গণ অন্ন = গণান্ন৷ ভাবারূঢ়ার্থে ‘গণান্ন’ বলতে বোঝায় যে অন্ন বা খাদ্য অনেকের জন্যে পাক করা হয়েছে৷ যোগারূঢ়ার্থে গণান্ন বলতে বোঝায়–বিশেষ ধরনের গণ–নবান্ন উৎসব৷
সুপ্রাচীনকালে শস্য কর্ত্তনের পর কর্ষকেরা সবাই শিশু–বৃদ্ধ নির্বিশেষে সমস্ত গ্রামবাসী একসঙ্গে অন্ন ভাগ করে ভোজন করতেন চাষের জমিতে বসে৷ এই যে একটি বিশেষ ধরনের নবান্ন উৎসব সেকালের মানুষেরা পালন করতেন তার সঙ্গে তাঁরা খেতেন ছাঁচি কুমড়োর বড়ি, মাষ–কলাইয়ের (বিরি কলাইয়ের) ডাল৷ বৌদ্ধ যুগ পর্যন্ত পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে বিশেষ করে বাঙলায় এই গণনবান্ন উৎসব চলত৷ পরে এই গণনবান্ন উৎসব ধীরে ধীরে উঠে যায়৷ নবান্ন হয়ে দাঁড়ায় পারিবারিক উৎসব৷ তার সঙ্গে ‘গণ’–সংযুক্তি থাকে না৷ তবে প্রাচীনকালের গণনবান্নের জের হিসাবে এখনও নবান্নের দিন শত্রুমিত্র নির্বিশেষে একে অপরকে ডেকে খাওয়ায়–পশুপক্ষীকেও খাওয়ায়–অনেকে নূতন বস্ত্র পরিধান করে৷ অনেকে ছাঁচি–কুমড়ো কুরে নিয়ে বড়ি তৈরী করে৷ অনেকে নূতন মাষকলাইয়ের (বিরিকলাই) ডাল খায় (বিরিকলাই বোনা হয় আষাঢ় মাসে আর তোলা হয় আশ্বিন মাসে)৷ নবান্নের সময় তাজা বিরিকলাইয়ের ডাল পাওয়া যায়৷
এই গণনবান্ন উৎসব মগধ দেশে অন্য ভাবে পালিত হত৷ তাঁরা এইদিন সূর্যের প্রতি কৃতজ্ঞতাবশতঃ সূর্যের পূজা করত৷ সূর্যের কৃপাতেই মেঘ তৈরী হয়, মেঘ থেকে বর্ষণ হয়–এই ভেবেই তারা সূর্যের পূজা করত৷ পূজা করত ভাদই ফসল বা আউশ ফসল উঠবার পরে কার্ত্তিক মাসে৷ বৈদিক বিধি অনুযায়ী সূর্য পুরুষ–দেবতা, চন্দ্র স্ত্রী–দেবতা৷ কিন্তু অষ্ট্রিক বিধি অনুযায়ী চন্দ্র পুরুষ–দেবতা ও সূর্য স্ত্রী–দেবতা৷ তাই প্রাচীন মগধের মানুষেরা সূর্যকে ছট্ঠি মাঈ অর্থাৎ ষষ্ঠীমাতা নামে সম্বোধন করত৷ পূজা দিত ওই ষষ্ঠী মাতাকে৷ যেহেতু এটি অষ্ট্রিক বিধান তাই এতে ব্রাহ্মণ–পুরোহিতের কোন স্থান নেই৷ অষ্ট্রিক সমাজের স্বাভাবিক বিধি অনুযায়ী ষষ্ঠী মাতার পূজা অর্থাৎ ছট্ পূজা নারীরাই করত৷ অষ্ট্রিক পূজার উপাদান হিসেবে চালের গুঁড়ো, কলা প্রভৃতি উপকরণ থাকত৷ রবি ফসল কাটার পরে–চৈত্র মাসেও মগধের মানুষ কৃতজ্ঞতাস্বরূপ আরও একবার সূর্যের পূজা করত৷ আজও মগধে এই দুই ছট পূজাই (কার্ত্তিকা ছট ও চৈতী ছট) চলে৷ জিনিসটা কতকটা অসাম্প্রদায়িক৷ ছোটবেলায় দেখেছি, জাতি–ধর্ম নির্বিশেষে সবাই এই পূজা করছেন–মুসলমানেরাও৷ প্রাচীন মগধে ষষ্ঠীমায়ের প্রসাদ ঙ্মঠেকুয়াৰ গ্রামবাসীরা গ্রামের উত্তর–পূর্ব কোণে ঙ্মঈশান কোণৰ বসে একত্রে ভোজন করত৷ এটাকেও বলতে পার এক ধরণের গণনবান্ন৷ অবশ্য পৃথক ভাবে নবান্ন উৎসবও মগধে ছিল বা আছে৷ বৌদ্ধ যুগের পর জাতিভেদ বাঙলার সমাজে জীবনে শিকড় গেড়ে বসার সঙ্গে সঙ্গে এই একত্র–ভোজন বা গণনবান্ন বা নবান্ন–বিধি প্রায় উঠেই যায়৷ তবে একটু আগেই বললুম, নবান্নের অসাম্প্রদায়িকত্ব বা ব্যাপকত্ব আজও রয়েছে৷ কোন উৎসব উপলক্ষ্যে গ্রামের মানুষেরা যদি একসঙ্গে বসে পঙ্ক্তি ভোজন করেন ও রান্নাগুলো যদি এক সঙ্গে হয় তবে এই বিরাট পঙ্ক্তিভোজন বা সাধারণ ভুরিভোজনকেও গণান্ন বলা হয়৷ এ ধরনের গণান্ন পৃথিবীর অনেক দেশেই রয়েছে... ভারতেও রয়েছে৷ যদি কিছু–সংখ্যক মানুষ কোন অপরিচিত স্থানে যায় বা থাকে সেক্ষেত্রে তাকে বা তাদের যদি কোন গজ্জায় (হোটেলে) থাকতে হয় সেক্ষেত্রে দীর্ঘকাল গজ্জায় থাকতে থাকতে তাকে বা তাদের নানান ধরনের অসুবিধা ভোগ করতে হয়৷ কখনো কখনো সে তার পছন্দমত রান্নাবান্না পায় না, কখনো কখনো গজ্জার মালিক কম তেল–ঘি দিয়ে বেশী ঝাল প্রয়োগ করে আহারকারীর তেল–ঘিয়ের অভাব বোধকে ভিন্ন পথে চালিয়ে দেয়৷ ঝালের ঠ্যালাতেই সে আ–হা–হা....উ–হু–হু করতে থাকে৷ কখনো কখনো আবার কোন কোন স্থানে অল্প পরিমাণ বাসি জিনিস বেশী পরিমাণ তাজা জিনিসের সঙ্গে মিশিয়ে বাজারে পার করে দেয়৷ আমি বলছি না সমস্ত গজ্জা–মালিকই এমন করেন৷ তবে কেউ কেউ এমনটা করেন–এই খরবটা আমি পেয়েছিলুম আমার কম বয়সের বন্ধু বাবু গোবিন্দপ্রসাদ সিংয়ের কাছ থেকে৷ বাবু গোবিন্দপ্রসাদ ছিলেন বিহারের মুঙ্গের জেলার মানুষ৷ আমার এই জেলার মানুষেরা বুদ্ধিমান হলেও খুব সোজা বুদ্ধিতে চলে৷ বাবু গোবিন্দপ্রসাদকে একবার জিজ্ঞেস করা হ’ল–আপনি কি সরকারী কার্যব্যপদেশে দু চারদিনের জন্যেও কলকাতায় যাবেন তিনি সঙ্গে সঙ্গে হাত–মুখ নেড়ে প্রবল ভাবে আপত্তি জানিয়ে বললেন–না, না, কিছুতেই নয়, কিছুতেই নয়৷
আমি শুধোলুম–কেন?
