কাল ইতিহাস সম্বন্ধে কিছু ৰলেছিলুম৷ ৰলেছিলুম, কৰে কোন্ রাজা এসেছিলো, কৰে কোন্ রাজা কোন দেশ আক্রমণ করেছিলো, কৰে কোনরাজা তার প্রজাদের ওপর অত্যাচার করেছিলো, কৰে কোন রাজা মারা গেলো--আজ কালকার ইতিহাসে সাধারণতঃ এই সব কথাই লেখা থাকে৷ সাধারণ মানুষের এসব জেনে লাভটা কী? এইজন্যে এই ধরণের ইতিহাস পড়তে তাদের মোটেই ভালো লাগে না৷ ইতিহাস হৰে সমগ্র মানব জীবনের ইতিহাস৷
ইতিহাস শব্দের স্বীকৃত সংজ্ঞা হ’ল---‘‘ইতি হসতি ইত্যর্থে ইতিহাসঃ’’ অর্থাৎ সামূহিক জীবনের একটা উজ্জ্বল প্রতিচ্ছবি যা পাঠ করে ভবিষ্যতের মানুষ বিশেষ প্রেরণা পাৰে৷ ‘ইতি হসতি’- অর্থ হ’ল গৌরবোজ্জ্বল মানব মহিমার জাজ্বল্যমান দৃষ্টান্ত৷ মানুষের জীবনকে একক ফুলের সঙ্গে তুলনা করতে পারি না, বরং ফুল বাগিচার সাথে তুলনা করা যেতে পারে৷ একটা ফুল বাগানে কত ভিন্ন ভিন্ন ফুল! গন্ধে, বর্ণে কত বৈচিত্র্য! আর ভিন্ন ভিন্ন ফুলকে নিয়েই একটা বাগান৷ ইতিহাসও তেমনি৷ সেখানে দেশগত, কালগত, পাত্রগত কত বৈচিত্র্য৷ আর এই বৈচিত্র্য হ’ল ইতিহাসের সৌন্দর্য৷ এই বৈশিষ্ট্যকে আমরা নষ্ট হতে দিতে পারি না, জোর করে বাইরে থেকে কারুর ওপর আমরা কিছু চাপিয়েও দিতে পারি না৷ নিজের নিজের শক্তিতে প্রত্যেকে এগিয়ে চলৰে ও সামূহিক জীবনকে চরিতার্থ করৰে- এটাই হ’ল ইতিহাসের মূল মন্ত্র৷
ইতিহাস লিখতে গিয়ে আমাদের এই কথাটা মনে রাখতে হৰে যে মানুষের জীবনে বহুতর দিক রয়েছে ও ইতিহাসে যেন সব দিকেরই যথোপযুক্ত নির্দেশনা থাকে৷ কোনো বিশেষ যুগে মানুষের শিক্ষা-ব্যবস্থা, সাংস্কৃতিক মান, ভাব-ভাবনা, পোশাক-পরিচ্ছদ, নারী জাতির অবস্থা, সামাজিক তথা-অর্থনৈতিক বিধি ব্যবস্থায় নারীর ভূমিকা, সমাজে দুর্বল অনুন্নত সম্প্রদায়ের অবস্থা ---ইতিহাসে এগুলোই আলোচিত হওয়া দরকার৷ ইতিহাস লিখতে গিয়ে যদি এগুলোর কোন একটা বাদ পড়ে যায় তাহলে সেটা যথার্থ ইতিহাস হৰে না৷
ইতিহাসের আর একটা বহুল প্রচলিত সংজ্ঞা হ’ল
‘‘ধর্মার্থকামমোক্ষার্থ নীতিবাক্য-সমন্বিতম্
পুরাবৃত্তকথাযুক্তমি প্রচক্ষতে৷’’
