হে বিশ্বকবি, লহ প্রণাম

লেখক
পত্রিকা প্রিতিনিধি

বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এমনই এক বিশ্ব বরেণ্য কবি যিনি পৃথিবীর দুটি মহান রাষ্ট্রের যথা ভারত ও বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীতের রচয়িতা৷ এই জাতীয় সঙ্গীত রচিত হয় মহান বাংলা ভাষায়৷ কবি পৃথিবীর আলো দেখেছেন গত ১৮৬১ সালের ২৫শে বৈশাখ কলিকাতার ঠাকুর পরিবারে জোড়াসাঁকোর বাড়িতে৷ পিতা ছিলেন মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর আর মাতা ছিলেন সারদাদেবী৷

তিনি দীর্ঘ ৮০ বছর জীবিত ছিলেন৷ তিনি ইহলোক ত্যাগ করেন গত ১৯৪১ সালের ২২শে শ্রাবণ৷ তিনি বিশ্বের দরবারে তাঁর গীতাঞ্জলি কাব্যের জন্যে ১৯১৩ সালে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন৷ তিনি তাঁর চিন্তাভাবনায় সবচেয়ে বেশী গুরুত্ব দেন সেই উপনিষদের পরম ব্রহ্মের ধ্যানে৷ তিনি মহান সাধক হিসাবে উপলব্ধি করেন যে সেই পরমব্রহ্মের আনন্দ ধারায় দোলায়িত এই বিশ্বসংসার৷ তিনিই সকল সৃষ্ট বস্তুর পিতা৷ তাই তিনি একেশ্বরবাদেই বিশ্বাসী ছিলেন৷ তবে তিনি এই অপেক্ষিক জগতের সুন্দর পৃথিবীর কোন কিছুকেই অস্বীকার করেন নি৷ তিনি বাংলার মাটিতে, আবহাওয়াতে লালিত পালিত হয়েছেন৷ তাঁর মানবিকতা ছিল লক্ষ্যণীয়৷ তিনি ঠুনকো জাতপাত , ভেদাভেদকে কোনদিনই মেনে নিতে পারেননি৷ সেই বিশ্ব বরেণ্য প্রতিভার অধিকারীকে তৎকালীন সমাজের শিক্ষিত ব্যষ্টিরা মেনে নিতে পারেননি৷ তাঁর কাব্যের ও লেখার বিরূপ সমালোচনা করে তাঁকে মানসিক আঘাত দিয়ে গেছেন৷ তাই তৎকালীন কলকাতার শিক্ষিত সমাজ তাঁকে যখন নোবেল পুরস্কার প্রাপ্তির জন্যে সম্মান জ্ঞাপন করেন তখন কবি অত্যন্ত ব্যথিত হয়ে বলেছিলেন–‘এ মণিহার আমার নাহি সাজে, এরে পরতে গেলে লাগে, ছিঁড়তে গেলে বাজে৷’

কবি উপলব্ধি করেছিলেন যে গ্রামের মানুষ বিশেষ করে চাষীদের সামাজিক, আর্থিক উন্নতি না হলে এই বাংলার সার্বিক উন্নতি সম্ভব নয়৷ তাই তিনি চাষীদের উন্নতির জন্যে চিন্তাভাবনা করতেন ও বোলপুরের আশপাশের গ্রামে চাষীদের উন্নতির জন্যে উন্নত ধরণের চাষ ও সমবায়ের মাধ্যমে তাঁদের আর্থিক উন্নতির চেষ্টা করে যান আজীবন৷ তিনি একজন সার্থক শিক্ষাবিদ ছিলেন৷ তাই বোলপুরের ঊষর মাটিতে একক প্রচেষ্টায় নোতুন শিক্ষা ব্যবস্থার প্রবর্ত্তন করেন৷ প্রাচ্য ও পাশ্চাত্ত্যের শিক্ষার সমন্বয় ঘটান তাঁর শিক্ষা ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে৷ তৎকালীন যুগে এই ধরণের শিক্ষা ব্যবস্থা প্রচলনে বেসরকারী ভাবে বাঁচিয়ে রাখাটা যে কত বড়ো কঠিন কাজ তা কবি নিজে উপলব্ধি করতেন৷ যৎসামান্য অর্থে তিনি শিক্ষকগণকে নিয়োগ করতেন আশ্রমিক হিসাবে৷ সেই শিক্ষা ব্যবস্থাই পরবর্ত্তীকালে শান্তিনিকেতনের ‘বিশ্বভারতী’ হয়ে শিক্ষা ক্ষেত্রে এক অবদান তিনি রেখে গেছেন৷

