অর্থাৎ ১,২,৩,৪,৫,৬,৭,৮,৯ জানত৷ আর জানত ‘শূন্য’–এর কথা৷ তারা জানত শূন্য মানে শুধু ‘প্সব্ধড়নুন্ধ’ নয়, ‘শূন্য’–এর মূল্য আছে৷ কোন সংখ্যার গায়ে শূন্য বসিয়ে গেলে প্রতিটি শূন্যের জন্যে সংখ্যাটির মূল্যমান দশগুন করে বেড়ে চলে৷ এই ধারণার উপর ভিত্তি করেই পরবর্তীকালে দশমিক ভগ্ণাংশের আবিষ্কার হয়েছিল৷ মানসতাত্ত্বিক দিক দিয়ে বিচার করলে দেখা যাবে, শূন্যের পরেই বেশী মূল্য বহন করে ‘এক’ প্সুন্দ্বগ্গ৷মানুষের মন চতুর্দিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে বিভিন্ন দিকে বিচ্ছুরিত হয়ে থাকে৷ আর এই বিচ্ছুরিত মনকে যখন বিশেষ বিন্দুতে অথবা বিশেষ ভাবনায় নিবিষ্ট ন্তুপ্সুন্তুন্দ্বুব্ধব্জ্ত্র্ করা হয়, তখন মানস তাত্ত্বিক বিচারে একেই বলে ‘এক’, অর্থাৎ ২,৩,৪ প্রভৃতি সংখ্যার মূল উপাদান হ’ল ‘এক’৷ এক ছাড়া আর যে সমস্ত সংখ্যা থাকছে, তারা ‘এক’ থাকছে না বটে, কিন্তু প্রচ্ছন্ন ভাবে ‘এক’ থেকে যাচ্ছে৷ একের বেশী হলে আমরা বলি–‘অনেক’৷ তাই বলা হয়–অনেক ঞ্চ (অন্ এক) অর্থাৎ এক নয়৷ এখন এই তত্ত্বটিকে নিয়ে যদি গভীর ভাবে চিন্তা করি, তবে আমরা দেখতে পাবো যে, সমস্ত সত্তাই যদি সংশ্লেষণের পথ ধরে চলতে থাকে তা সব শেষে ‘এক’–এ এর পরিসমাপ্তি ঘটবে৷ তাই বলা যায়– ত্থুন্দ্ব ন্ব্দ ব্ধড়ন্দ্ব ব্দম্ভুব্ধড়ন্দ্বব্ধন্ন্ ত্মন্দ্বব্দব্ভপ্তব্ধ৷
শাস্ত্রে বলা হয়েছে–পরমপুরুষ এক ও অদ্বিতীয় অর্থাৎ একমেবাদ্বিতীয়ম৷ আর এই একমেবাদ্বিতীয়মের ‘জ্ঞ’ সত্তা বহুরূপে অভিব্যক্ত হচ্ছে বিশ্বের সবকিছুই৷ তাই শিবোপদেশের প্রথমেই শিব বলেছেন–‘একম্ জ্ঞানম্৷’
এই জগৎটা হ’ল চলমান৷ এখানে রয়েেেছ শুধু চলমানতার সমারোহ৷ কেউ থেমে নেই, কেউ স্থির নয়, কেউ স্থায়ীও নয়৷ এই জগতে যারা আসে তারা সবাই চলে যায়৷
তাই কবি গেয়েছেন–‘‘এই দিন আসে এই রাত আসে ভাই, যারা আসে তারা সবাই চলিয়া যায়,মনের মুকুরে মৃদু রেখা রেখে যায়৷’’ যা আসে আবার চলে যায়৷ যা দৈশিক, কালিক ও পাত্রিক এই ত্রিবন্ধনে আবদ্ধ তাকে অনিত্য বলে৷ পরমপুরুষ সৃষ্ট সকল বস্তুই সান্ত (স অন্ত).