পরিচয় ও প্রজাতি ঃ যে বস্তু রোগ হরণ করে ইত্যর্থে হরি/হরী, আবার শরীরকে তকতকে করে দেয় এই অর্থে তকি/তকী৷ এই ভাবে ‘হরিতকী’ শব্দ পাচ্ছি৷ বানানটি তোমরা চারভাবে লিখতে পার–হরিতকি, হরীতকি, হরিতকী, হরীতকী৷
হরিতকী গাছের নানান প্রজাতি রয়েছে স্থান ভেদে ও আৰহাওয়া ভেদে গাছের উচ্চতার ভিন্নতা রয়েছে৷ ফলেতেও নানান প্রকারভেদ আছে–কেউ গোল, কেউ লম্বা, কেউ শিরাবিহীন৷ কোন হরিতকী অল্প মাত্রায় শিরাযুক্ত, কোন হরিতকী বেশী মাত্রায় শিরাযুক্ত৷ কোন হরিতকীর রঙ ভিন্ন, কারও বা রঙ অভিন্ন কোন হরিতকীর কষাভাব বেশী, কোন হরিতকী কষাভাব নেই বললেই চলে কোন হরিতকীর ৰীজ খুব ছোট ও সরু, কোন হরিতকীর ৰীজ সুপুষ্টু ও খেতে বাদামের মত৷ আকারভেদ, প্রকারভেদ ও গুণভেদে হরিতকীর গোড়ী, মাগধী ও রোহিণী প্রভৃতি নানান নাম রয়েছে৷
কুষ্ঠরোগে হরিতকী ঃ ‘‘হরিতকিঃ মনুষ্যাণাং মাতেব হিতকারিণী৷
কদাপি কুপ্যতে মাতা নোদরস্থা হরিতকিঃ৷৷’’
হরিতকী মানুষের মায়ের সমান হিতকর৷ মা তবু সন্তানের প্রতি কদাপি ক্রুদ্ধা–কুপিতা হন৷ কিন্তু যে হরিতকী মানুষের উদরস্থ হয়েছে তা কখনো কুপিত হয় না৷
কুষ্ঠরোগে হরিতকী ব্যবহারের বিধি দীর্ঘকাল ধরে পরিচিত৷ তাই হরিতকীকে বিশেষ করে গৌড়ী হরিতকীকে ‘কুষ্ঠারি’ বলা হয়৷ প্রত্যহ কিঞ্চিৎ পরিমাণ হরিতকীচূর্ণ গুড় সহ লেহন করে খেলে এই রোগ প্রশমিত হয়৷ ৩–টি বা ৫–টি হরিতকী খণ্ড ভোজন করে অতঃপর গুলঞ্চের ক্বাথ পান করলে কুষ্ঠ রোগ দূরীভূত হয়৷ গোমূত্র সহ হরিদ্রা এক মাস প্রত্যুষে প্রত্যহ পান করলে কুষ্ঠ রোগ থেকে নিষ্কৃতি পাওয়া যায়৷ খাদ্য ও পথ্যের দিক থেকে কুষ্ঠ রোগীর পক্ষে উচ্ছের ফল বা পাতা (করলার গুণ কিছুটা কমগ্গ, পলতা, নিম, শোভাঞ্জনের (শোজনে বা শাজনা) ফুল, পাতা ও ডাঁটা প্রভৃতি কোন একটি প্রাত্যহিক ভোজন তালিকায় থাকা দরকার৷ ঙ্ম কুষ্ঠ যেহেতু প্রধানতঃ অপুষ্টিজনিত রোগ, তাই দারিদ্র্য অধ্যুষিত অঞ্চলে সাধারণ মানুষের মধ্যে ফলচাষ ও সব্জী চাষে উৎসাহ দেওয়া উচিত ও সাহায্য করা উচিত৷ এর ফলে তাদের দারিদ্র্য যেমন দূর হবে, খাদ্যাভ্যাসেও পরিবর্ত্তন আসবে৷ তাতে পুষ্টিরও অভাব কিছুটা হলেও দূর হবে৷ এ জন্যে জলপাই–এর চাষও ৰাড়ানো উচিত৷ কেন না জলপাইয়ের তেল পুষ্টিকর খাদ্য হিসেবে প্রাত্যহিক ভোজনের তালিকায় থাকলে কুষ্ঠ রোগ নিরাময় বা কুষ্ঠ রোগের প্রতিরোধে খুব সহায়তা হবে৷ৰ
কোষ্ঠ পরিষ্কারে ও রক্তের গতি ৰর্দ্ধনে ঃ হরিতকী কোষ্ঠ পরিষ্কার করে বলে এ বিষ্টম্ভিনী রূপেও পরিচিত৷ মধুর মত হরিতকীও রক্তের গতিৰর্দ্ধক৷ অর্থাৎ হরিতকী খেলে মানুষের কর্মতৎপরতা ৰাড়ে, আলস্য কমে৷
অন্যান্য রোগে হরিতকী ঃ (১) গোদুগ্ধে হরিতকীর অস্থি (আঁটি) সেদ্ধ করে (অস্থি ফেলে দিয়ে) ওই দুগ্ধ পান করলে পিত্তাশ্মরী (ণ্ড্ত্রপ্তপ্তত্ব্প্ত্ত্রস্ত্ ব্দব্ধপ্সুন্দ্ব, পিত্ত–পাথুরী) রোগে উত্তম ফল পাওয়া যায়৷
