হৃদরোগ ও স্ট্রোক ঃ মহিলারা কতটুকু নিরাপদ?

লেখক
এন এন এস

সারা বিশ্বে মৃত্যুর অন্যতম প্রধান কারণ হচ্ছে হৃদরোগ ও স্ট্রোক৷ আমেরিকান হার্ট অ্যাসোসিয়েশনের মতে, হৃদরোগ ও স্ট্রোকজনিত মৃত্যু হার মহিলাদের মধ্যে পুরুষের তুলনায় বেশি ও তা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে৷ মাহিলাদের মৃত্যুর কারণ হিসেবে হৃদরোগ ও স্ট্রোক বহুল আলোচিত স্তন ক্যান্সারের তুলনায় আটগুণ বেশি৷ তাই বিশ্ব হার্ট দিবস ২০১১ এর প্রতিপাদ্য বিষয় ঃ হৃদরোগ, স্ট্রোক ও নারী৷ হূৎপিন্ড ও মস্তিষ্কের রক্তনালীতে সৃষ্ট প্রতিবন্ধকতা বা এথেরোক্লোরোসিসই করোনারি হৃদরোগ ও স্ট্রোকের জন্যে দায়ী৷ রক্তপ্রবাহের এই প্রতিবন্ধকতা যখন গুরুতর ও জটিল আকার ধারণ করে তখন দেখা দেয় হার্ট্যাটাক ও স্ট্রোক৷ এ প্রক্রিয়ায় জড়িত রয়েছে রক্তের উচ্চ কোলস্টেরল, উচ্চ রক্তচাপ, ধূমপান, ডায়াবেটিস্, মেদবাহুল্য, অলস জীবনযাপন ইত্যাদি৷ প্রধান বিপদ উচ্চ কোলস্টেরল ঃ মেয়েলি হরমোন ইষ্ট্রোজেন রজঃনিবৃত্তির আগ পর্যন্ত মহিলাদের রক্তে কোলস্টেরলের মাত্রা সীমিত রাখে ও হৃদরোগ ও স্ট্রোক থেকে এক ধরনের প্রাকৃতিকভাবে নিরাপত্তা দেয়৷ কিন্তু রজঃনিবৃত্তির পর এই নিরাপত্তা আর থাকে না৷ রক্তে কোলস্টেরল বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে হৃদরোগ ও স্ট্রোকের ঝুঁকিও বাড়তে থাকে সমানতালে৷উচ্চ রক্তচাপ ঃ সিস্টোলিক ও ডায়াস্টোলিক দুধরনের রক্তচাপ বৃদ্ধিই করোনারি হৃদরোগ ও স্ট্রোকের ঝুঁকি বৃদ্ধি করে৷ উচ্চ রক্তচাপ হূৎপিন্ড ও মস্তিষ্কের রক্তক্ষরণ ঘটায় ও হৃদপেশিকে মোটা ও দুর্বল করে ফেলে৷ জন্মনিয়ন্ত্রণ বড়ি ব্যবহারে রক্তচাপ বাড়তে পারে৷ কখনো গর্ভজনিত কারণে রক্তচাপ দেখা দেয়, যা পরবর্তী সময়ে থেকে যেতে পারে৷

ধূমপান ঃ

এতে হৃদযন্ত্র ও মস্তিষ্কে রক্ত চলাচল বিঘ্ণিত হয় ও রক্ত জমাট বাঁধার প্রবণতা বেড়ে যায়৷ ধূমপায়ী মহিলাদের কম বয়সে রজঃনিবৃত্তি ঘটে৷ ফলে তারা কম বয়সেই হার্ট্যাটাক ও স্ট্রোকের শিকার হন৷ ধূমপান ছাড়াও বিভিন্নভাবে তামাক সেবন যেমন – পানের সঙ্গে সাদা জর্দা ও পরোক্ষ ধূমপান বিশেষত স্বামী ধূমপায়ী হলে– হৃদরোগ ও স্ট্রোকের ঝুঁকি বাড়ে৷ ধূমপায়ী মহিলারা জন্মনিয়ন্ত্রণ বড়ি ব্যবহার করলে রক্তের জমাট বাঁধার আশঙ্কা অনেক বেড়ে যায়৷ এভাবে জন্মনিয়ন্ত্রণ বড়ি সেবনকারী ধূমপায়ী মহিলারা হার্ট্যাটাক ও স্ট্রোকের শিকার হন৷

ডায়াবেটিস ঃ

ডায়াবেটিস আছে এমন মহিলারা রজঃনিবৃত্তির আগেই হার্ট্যাটাক ও স্ট্রোকে আক্রান্ত হতে পারে৷ এদের হার্ট্যাটাকের আশঙ্কা সমবয়সী অন্য মহিলাদের দ্বিগুণ৷ হার্ট্যাটাক ও স্ট্রোকের জটিলতা ও মৃত্যু ঝুঁকিও এক্ষেত্রে ডায়াবেটিক রোগী পুরুষের তুলনায় বেশি৷

অন্যান্য ঝুঁকিপূর্ণ উপাদান ঃ

অতিরিক্ত মেদ ঃ পুরুষের তুলনায় মহিলারা মেদ সমস্যায় বেশি ভোগেন৷ বিশেষ করে রজঃনিবৃত্তির পর৷ উচ্চ কোলস্টেরল, ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ এসবই মেদ বাহুল্যের সঙ্গে সরাসরি সম্পর্কযুক্ত৷ এভাবে তা হৃদরোগ ও স্ট্রোকের ঝুঁকি বৃদ্ধি করে৷

