ৰাঙলার একটি ক্ষৃহৎ অংশ জলের দেশ৷ এই দেশের যে সমস্ত অঞ্চলে বড় বড় নদী বয়ে গেছে সে সমস্ত অঞ্চলে কোথাও কোথাও নদী বাঁক নিয়েছে (কিষাণগঞ্জ মহকুমায় এ ধরণের একটি স্থানের নামই হচ্ছে দীঘলবাঁক৷ নামেতেই স্থানটির পরিচয় পাওয়া যাচ্ছে৷ অনেক শিক্ষিত ভদ্রলোককেও স্থানটির নাম উচ্চারণ করতে শুণেছি ‘ডিগাল ব্যাঙ্ক’) ও এরই ফলে বাঁকের কাছে জলের তলায় ঘুর্ণীর সৃষ্টি হয়েছে৷ এইসব জায়গা নৌকা বা জাহাজের পক্ষে বিপজ্জনক৷ যাইহোক, কৃষ্ণনগরের কাছে জলঙ্গী নদী যেখানে বাঁক (সংস্কৃত, বক্র>বংক>বাঁকা) নিয়েছে সেখানেও নদীতে এইরূপ একটি ঘুর্ণী ছিল৷ সেকালে কলকাতা থেকে জলঙ্গী নদীর পথে পদ্মায় পৌঁছে সেখান থেকে ঢাকা যাওয়া হ’ত জলপথে৷ ওই ঘুর্ণীর কাছটিতে জাহাজ একটু সাবধানে চালাতে হ’ত৷ এই ঘুর্ণীর পাশে যে জনপদ গড়ে উঠেছে তার নাম রাখা হয়েছে ঘুর্ণী৷ এই ঘুর্ণী, গোয়াড়ি আর কৃষ্ণনগর–তিনটি জায়গা নিয়ে গড়ে উঠেছিল সেকালকার ৰাঙলার সাংসৃক্তিক পীঠস্থান কৃষ্ণনগর৷ এই ঘুর্ণীতে মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্রের আমলে বীরভূমের ইলামবাজার থেকে কিছু–শিল্পীদের আনিয়ে বসবাস করানো হয়৷ তাঁরাই কৃষ্ণনগরের বর্তমান সুপ্রসিদ্ধ মৃৎশিল্পে আদি জনক৷ যেসব গ্রাম বা শহরের নামের সঙ্গে ‘দহ’ কথাটা যুক্ত রয়েছে সেই নাম শুণেই বুঝতে হবে ওই গ্রাম বা শহরের কাছাকাছি কোথাও বড় নদী আছে বা ছিল ও তাতে ঘুর্ণী বা দহ আছে বা ছিল৷ মহানন্দা নদীতেও এই রকম ঘুর্ণী ছিল৷ অথর্ববেদে পরানন্দা ও অপরানন্দা নামে দু’টি নদীর উল্লেখ আছে৷ এই দু’টি কিষাণগঞ্জের কাছে মিলিত হয়ে নাম নিয়েছে মহানন্দা৷ মল্লক্ষত্রিয় রাজারা যখন ওই অঞ্চলটাকে দখল করেন তখন ওই অঞ্চলের নাম রাখা হ’ল ‘মালদহ’৷ অর্থাৎ মল্লদের রাজ্য ও কাছেই মহানন্দার দহ–দু’য়ে মিলে হ’ল ‘মালদহ’৷ অনুরূপভাবে রাজশাহী জেলায় আছে ‘সরদহ’, নদীয়াতে আছে ‘চক্রদহ’ থেকে ‘চাকদা’৷ চাকদার পাশ দিয়ে এককালে বয়ে যেত ভাগীরথী নদী৷ এখন ভাগীরথী কিছুটা সরে গেছে৷
এই ভাগীরথীর পশ্চিম দিকে মগরার কাছ দিয়ে গেছে সরস্বতী নদী ও কল্যাণীর কাছ দিয়ে গেছে যমুনা নদী৷ ভাগীরথী, সরস্বতী ও যমুনা–এই তিন নদীর সংযোগস্থল হচ্ছে ত্রিবেণী–মুক্ত ত্রিবেণী বা মুক্ত বেণী অর্থাৎ তিন নদী তিন দিকে চলে গেছে৷ এলাহাবাদের কাছে প্রয়াগে যে ত্রিবেণী তা’ ৰদ্ধ ত্রিবেণী বা বদ্ধ বেণী৷ কারণ, এখানে তিনটি নদী ভিন্ন ভিন্ন দিক দিয়ে এসে একত্রিত হয়েছে৷
মুক্ত বেণীর যে যমুনা তা’ গিয়ে মিশেছে ইছামতীতে৷ যমুনার মাঝপথে সেকালে দক্ষিণ মুখে বেরিয়ে আসত বিদ্যাধরী নদী যা বর্তমান কলকাতার পূর্ব প্রত্যন্ত দিয়ে দক্ষিণ মুখে গিয়ে ক্যানিংয়ের কাছে ভাগীরথীর আর একটি শাখা নদী পিয়ালীর সঙ্গে মিলিত হয়ে মাতলা নাম নিয়ে সুন্দরবনের ভেতর দিয়ে বঙ্গোপসাগরে গিয়ে পড়েছে৷ এই মাতলার তীরেই ক্যানিং বন্দর গড়বার পরিকল্পনা ইংরেজরা নিয়েছিলেন৷ কিন্তু মাতলা তো আসলে নদী নয়৷ মাতলা সামান্য একটি খাড়ি •estuary—৷ খাড়িকে কথ্য ইংরেজীতে backwater-ও বলে৷ ৰাংলা ও ওড়িয়াতে খাড়ি মানে estuary বা backwater হলেও উর্দুতে ‘খাড়ি’ মানে উপসাগর৷ যেমন বঙ্গোপসাগর, উর্দুতে ‘বঙ্গাল কী খাড়ী’৷ তাই মাতলার বানে প্রস্তাবিত ক্যানিং বন্দর বিধ্বস্ত হতে দেখে ক্যানিং বন্দর পরিকল্পনা পরিত্যক্ত হয়৷ এই দক্ষিণ মুখে প্রবাহিত বিদ্যাধরী প্রায় প্রতি বৎসরই তার গতিধারার পরিবর্তন করত৷ পরে এলাকাটি একটি নোনা জলের বিলে পরিণত হয়, সাহেবরা যার নাম দেন সল্টলেক এরিয়া (লবণহ্রদ এলাকা)৷ ওই স্থানটি ছিল নোনা মাটির গাছগাছালিতে পরিপূর্ণ৷ ছিল গোল, বাইন, গরাণ, গাব, হিন্তালের জঙ্গল৷ জোয়ারে সমুদ্রের নোনা জল ঢুকে স্থানটিকে আরও ভয়ঙ্কর করে তুলত৷ ছিল একাধিক দহ৷ দিনদুপুরে ঘুরে বেড়াত শিয়ালের দল৷ লোকে সম্পূর্ণ এলাকাটিকেই বলত ‘শিয়ালদহ’৷