(২) ছাগমূত্র বা গোমূত্রের সঙ্গে হরিতকী চূর্ণ মিশ্রিত করে প্রত্যহ প্রত্যুষে খালি পেটে পান করলে শ্লী–পদ (গোদ–ড্রপ্তন্দ্বহ্মড়্ত্) রোগ প্রশমিত হয়৷
হরিতকী ব্যবহারের বিধি–নিষেধ ঃ যেহেতু হরিতকী রক্তের গতিৰর্দ্ধক, তাই শরীরের ভেতরের দিকে বা বাইরের দিকে কোন ক্ষত থাকলে সেই সময় হরিতকী ব্যবহার না করলেই ভাল হয়৷ যদি করতেই হয়, খুব কম পরিমাণেই ব্যবহার করা উচিত৷ কোন স্ত্রী–ব্যাধি থাকলেও হরিতকী ব্যবহার না করাই ভাল৷
তুলসীর ব্যবহার
পরিচয় ও প্রজাতি ঃ বিশ্বে এক শতাধিক প্রজাতির তুলসী বা চ্ত্রব্দন্প্ত বর্গীয় গাছ রয়েছে৷ তুলসী জন্মায় আইবেরিয়ায় (স্পেন ও পর্তুগাল) সবচেয়ে বেশী৷ ৰাঙ্গালীস্তানের মাটি, জল, আবহাওয়া তুলসীর পক্ষে খুবই উপযোগী৷ শুধু ৰাঙ্গালীস্তান নয়, সমগ্র ভারতের প্রতি গৃহেই তুলসীর গাছ রাখার বিধি, এর ঔষধীয় গুণের কথা ভেবেই৷ সমগ্র তুলসী বর্গীয় গাছের একটা নিজস্ব বর্ণ–গন্ধ আছে৷ যদিও সকল রকম স্বভাবের তুলসীর ৰীজ অনেকটা এক ধরনের ও তুলসী বর্গের মূল গন্ধ সবাইতে আছে, তবুও সবাইকারই স্বকীয় বৈশিষ্ট্য হিসেবে নিজস্ব গন্ধও আছে৷ যে কয়েক প্রজাতির তুলসী ৰাংলার একেবারে স্থানীয় অর্থাৎ ব্যাঞ্জালাইটিস বর্গীয়, তাদের মধ্যে রাধাতুলসী ও বাবুইতুলসী অন্যতম৷ কৃষ্ণতুলসী এসেছে উত্তর ভারত থেকে৷ যে তুলসীর পাতা সবুজ ও একটু বড় আকারের কিন্তু গাছও খুব ৰড় হয় না, তাকে রাধাতুলসী বলে৷ রাধাতুলসী মুখ্যতঃ দু’টি প্রজাতির হয়, তাদের গন্ধেরও তারতম্য আছে৷ পাতার আকার প্রকারেও অল্পসল্প ভেদ আছে৷ একটি প্রজাতির পাতার রঙ ফিকে সবুজ গন্ধ একটু বেশী ও মৃদু ধরনের৷ আর একটি প্রজাতির পাতা আরও ফিকে সবুজ –বলতে পারি সাদাটে সবুজ, তার গন্ধ একটু কম৷ কৃষ্ণতুলসী গাছের আকার রাধাতুলসীর চেয়ে অনেক ৰড়৷ আমি বিহারে একটি ধার্মিক পরিবারের বাড়ীর বাগানে প্রায় দুই মানুষ উঁচু কৃষ্ণতুলসীর গাছ দেখেছি৷ বিশ্বে সব প্রজাতির তুলসীর মধ্যে এরই আকার সব চেয়ে ৰড় হয়৷ গাছ ও ঝাড় রাধা তুলসীর চেয়ে অনেক বেশী৷ পাতা কালচে সবুজ৷ পাতা কখনও মাঝারি ধরনের, কখনও বা কিছুটা ছোট৷ তাতে কালো দাগ রয়েছে৷ বাবুই তুলসীর গন্ধের সঙ্গে অল্প–স্বল্প রক্ত চন্দনের গন্ধের মিল আছে৷ চন্দন তুলসীর গন্ধ অত্যন্ত ঝাঁঝালো যেন ঙ্মচন্দন ওৰ তুলসীর গন্ধের সঙ্গে নাগদোনার ঝাঁঝ মিশে রয়েছে৷ রামতুলসী কালচে রঙেরও হয়, লালচে রঙেরও হয়৷ লালচেগুলি বেশী খরখরে৷ তাই এর পাতার স্পর্শ মোটেই আরামদায়ক নয়৷ গন্ধ খারাপ না হলেও ভাল নয়৷ স্বাদও তেমন ভাল নয়৷ রাবণ তুলসীরও পৃথক বৈশিষ্ট্য রয়েছে৷ ঙ্মরাবণ তুলসীকে কেউ কেউ বলবান তুলসীও ৰলেন৷ এছাড়া আর এক প্রকার তুলসী আছে যার নাম কর্পূর তুলসী৷ এর রসের নির্যাস থেকে কর্পূর পাওয়া যেতে পারে.....কর্পূরের নিজস্ব গাছ তো আছেই৷ৰ
