গণতন্ত্র ও সদ্বিপ্রতন্ত্র

Baba's Name
শ্রী প্রভাতরঞ্জন সরকার

নানারকম শাসন পদ্ধতি রয়েছে, আর তাদের মধ্যে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা সবচেয়ে বেশী প্রশংসিত৷

গণ + তন্ + ত্রৈ + ড = গণতন্ত্র৷ ‘তন্ত্র’ শব্দের অর্থ হ’ল নিয়ন্ত্রিতভাবে বা বিধিবদ্ধ পদ্ধতিতে কোন কিছুকে বাড়িয়ে দেওয়া৷ আবার তং  ত্রৈ  ড করেও ‘তন্ত্র’৷ এখানে ‘তন্ত্র’ শব্দের অর্থ হচ্ছে জড়তা থেকে মুক্ত করা৷ ‘ত’ মানে জড়তা৷ ‘গণতন্ত্র’ মানে গণতার সাহায্যে মানুষকে জড়তা থেকে মুক্ত করা, অথবা বিধিবদ্ধভাবে তাদের জন্যে ত্রাণের রাস্তা তৈরী করে’ দেওয়া৷ ‘গণতন্ত্র’ শব্দটি’–র যথার্থ প্রতিভু না হলেও মোটামুটি অর্থে চলতে পারে৷

রাজতন্ত্রের অত্যাচারের বিরুদ্ধ মনোভাব থেকে গণতান্ত্রিক মতবাদের সৃষ্টি হয়েছে৷ গণতন্ত্রের ইতিহাস অতি প্রাচীন৷ কথিত হয় যে, প্রাচীন ভারতবর্ষে লিচ্ছবী রাজবংশের সময়ে গণতন্ত্রের সূত্রপাত হয়৷

বৈশালীর লিচ্ছবীরা রাজতন্ত্রে বীতশ্রদ্ধ হয়ে রাজার পদটাই সরিয়ে দেন৷ মণ্ডলী বা গণতা পরিচিত হয় লিচ্ছবী নামে৷ লিচ্ছবীরা নির্বাচনের দ্বারা একটি উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন গণতা গড়ে’ তোলেন, যার নাম দেওয়া হয় মহালিচ্ছবী৷ এই মহালিচ্ছবীরা বৈশালীর রাজতন্ত্রের শাসনের রাশ ধরে’ থাকতেন৷ অর্থাৎ, ঠিক রাজতন্ত্রের গোড়ার দিকে নয়, রাজতন্ত্র কয়েক ধাপ চলার পরে ক্ষাত্র যুগের মধ্যে ক্ষমতার দওলতে রাজতন্ত্র সাধারণতন্ত্রের রূপ নিতে থাকে৷ যুগগত বিচারে ক্ষাত্রযুগ থেকেই যায়৷ বলা হয়, এই সাধারণতন্ত্র বা ত্মন্দ্বহ্মব্ভত্ব্প্তন্ন্ কোন গোষ্ঠী বিশেষ বা রাজার খেয়াল খুশীতে চলে না–চলে জনসাধারণের শুভবুদ্ধিতে জনপ্রতিনিধিদের দ্বারা৷ জনতার দ্বারা, জনতার জন্যে গণতা যে শাসন করেন তাই গণতন্ত্র৷ গণতন্ত্র তার মাথার ওপরে প্রতীক তিলক হিসেবে রাজতন্ত্রের একটি টীকা রাখতেও পারে (যেমন ব্রিটেনে, সুইডেনে), আবার নাও রাখতে পারে (যেমন ভারতে, ইউ–এস–এ তে)৷

যেখানে কোন প্রকার শোষণ নেই সেখানেই গণতন্ত্র ফলপ্রসু হতে পারে৷ প্রতিটি মানুষের জীবনেই কতকগুলি ন্যুনতম প্রয়োজনীয়তা (minimum requirements) আছে, ও সেগুলি পুরণ করার গ্যারাণ্ঢি থাকা দরকার৷ জনশিক্ষা গণতন্ত্রের সার্থকতা ও সুন্দরভাবে পরিচালনার জন্যে অন্যতম বিষয় ও মূল প্রয়োজন৷ কোন কোন স্থলে শিক্ষিত মানুষও বোট দানের অধিকারকে অন্যায় ভাবে ব্যবহার করে৷ গণতন্ত্রের নামে এটা কি প্রহসন নয়৷ সুতরাং শিক্ষার বিস্তার ও যথার্থ জ্ঞান একান্ত প্রয়োজন৷ শিক্ষা মানে শুধু আক্ষরিক জ্ঞান বোঝায় না৷ আমার মতে যথার্থ ও যথেষ্ট জ্ঞান ও বোধশক্তিই সত্যিকারের শিক্ষা৷ শিক্ষা ব্যতিরেকে গণতন্ত্র কোনদিনই সার্থক হতে পারে না৷

গণতন্ত্রের সাফল্যের জন্যে নৈতিকতা মূল উপাদান৷ নীতির অভাবে লোকে বোট* বিক্রি করে৷ গণতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় অনৈতিকতা একটি মস্ত বড় প্রশ্ণ–যাকে কোনমতেই পাশ কাটিয়ে যাওয়া চলে না৷