৷ এখন এই যে সত্তা যিনি সর্বসত্তার জ্ঞাতা পুরুষ, তিনি কেবল নিত্য অর্থাৎ পরমপুরুষই হলেন এক মাত্র নিত্য সত্তা৷ বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সৃষ্ট সমস্ত বস্তুকে সান্ত বলা হয়৷ আর এই বস্তু জগতের মধ্য থেকে, অর্থাৎ সীমিত বস্তুজগৎ তথা সান্তের মধ্যে থেকে মন অনন্তের ভাবনায় যখন উদ্বেলিত হয় তখন সান্ত মনের সীমারেখা উদ্বেলতায় হারিয়ে যায়৷ মনের এই যে উদ্বেলতা এটাকেই বলা হয় পরমাপ্রাপ্তি বা পরমাপ্রশান্তি৷ তাই দেখা যাচ্ছে–সান্ত সত্তার আদি ও শেষও আছে অর্থাৎ প্রারম্ভিক বিন্দু নুন্ব্ধন্ত্রপ্ত হ্মপ্সনুব্ধগ্গ ও অন্তবিন্দু .ব্ধন্দ্বব্জপ্পনুত্রপ্ত্ হ্মপ্সনুব্ধগ্গ আছে৷ যেহেতু প্রারম্ভিক ও অন্তবিন্দু দুই আছে, অতএব এই দুই বিন্দুর অর্ধপথে আছে মধ্যবিন্দু ত্তন্স্তুস্তুপ্তন্দ্ব হ্মপ্সনুব্ধগ্গ৷ তাই এক্ষেত্রে আনন্দমূর্ত্তি বলেছেন– ‘ট্ট হ্মপ্সনুব্ধ ড়্ত্রব্দ ন্ধপ্সব্ধ হ্মপ্সব্দন্ব্ধন্প্সু ত্ব্ব্ভব্ধ প্স প্প্ত্রন্ধুন্ব্ধব্ভস্তুন্দ্’ কিন্তু যার সীমারেখা নেই, যা অনাদি, অনন্ত তার আদি বিন্দুর পজিশন পাচ্ছে না, অন্তবিন্দুরও পজিশন পাচ্ছে না, আর তাই মধ্যবিন্দুর পজিশন পাওয়া যাচ্ছে না৷ তাই এক্ষেত্রে প্প্ত্রন্ধুন্ব্ধব্ভস্তুন্দ্ প্রশ্ণই ওঠে না৷ সান্ত অর্থাৎ সীমিত বস্তুর বিষয়ীভাব যখন অনন্তত্বের বিষয়ী হয়ে যায় ও শব্দ গুণ বর্জিত হয়ে যায় তখন বস্তুশূন্যতায় পর্যবসিত হয়ে যায়৷ তাই পরমা সম্প্রাপ্তির জন্যে চাই পরম পুরুষে আত্মসমর্পণ৷ এ জন্যে জ্ঞ–স্বরূপ পরমপুরুষ সম্বন্ধে শিব বলেছেন‘আদ্যন্ত শূন্যম্৷’
(৩) ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর মহাশয় যখন বর্ণপরিচয় (২য় ভাগ) বইটি লিখেছিলেন, তখন তিনি ‘এক’ বোঝাতৃেঐক্য’ শব্দটি বর্ণপরিচয় বইয়ের প্রথমেই লিখেছেন৷ অর্থাৎ ঐক্য মানে হ’ল ‘একের ভাব’–‘একস্য ভাবঃ’, এক ষ্ণ ঞ্চ ঐক্য৷ যদি পাঁচ সাতজন মিলে ভাবে, ‘‘আমরা এক৷ আমাদের এই একীভাব কোন বাইরের ধাক্কায় নষ্ট হবে না৷’’ তাহলে বুঝতে হবে আমাদের মধ্যে ঐক্য রয়েছে৷ ‘এক’ বলতে বোঝায় ‘হুুন্ব্ধ’৷ এই হুুন্ব্ধ কথা থেকেই হুুন্ব্ধম্ভ শব্দটির উৎপত্তি হয়েছে৷ ‘হুুন্ব্ধম্ভ’ শব্দটি এখানে হুুন্ব্ধ শব্দের ট্টত্ব্ত্রব্দব্ধব্জ্ত্রন্ প্সব্ভু. এই ‘এক‘–কে কেন্দ্র করেই একত্ব (এক ত্ব) ও একতা (এক তা) শব্দগুলিকে পাওয়া গিয়েছে৷ অনেক সত্তা যদি ভাবে– ‘‘আমরা এক’’ তা হলে একেই বলা হবে ঐক্য৷
- Log in to post comments