তুলসীর গুণাগুণ ঃ ৰাংলার গ্রামে রাধাতুলসী যতটা জনপ্রিয়, বাবুই তুলসী বা কৃষ্ণতুলসী ততটা জনপ্রিয় নয়৷ সব তুলসীর ঔষধীয় গুণ প্রচুর৷ তবে ঔষধীয় গুণে সবার সেরা রাধাতুলসী, তারপর বাবুইতুলসী, তারপরে চন্দন তুলসী, তারপরে কৃষ্ণতুলসী৷ রাধাতুলসী মানুষের বয়স যত কম থাকে তার ওপরে তত বেশী প্রভাব বিস্তার করে৷ যত বয়স ৰাড়ে রাধাতুলসীর ঔষধীয় প্রভাব তার তুলনায় তত কম হয়৷ মানুষের বয়স যত বেশী হবে কৃষ্ণতুলসীর ঔষধীয় গুণের প্রভাব তত বেশী কাজে লাগবে৷ আর বয়স যত কমতে থাকবে ঔষধীয় গুণের প্রভাব তত কমতে থাকবে ঙ্ম দ্রব্যগুণের ভিত্তিতে চিকিৎসার ক্ষেত্রে কোন বিশেষ রোগে যে প্রকার তুলসী বেশী কার্যকরী, তা না পাওয়া গেলে অন্য প্রকার তুলসী ব্যবহার করলে তত ফল না হলেও অনেকখানি ফল পাওয়া যায়ৰ৷
শিশুদের রোগে রাধাতুলসী ঃ প্রায় পঁচিশ প্রকার শিশু রোগের ঔষধ হচ্ছে এই তুলসী৷ সাধারণভাবে শিশুদের সর্দিজ্বরে ও সর্দিতে মধু সহ রাধা তুলসীর রস বিশেষ কার্যকরী৷ আতুরে শিশুর অসুখ (সর্দি–কাশি) হলে মধু সহ রাধাতুলসী (পাতার রস) খুব কার্যকরী হয়ে থাকে৷
তরুণ বয়সের রোগে রাধাতুলসী ঃ তরুণ বয়সের কয়েকটি ব্যাধির আশ্চর্যজনক ওষুধ হচ্ছে তুলসী, বিশেষ করে রাধাতুলসী৷ ১৬ থেকে ২৪ বৎসর বয়সের ছেলেদের অতি মাত্রায় শুক্রক্ষয়ে এক কনিষ্ঠাঙ্গুলি পরিমাণ রাধাতুলসীর মূল (আসল মূল বা শাখা মূল দুই–ই চলতে পারে অভাবে কৃষ্ণতুলসীর মূল) ছাঁচি পানের সঙ্গে (ৰোঁটা বাদে) খালি পেটে চিবিয়ে খেলে ঔষধটি চমৎকার কাজ দেয়৷ রোগের ৰাড়াৰাড়ি অবস্থায় প্রত্যহ সেবন করতে হয়৷ রোগ সেরে যাবার পরেও চারটি রবিবার ভোরে উঠে খেতে হয়৷
হাঁপানি রোগে বাবুই তুলসী ঃ বাবুই তুলসীর রস শ্বাসরোগের ঔষধ৷ বাবুই তুলসীর গাছে এক ধরনের ছোট পোকা বাসা ৰাঁধে৷ বাসা সমেত ঐ পোকাটি লাল সুতোয় ৰেঁধে পুরুষ দক্ষিণ হস্তে ও নারী বাম হস্তে ধারণ করলে হাঁপানি কষ্টের উপশম হয়৷ যাদের মাতৃকুলে হাঁপানি রোগ আছে তাদের হাঁপানি রোগের সংক্রমণের সম্ভাবনা থাকে৷ প্রাচীন কালের লোকের ধারণা ছিলো হাঁপানি রোগটি মাতৃকুল থেকেই আসে৷ যাই হোক যাদের মাতৃকুলে হাঁপানি রোগ আছে তাদের যদি পাঁচ থেকে পনের বছরের মধ্যে কখনও কোন ধরনের শ্বাসরোগের বা শ্বাসকষ্টের লক্ষণ দেখা যায়, তাহলে ওই শিশু (বা বালক) প্রতি শনিবার খালি পেটে ভোরে এক চামচ বাবুই তুলসীর রস (পাতার রস, গাছের রস নয়) পান করলে তাই থেকে মাতৃকুল সঞ্জাত হাঁপানি রোগের পুনরুদয়ের সম্ভাবনা থাকে না৷
(শ্রীপ্রভাতরঞ্জন সরকারের ‘দ্রব্যগুণে রোগারোগ্য’ থেকে)