তিনি বুঝেছিলেন দেশের সাধারণ মানুষ যদি নূ্যনতম শিক্ষালাভ না করে ও তাদের বেঁচে থাকার নূ্যনতম প্রয়োজন না মেটে তা হলে রাজনৈতিক স্বাধীনতা আন্দোলন সার্থক হতে পারে না৷ তাই কবিকে দেখি সার্থক শিক্ষাবিদ ও সমাজসংস্কারক হিসাবে৷ এই ব্যাপারে তথাকথিত রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে তাঁর অমিল হতো বিভিন্ন বিষয়ে৷ তিনি মহান সাধক হিসাবে তীব্র প্রতিবাদী ছিলেন চরম অন্যায় ও অত্যাচারের বিরুদ্ধে৷ তিনি এক দিকে ছিলেন উন্নত আধ্যাত্মিক সাধক, তিনি বিশ্বচরাচরের যিনি মালিক তাঁর গান গেয়ে গেছেন আর সারা বিশ্বের জীবজন্তু গাছপালা সকলকে আপন করে নিয়ে সাহিত্য জগৎ পরিপূর্ণ করে গেছেন তাঁর গানে কবিতায় ও সাহিত্যের জগতে৷ তাঁর প্রেমের স্পর্শে সকলেই সার্থক ও ধন্য হয়েছে৷ মনে পড়ে জালিয়ানওয়ালাবাগের চরম হত্যাকাণ্ডে তিনি ইংরেজ প্রদত্ত নাইট উপাধি ত্যাগ করেন ও সভ্য ইংরেজজাতিকে তিনি ধিক্কার জানান৷ তিনি এই আত্মবিস্মৃত বাঙালী জাতিকে জাগ্রত করতে তীব্র কষাঘাত করতেও ছাড়েননি৷ তিনি ব্যাকুলভাবে সেই প্রার্থনা জানান সেই পরমাত্মা ঈশ্বরকে এই বলে–

বাংলার মাটি বাংলার জল

বাংলার বায়ু বাংলার ফল

পুণ্য হউক পুণ্য হউক পুণ্য হউক হে ভগবান৷

...........................................

বাংলার ঘরে যত ভাই বোন

এক হউক এক হউক হে ভগবান৷’’

তাই কবির এই আন্তরিক প্রার্থনা সেটা যে কতো বড়ো আন্তরিকতাপূর্ণ তা ভাষায় বর্ণনা করা যায় না৷ তিনি নিজেকে এই বাংলার কবি হিসাবে স্বীকার করে দেশবরেণ্য প্রতিভাবান একনিষ্ঠ দেশ সেবক, দেশপ্রেমিক সুভাষচন্দ্র বসুকে ‘নেতাজী’ হিসেবে দেশ মাতৃকার সুযোগ্য সন্তান রূপে ঘোষণা করেন৷ তিনি বাংলার কবি হিসাবে আপোষহীন সংগ্রামী যোদ্ধাকে উপযুক্ত সম্মানে ভূষিত করেন৷ তিনি বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে ১৯০৫ সালে লর্ড কার্জন–এর শাসনকালে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন ও ঐক্য ও সংহতির স্বার্থে রাখিবন্ধন করে সামাজিক সংহতির জাগরণ ঘটান৷ আজ বিচ্ছিন্ন হওয়ার প্রবণতাকে দলীয় নেতারা পরোক্ষ বা প্রত্যক্ষভাবে মদৎ দিচ্ছেন ও দেশকে টুকরো টুকরো করে চলেছেন৷ বিশ্বকবিকে স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায় ও তাঁর সুযোগ্য সন্তান ভারত কেশরী শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় ভাইস চ্যান্সেলর হিসাবে তাঁকে উপযুক্ত সম্মান দেন কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে৷ ও কবির জন্যে বিশেষ ‘চেয়ারে’রও ব্যবস্থা করেন৷ বিখ্যাত কথা সাহিত্যিক শ্রদ্ধেয় শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ও কথাসাহিত্যিক বনফুল তাঁর খুবই কাছের মানুষ ছিলেন৷

শরৎচন্দ্র বলতেন–‘‘আমরা লিখি পাঠকদের জন্যে আর তিনি লেখেন আমাদের জন্যে৷’’ এটা যে কতো বড়ো আত্মোপলব্ধি তা তাঁর মতো সাহিত্যিকই অনুভব করতে পারেন৷

সাহিত্যিক বনফুল তাঁকে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম কবি সাহিত্যিক হিসাবে ঘোষণা করে গেছেন৷ তাঁর মতে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ চিরকালই বিশ্বের সাহিত্য জগতে শাশ্বত সভাপতি হিসাবেই বিরাজমান থাকবেন৷ সর্বকালের সর্ব দেশের তিনিই সার্থক কাব্যজগতে রবির রবি রবীন্দ্রনাথ হিসাবে৷ উজ্জ্বল ভাস্বর হিসাবে অনন্তকাল জাগ্রত রবেন৷