প্রায় ৮০০ কোটি বছর আগে পৃথিবীর কোথাও কঠিন পদার্থ বলে কিছু ছিল না৷ গ্রহটি তখন ছিল এক জ্বলন্ত গ্যাসপিণ্ড৷ পৃথিবীর স্থলভাগ সৃষ্টি হয়েছে মাত্র ২৩০ কোটি বছর আগে৷ টারসিয়ারি যুগের শেষাশেষি ও ক্রেটারিয়ান যুগের গোড়ার দিকে পৃথিবীর বুকে গণ্ডোয়ানাল্যাণ্ডের প্রথম উদ্ভব হয়েছিল৷ সে সময় পৃথিবীর মধ্যভাগ ছিল জলময়৷
সেদিন আরব সাগর বলে কিছু ছিল না, ছিল না বঙ্গোপসাগর বা অন্য কোন দ্বীপ–ইন্দোনেশিয়া অথবা অষ্ট্রেলিয়াও৷ উত্তর ভারতের অস্তিত্বও তখন ছিল না৷ একটি মাত্র অবিচ্ছিন্ন ভূমিখণ্ড সেদিন পরিব্যপ্ত হয়ে ছিল যার অংশ বিশেষ ছিল আজকের আফ্রিকা মহাদেশের পূর্বাংশ, দক্ষিণ ভারত, মালয়েশিয়া ও অষ্ট্রেলিয়া৷ প্রাচীনতম এই দ্বীপপুঞ্জ সদৃশ দীর্ঘ ভূমিখণ্ডের অংশবিশেষ ছিল সেদিন আজকের কানাডা ও আর্জেন্টিনা দেশের ভূ–ভাগও৷ এই যে বিশাল ভূমিখণ্ড যা একদিন বিস্তৃত ছিল আজকের আরবসাগর, বঙ্গোপসাগর, ইন্দোনেশিয়া দ্বীপপুঞ্জ, দক্ষিণ ভারতের মালভূমি, দক্ষিণ–পূর্ব আফ্রিকা ও ওসিয়ানিয়া অবধি, ভূতত্ত্ববিদগণ ও জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা তার নামকরণ করেছিলেন ‘গণ্ডোয়ানাল্যাণ্ড’৷ তাঁরা এই ভূমিখণ্ডের এরূপ নামকরণ করেচিলেন এই কারণে যে অষ্ট্রিক গোষ্ঠীভুক্ত ‘ গোণ্ড’ জনজাতি একদিন ওই বিশাল ভূমিখণ্ডের মধ্যভাগে বসবাস করতেন৷ এই মধ্যাঞ্জলের ভূমি অবশ্য গণ্ডোয়ানাল্যাণ্ডের প্রাচীনতম মৃত্তিকা বলে গণ্য হয় না৷ আজও ৪০ কোটি বছরের প্রাচীন ভারতের ছত্রিশগড়ী অঞ্চলে সেই গোণ্ডদেরই উত্তর–পুরুষেরা বসবাস করে চলেছেন৷
রাঢ় হ’ল সমুদ্রের জলস্তরের ঊর্ধ্বভাগে অবস্থিত গণ্ডোয়ানাল্যাণ্ডের প্রাচীনতম ভূমিখণ্ড৷ রাঢ়ের বুকে অবস্থিত আমাদের আনন্দনগরের পাহাড়গুলো কমপক্ষে ৩০ কোটি বছরের প্রাচীন৷ তখন হিমালয়েরও জন্ম হয় নি৷
প্রাচীনকালের এক ভয়ঙ্কর ভূকম্পন
তারপর আজ থেকে কম করেও ৩০ কোটি বছর পূর্বে ঘটেছিল প্লুটোনিক ভূমিকম্প৷ আজ যেখানে বঙ্গোপসাগর ও আরব সাগর সেই সুবিস্তৃত অংশের ভূমিখণ্ড সেদিনের ভয়ঙ্কর ভূমিকম্পের ফলে সমুদ্রগর্ভে বিলীন হয়ে গেছল৷ সেই ভূমিকম্পের ফলেই উদ্ভুত হয়েছিল আজকের উত্তর ভারত৷ সেই ভূমিকম্পের পরে আরব সাগর ও বঙ্গোপসাগর অঞ্চলে সেদিন যেসব পাহাড় ছিল সেগুলো পরিণত হ’ল দ্বীপভূমিতে৷ এভাবেই ৫০৩ টি সাগর–দ্বীপ জেগে উঠেছিল যাদের মধ্যে আজকের মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, ফিলিপাইন প্রভৃতি দেশ ও দ্বীপময় অঞ্চলগুলিও ছিল৷ এগুলি তো বটেই, এ ছাড়াও হিমালয়ের উদ্ভূতি ঘটেছিল অনুমান ৩০ লক্ষ বছর পূর্বে৷ রাঢ় ও গণ্ডোয়ানাল্যাণ্ড ৩০ কোটি বছরের চেয়েও প্রাচীন৷
শিবালিক পর্বতমালার মৃত্তিকা স্তরে আজও সামুদ্রিক প্রাণীদের জীবাশ্ম খুঁজে পাওয়া যায়৷ হিমালয় পর্বতও যে একদিন সমুদ্রের তলায় ছিল তার প্রমাণ রয়ে গেছে৷ সর–সমুদ্রগুলোতে (sargasso sea) জলস্রোতবাহিত জীবজন্তুদের গলিত মৃতদেহগুলো পরবর্তীকালে জ্বালানি তেলে রূপান্তরিত হয়েছে৷ আজকের ভারতের সুবিস্তীর্ণ গাঙ্গেয় সমতল অঞ্চল হিমালয় বিধৌত পাললিক মৃত্তিকার দ্বারা তৈরী৷
আফ্রিকার সাহারা মরুভূমি, সিন্ধু ও রাজস্থানের থর মরু–ঞ্চল একদিন সমুদ্রগর্ভে ছিল৷ তাদের বালিয়াড়ীগুলোও সমুদ্র সঞ্জাত৷ এই বালিয়াড়ীগুলোই প্রমাণ করে দেয় যে এই দুই সুবিস্তীর্ণ মরু–ঞ্চল এককালে সমুদ্রের তলায় অবস্থিত ছিল৷*
(‘‘অভিমত’’ নবম খণ্ড থেকে গৃহীত৷–সম্পাদক৷)