যে শাস্ত্র মানুষের আধ্যাত্মিক চেতনা ৰাড়ায়, তার বৌদ্ধিক প্রাখর্য আনে, যা সাহিত্য, শিল্প, বিজ্ঞান, প্রযুক্তিবিদ্যা, সমাজবিদ্যা ইত্যাদি জনকল্যাণকর জ্ঞানবিজ্ঞানের প্রসার ঘটায় ও যা মানুষকে এক সূদৃঢ় ভূমিতে প্রতিষ্ঠিত করে তাই ইতিহাস পদবাচ্য৷
এখন দেখা যাক ইতিহাস কীভাবে লেখা হয় বা লেখানো হয়৷ বেশীর ভাগ ক্ষেত্রেই এক বিশেষ সুবিধাবাদী গৌষ্ঠীর স্বার্থে ইতিহাস লেখানো হয়৷ যুগ বিশেষের গৌরবকে প্রতিষ্ঠার জন্যে ইতিহাসের পঠন-পাঠনের ব্যবস্থা করা হয়৷ যেমন, ক্ষত্রিয় যুগের ক্ষত্রিয়ের বীরত্বের কাহিনী, তাদের কলা- কৌশল নিয়েই সে যুগের ইতিহাস রচিত হয়৷ ইতিহাসের পাতাগুলো কেবল ক্ষত্রিয়দের শৌর্য-বীর্যের গুণ গানেই ভরা৷ তেমনি বিপ্র যুগের ইতিহাসে কেবল বিপ্রদের মহিমারই বর্ণনা আছে৷ আবার বৈশ্য যুগেও শুধু বৈশ্যর মহিমা বর্ণনায়, বৈশ্যের গালগল্পে ইতিহাসের পাতা ভরাট থাকে৷ এই ধরণের একপেশে ইতিহাস পড়তে পাঠকের মোটেই আগ্রহ থাকে না, ধৈর্য থাকে না৷ অধিকন্তু এই ধরণের ইতিবৃত্ত পাঠ করলে মনের মধ্যে এক ধরণের ভাবজড়তা dogma) বাসা বাঁধে ও ফলস্বরূপ মনের স্বাভাবিক বৃদ্ধিবৃত্তির বিকাশও রুদ্ধ হয়ে পড়ে৷
ইতিহাসের পঠন-পাঠন অবশ্যই হওয়া চাই৷ কিন্তু সেই ইতিহাস হবে সত্যিকারের ইতিহাস, কোন বিশেষ শ্রেণীর, কেন বিশেষ রাজা বা মন্ত্রীর ইতিহাস নয়৷ আর এই যে শ্রেণী বিশেষের ইতিহাস, এই ইতিহাস বিশেষ বিশেষ দেশের শাসক গোষ্ঠীর নির্দেশেই লিখিত৷ এই ধরণের একাদেশদর্শী ইতিহাস পড়াটা সমাজের পক্ষে ক্ষতিকর৷ বরং এই ধরণের ইতিহাস না পড়াই ভালো৷
এই যুগের মানুষ বুদ্ধিদৃপ্ত৷ তোমাদের বুদ্ধি অন্য কারুর চেয়ে কম নয়৷ তাই তোমরা সম্মিলিত প্রয়াসের দ্বারা মানব জাতির নোতুন ইতিহাস রচনা করো৷ বিভিন্ন যুগে বিবর্তনের ভেতর দিয়ে মানব সমাজ কীভাবে এগিয়ে চলেছিলো, চলার পথে মানুষ জাতিকে কী কী অসুবিধার সম্মুখীন হতে হয়েছিলো আর কী ভাবেই ৰা তারা ওই সমস্ত ৰাধা বিপত্তি অতিক্রম করে আপন লক্ষ্যের দিকে অবিচলিত পদক্ষেপে এগিয়ে চলেছিলো বা আজও তারা কীভাবে নানান সমস্যার সমাধান করতে করতে এগিয়ে চলেছে---এইসব বিষয় যেন পরিষ্কার ভাষায় তোমাদের আগামী দিনের রচিত ইতিহাসে স্থান পায়৷
(সকালৰেলা, ২৮শে জানুয়ারী, ১৯৮০, পটনা)