চালাক চতুর রাজনৈতিক নেতারা নির্বাচনে জয়ী হবার জন্যে সমস্ত রকম অসদুপায় অবলম্বন করে, আর এরই ফলে সমাজে নৈতিকতার মান নেবে যায়৷ সৎ ও দক্ষ লোকেরা দূরে সরে’ থাকতে বাধ্য হয়৷ তাই নীতিবাদীদের নির্বাচনে জয়লাভের সম্ভাবনা খুবই কম৷

প্রাদেশিকতা, সাম্প্রদায়িকতা, জাতিভেদ প্রভৃতি নৈতিকতা বর্জিত কাজকর্ম গণতন্ত্রে প্রশ্রয় পাচ্ছে৷ তাই দেখছি, নৈতিকতা–যা নাকি গণতন্ত্রের সার্থক জয়যাত্রার একটি মৌলিক বিষয়–সেটাই অরক্ষিত হয়ে আছে৷

তাই যতক্ষণ পর্যন্ত সমস্ত জনসংখ্যার শতকরা একান্ন জন লোক নৈতিক অনুশাসনকে কঠোরভাবে না মানছে ততক্ষণ পর্যন্ত গণতন্ত্রের সাফল্য অসম্ভব৷

গণতন্ত্রকে সফল করে’ তুলবার পক্ষে সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সচেতনতা থাকাও খুব প্রয়োজন৷ শিক্ষিত লোকেরাও ধূর্ত্ত ও সুচতুর রাজনীতিকদের দ্বারা চালিত হতে পারেন–যদি না তাঁরা সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক দিক থেকে যথেষ্ট ওয়াকিবহাল থাকেন৷

এই চেতনাগুলি ভিন্ন গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় সমাজের কল্যাণসাধন করা কখনই সম্ভব নয়৷ কিন্তু দুঃখের বিষয়, এ ধরণের চিন্তা শুধু তত্ত্বের দিক থেকেই সম্ভব বাস্তবে তার রূপায়ণ অসম্ভব৷ বুদ্ধিজীবিরা তাই এ ধরণের বাস্তব–মূল্যহীন একটি চিন্তাকে কখনও প্রশ্রয় দেবে না৷ তবে দেখছি, সমাজের প্রকৃত কল্যাণসাধন গণতন্ত্রের দ্বারা সম্ভব নয়৷

গণতান্ত্রিক কাঠামোতে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে গেলে যে সু–উচ্চ নৈতিকতা প্রয়োজন তা অসম্ভব না হলেও পাওয়া দুষ্কর৷ তাই গণতান্ত্রিক–সমাজত্ থিয়োরীর দিকে দিয়ে দেখতে গেলে মন্দ না হলেও বাস্তবের পৃথিবীতে কোনদিন সম্ভব হবে বলে’ আশা করতে পারি না৷

কিন্তু যতদিন না কোন অধিকতর ভালো ও সমর্থনযোগ্য তত্ত্বকে আমরা বের করতে পারছি ততদিন অন্যান্যদের তুলনায় গণতন্ত্রকেই মন্দের ভাল বলব, ও এই সময়ের জন্যে আমরা গণতন্ত্রকে ব্যবহার করতে পারি৷

যেহেতু গণতান্ত্রিক সংরচনা বৈশ্যদের পুঁজির পাহাড় সৃষ্টি করতে সাহায্য করে, সেজন্যে গণতন্ত্রের সাহায্যেই বৈশ্য শ্রেণীর শাসন চলতে থাকে৷ আর তাই এই বৈশ্য–শোষণের যুগে সদ্বিপ্রদের নির্বাচনে অংশ গ্রহণ করে’ বিজয়ী হওয়ার কৌশল অর্জন করার প্রয়োজনীয়তাও দেখা দিতে পারে৷   (ক্রমশঃ)

* বাংলা লিপিতে বর্গীয় ‘ৰ’ ও অন্তস্থ ‘ব’ প্রাচীনকাল থেকে দু’টোই আছে৷ তবে গত কয়েক শ’ বছর ধরে’ দু’টোর চেহারা একরকম হয়ে দাঁড়িয়েছিল৷ এর ফলে বাংলা ভাষায় যেমন এসেছিল উচ্চারণ–বিকৃতি, তেমনই এসেছিল বানান বিকৃতি৷ ‘boat’ শব্দ বাংলা অক্ষরে বর্গীয় ‘ৰ’ দিয়ে লিখতে হবে, ‘vote’ লিখতে হবে অন্তঃস্থ ‘ক্ষ’ দিয়ে৷ বর্গীয় ‘ৰ’ ও অন্তঃস্থ ‘ব’–এর স্বতন্ত্র চেহারা না থাকলে বাংলা অক্ষরে সংস্কৃত (তথা অন্যান্য) ভাষায় যথাযথভাবে লেখাপড়া ও শিক্ষাদান সম্ভব নয়৷

 

‘‘আমি চাই প্রতিটি মানুষ জীবনের নূ্যনতম প্রয়োজন পূর্ত্তির গ্যারান্টী পাক ঙ্গ প্রতিটি মানুষ তার মানসিক ক্ষেত্রের সমস্ত সম্ভাবনার পূর্ণ সুযোগ পাক প্রতিটি মানুষ শাশ্বত সত্য উপলব্ধির সমান সুযোগ পাক ও বিশ্বের সকল উৎকর্ষ ও গৌরবের অধিকারী হোক, প্রতিটি মনুষ সেই শাশ্বত অনন্ত সত্তার দিকে এগিয়ে চলুক ’’