অলস জীবনযাত্রা ও ব্যায়ামের অভাব ঃ

নিয়মিত ব্যায়াম হৃদরোগ ও স্ট্রোকের ঝুঁকি কমায়, হৃদযন্ত্র ও দেহের সামগ্রিক সুস্থতা দান করে৷ শারীরিকভাবে সচল ও কর্মমুখর মহিলাদের মেদবাহুল্য কম থাকে, তাদের রক্তের গ্লুকোজ ও কোলস্টেরল প্রত্যাশিত মাত্রায় বজায় থাকে ও রক্তচাপ নিয়ন্ত্রিত থাকে৷ দৈনন্দিন কাজের মাধ্যমে কায়িক শ্রম বাড়িয়ে ব্যায়ামের সুফল পাওয়া সম্ভব৷

সামাজিক ও মানসিক অবস্থা ঃ

নিম্ন সামাজিক–র্থনৈতিক অবস্থাসম্পন্ন মহিলাদের মধ্যে হার্ট্যাটাক ও স্ট্রোক বেশি দেখা যায়৷ সাধারণত এরা ধূমপান ও তামাক বেশি সেবন করে, কম স্বাস্থ্যসচেতন হয়৷ আবার গৃহিণীরা কর্মজীবী মহিলাদের চেয়ে বেশি হৃদরোগ ও স্ট্রোকে আক্রান্ত হয়৷ কর্মজীবী মহিলারা শারীরিকভাবে বেশি সচল৷ হতাশা মহিলাদের ক্ষেত্রে পুরুষের চেয়ে বেশি দেখা যায়, যা মেদ বাহুল্যের জন্যেও দায়ী৷ এতে হৃদরোগ ও স্ট্রোকের ঝুঁকি বাড়ে৷

জন্মনিয়ন্ত্রণ বড়ি সেবন ঃ

এতে রক্ত জমাট বাঁধার প্রবণতা বৃদ্ধি পায়৷ দীর্ঘমেয়াদি ব্যবহারে রক্তচাপ ও রক্তের কোলস্টেরল বাড়তে পারে৷ জন্মনিয়ন্ত্রণ বড়ি ব্যবহারকারী ধূমপায়ী মহিলাদের হৃদরোগ ও স্ট্রোকের আশঙ্কা অত্যন্ত বেশি৷গর্ভাবস্থা ঃ শতকরা পাঁচ সাতজন মহিলা গর্ভাবস্থায় উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত হয়৷ কখনো তা গর্ভ পরবর্তী সময়ে থেকে যায়৷ এ সময় রক্ত জমাট বাঁধার প্রবণতা বেড়ে যায়, যা হৃদরোগ ও স্ট্রোক ত্বরান্বিত করতে পারে৷ গর্ভজনিত কারণে কখনো কখনো হৃদপেশির দুর্বলতা বা কার্ডিওমায়োপ্যাথি দেখা দেয়৷

হৃদরোগের কারণে স্ট্রোক ঃ

বাতজ্বরজনিত ভাল্বের রোগ মাইট্রাল স্টেনোসিস মহিলাদের ক্ষেত্রে পুরুষের তুলনায় বেশি দেখা যায়৷ এ অবস্থা দীর্ঘদিন ধরে চলতে থাকলে তা স্ট্রোকেরও কারণ হতে পারে৷ অন্যান্য ভাল্বের রোগ ও জন্মগত হৃদরোগের জটিলতা হিসেবে স্ট্রোক দেখা দিতে পারে৷

নিয়ন্ত্রণ ঃ

জীবনমাত্রা পরিবর্তন করে ঝুঁকিপূর্ণ দিকগুলো নিয়ন্ত্রণে রাখলে মহিলাদের হৃদরোগ ও স্ট্রোক অনেকাংশে প্রতিরোধ সম্ভব৷ মহিলাদের ধূমপান, সাদা জর্দাসহ সব ধরনের তামাক দ্রব্য বর্জন করতে হবে৷ নিয়মিত ব্যায়াম দৈনিক ২০ থেকে ৩০ মিনিট, সপ্তাহে অন্তত ৪ দিন৷ তাড়াতাড়ি হাঁটাই মহিলাদের জন্যে উপযুক্ত ব্যায়াম৷ হৃদরোগ ও স্ট্রোক প্রতিরোধ ছাড়াও হার্ট্যাটাক ও স্ট্রোক পরবর্তী পুনর্বাসন প্রক্রিয়ায় ব্যায়াম কার্যকর ভূমিকা রাখে৷ খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তন, খাদ্যে লবণ সীমিত করা উচ্চ রক্তচাপ প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণে কার্যকরী৷ প্রাণিজ চর্বি ও মাংস পরিহার করা, খাদ্য তালিকায় অধিক পরিমাণে মাছ, শাকসবজি ও ফলমূল অন্তর্ভুক্ত করা, রান্নার কাজে প্রাণিজ তেল ও ঘিয়ের বদলে উদ্ভিদজাত তেল ব্যবহার করা হৃদরোগ ও স্ট্রোকের ঝুঁকি প্রতিরোধে সক্ষম৷