আজন্ম নিরামিষাশী বাবু গোবিন্দপ্রসাদ বললেন–ওখানকার হোটেলে কী বলে কী খাইয়ে দেবে তার কোন ঠিক–ঠিকানা নেই, আমি যাব না৷
বাবু গোবিন্দপ্রসাদের অন্যান্য বন্ধুরা বললেন–যখন কলকাতায় যাবে, তখন প্রথমেই বলবে আমি নিরামিষ খাই–ভাত, ডাল, ঝালের ঝোল আর পটোলের তরকারী৷ বাবু গোবিন্দপ্রসাদ কলকাতা গেলেন–যথাসময়ে ফিরেও এলেন৷ একদিন আমার কাছে এসে দাঁড়ালেন–দেখি তাঁর মুখমণ্ডলে কালো মেঘ নেবে এসেছে৷ জিজ্ঞেস করলুম–কী হয়েছে কী হয়েছে কলকাতা কেমন লাগল
উনি বললেন–এই কাণ মলছি, নাক মলছি, প্রাণ থাকতে দ্বিতীয়বার কলকাতায় যাচ্ছি না৷
আমি বললুম–কী হয়েছে
তিনি বললেন–বন্ধুদের পরামর্শমত গিয়েই বললুম আমি খাই ভাত–ডাল–ঝালের ঝোল–পটোলের তরকারী৷
হোটেল মালিক সাগ্রহে বললে–প্রত্যেকটি জিনিস এখানে পাবেন–খেয়ে মেজাজ তররর হয়ে যাবে৷
আমি একটু খুশি মনে ভোজনের টেবিলে বসলুম৷ প্রথমেই দেখলুম রয়েছে জলের মত পাতলা মুসুরির ডাল৷ আমি সাঁতরে অনেকবার মুঙ্গেরের গঙ্গা পার হয়েছি৷ ভাবলুম ওই ডালের বাটিতে নেবে সাঁতার কাটতে শুরু করে দিই৷ তাতে রয়েছে শীরফ জল৷ বাটির তলায় আড় চোখে তাকিয়ে রয়েছে কেবল দু–চারটে মুসুরির ডাল৷ পটোলের তরকারীতে তেল বা ঘি কিছুই নেই৷ তবে মীর্চ (লংকা) ঢ়ালা হয়েছে প্রচুর৷ লংকার জ্বালায় যখন চোখ–নাক দিয়ে জল গড়াচ্ছে তখন আমি তরকারীতে যে তেল–ঘি নেই তা অনুভব করার শক্তি হারিয়ে ফেললুম৷ সবচেয়ে ফ্যাসাদ হ’ল ঝোলের বাটি টানতে টানতে৷ বাটি টানার সঙ্গে সঙ্গে মনে হ’ল কেমন যেন একটা মাছের বাজারের গন্ধ৷ রামজীর নাম নিয়ে কিছুটা ঝোল–ভাত মাখালুম৷ এক গ্রাস মুখে
ফেলতেই দেখি নির্ঘাত মাছের গন্ধ৷ (হিন্দী ভাষায় যেমন ‘বু’, মারাঠীতে তেমনি ‘মহক’ ও গুজরাতীতে ‘গন্ধ’)৷ এই মাছের মহক (ঝোলের) তার চেয়ে উগ্রতর৷ হোটেল–মালিককে শুধোলুম, ঝালের ঝোলে মাছের গন্ধ কেন উত্তরের জন্যে তিনি তৈরীই ছিলেন৷ কাল বিলম্ব না করেই বললেন–জানেন তো, বঙ্গাল মে ধানের জমির পাশে মাছকা পুকুর হ্যায়৷ তাই ধানের জমিতে মাছের গন্ধ ভেসে আসতা হ্যায়৷ সেই জন্যে আপনি ঝোলেতে মাছের গন্ধ পাতা হ্যায়৷ ও কিছু নয়, ওনিয়ে আপনার ভাববার দরকার নেহী হেঁ৷ দু–চার গ্রাস ওটাই গলাধঃকরণ করলুম৷ চরম ফ্যাসাদ বাধল আর একটু পরে৷ এক গ্রাস ঝোল–ভাত মুখে ফেলতে যাচ্ছি এমন সময়ে আঙ্গুলে আটকা পড়ল মাছের একটা লম্বা হড্ডী (মাছের লম্বা কাঁটা)৷ আমি তখন হোটেল মালিককে বললুম–এ কেমন হ’ল ভাতে না হয় মাছের গন্ধ এল কারণ ধানক্ষেতের পাশেই পুকুরে মাছ কিন্তু মাছের কাঁটা কী করে এল
হোটেল–মালিক বললে–জেলেরা পুকুর থেকে মাছ ধরে এই ধানক্ষেতের মাছগুলো ফেলে কি না ধান কাটার সময় দু–চারটে মাছের কাঁটাও উঠে আসে৷ এতে রাঁধবার সময় কয়েকটা কাঁটাও সেই ভাতে থেকে যায়৷
তাহলে বুঝুন, কী ফ্যাসাদ হয়েছিল৷ আমরা খাই ড়হেরী কা ডাল৷
যাই হোক্, পরের দিকে কেবল মুসুরের ডাল আর পটোলের তরকারী খেয়ে দিন কাটিয়েছি৷ আর ভুলেও কলকাতার পথ মাড়াচ্ছি না৷ এখন থেকে কাণ মলছি, নাকে খৎ দিচ্ছি আর ভুলেও কলকাতার পথ মাড়াচ্ছি না৷ (শব্দ চয়নিকা, ১৬/১৯৮)