সদাশিবের আবির্ভাবের প্রায় সাড়ে তিন হাজার বছর পরে আর এক জ্যোতির্ময় পুরুষ, দেবকী-বসুদেব নন্দন কৃষ্ণের আবির্ভাব৷ তাঁর আবির্ভাবের উদ্দেশ্য সম্পর্কে তাঁর নিজের কথায়
‘‘যদা যদা হি ধর্মস্য গ্লানির্ভবতি ভারত৷
অভ্যুত্থানমধর্মস্য তদাত্মানং সৃজাম্যহম্৷৷
পরিত্রাণায় সাধুনাং বিনাশায় চ দুষৃকতাম্৷
ধর্মসংস্থাপনার্থায় সম্ভবামি যুগে যুগে ৷৷
অর্থাৎ পৃথিবীতে যখন ধর্মের অধগতি হয়, মানুষ যখন তার স্বধর্ম (মানব ধর্ম, মানে মানুষের সত্তাগত বৈশিষ্ট্য) থেকে বিচ্যুত হয়ে অধর্মের পথে চলতে থাকে, অধার্মিকদের অন্যায়-অত্যাচারে মানুষ অতিষ্ট হয়ে ওঠে তখন দুষ্টুদের দমন করে শিষ্টদের পালন করার জন্যে ও ধর্মসংস্থাপনের জন্যে তিনি ধরাধামে অবতীর্ণ হবেন৷ কার্যতঃ ধর্ম ভাবনায় কৃষ্ণ হলেন শিবেরই পারস্পরিক নবকল্লিত উত্তরপুরুষ৷ শিব যেমন চেয়েছিলেন ধর্ম আধারিত প্রকৃত মানুষের সমাজ গড়তে, কৃষ্ণ সেই ভাবনাকে আর একধাপ এগিয়ে দিলেন৷ শিব মানুষকে ধর্মসাধনার-বিজ্ঞান দান করলেন, দিলেন তার কাল্ট বা প্রকরণ, আরও দিলেন সমাজ সংরচনার ‘‘ষড়রাঃ সমাজচক্রঃ’’ --- (অধ্যাত্ম আদর্শ, অধ্যাত্ম-সাধনা, সামাজিক অর্থনৈতিক তত্ত্ব, সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গী বা সমাজ সচেতনতা, শাস্ত্র ও গুরু)৷ এই ছয়টি ‘অর’ বা চাকার-পাখি (স্পোক্) সমাজ-চক্রের আবশ্যিক দৃঢ়ী-সত্ত বা বাঁধনি৷ কিন্তু সমাজের ভিত গড়তেই তাঁর কাল কেটে যায়,আধুনিক বিচারে সমাজ সচেতনতা সৃষ্টি করে যাওয়ার সময় তিনি পাননি, সে যুগ সামাজিক অর্থনৈতিক তত্ত্ব দেওয়ারও যুগ ছিলনা৷ যা সমাজ সংবদ্ধতার একটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বাঁধনি বা অর বা স্পোক৷ কেননা সামাজিক অর্থনৈতিক সুষ্ঠু ব্যবস্থা ছাড়া সুষ্ঠু সমাজ গড়ে তোলা যায় না৷ আর প্রতিটি প্রাণীই একই বিশ্বপিতার সন্তান৷ তারা একই ভ্রাতৃত্ব বন্ধনে আবদ্ধ৷ সামাজিক অর্থনৈতিক তত্ত্ব মূল্যহীন হয় যদি না এই ভ্রাতৃত্ব বোধ থাকে৷ কৃষ্ণ সামাজিক অর্থনৈতিক তত্ত্ব দেননি বা দেওয়ার সুযোগ-সময় পাননি৷ কিন্তু কৃষ্ণ সমাজচেতনা এনে দিয়েছেন৷ তিনি বলেছেন--- তুমি মানুষ যুথবদ্ধ জীব, একলা থাকার নয়, একই ভাবনায় চলবে, একই সঙ্গে শত্রুর মোকাবিলা করবে, একই সঙ্গে যাবতীয় সমস্যার সমাধান করবে৷ শুধু রচনাত্মক পথে সমাজের কল্যাণ করা যায় না, সৈরী বা আত্মকেন্দ্রিক মানসিকতাও সামূহিক কল্যাণের পরিপন্থী৷ তাই চাই বিরাটের প্রতি ভালবাসা, বিরাটের কাছে যাওয়ার অন্তহীন প্রয়াস---যা ধর্ম সাধনার বা আধ্যাত্মিকতার অঙ্গ৷ তাই শ্রীকৃষ্ণ গীতায় সমাজ থেকে ছেড়ে যাওয়া ধর্ম বা আধ্যাত্মিকতা সংস্থাপনার কথা বলেছেন৷ ধর্মরাজ্য প্রতিষ্ঠার সঙ্কল্পেই তাঁর আবির্ভাব৷ এ ধর্ম যে মানুষের সত্তাগত বৈশিষ্ট্য বা গুণ, মানুষ জাতের (স্পিশীজ) এর ধর্ম, মানব ধর্ম তা বলার অপেক্ষা রাখে না৷
এ প্রসঙ্গে দু’টো বিষয় লক্ষ্যনীয়, ১) এইযে ধর্ম--- এর দুটো দিক রয়েছে, একটা হলো মানুষ জাতের ব্যষ্টি মানুষের সত্তাগত ধর্ম, আর দুই হলো মানুষ জাতের সামাজিক মানুষের পরিচয়ের ধর্ম অর্থাৎ সমাজে সমাজবদ্ধ জীব হিসেবে মানুষ পারিবারিক পরিচয়ে পিতা, মাতা, কন্যা, জায়া ভ্রাতা, ইত্যাদি, সামাজিক বা পেশগত পরিচয়ে কৃষক, শ্রমিক, ডাক্তার, শিক্ষক, দোকানি, রিকসা চালক, প্রত্যেকেরই স্বতন্ত্র ধর্ম আছে---যা ছেড়ে গেলে সমাজে গ্লাণি, বিপর্যয় আসতে বাধ্য৷ একে এক কথায় বলা যেতে পারে মানুষের সামাজিক পরিচয়ের সামাজিক ধর্ম৷ সামাজিক বা পেশাগত বা কর্ম-প্রকরণগত ধর্মও সমাজ হারিয়েছিল, বর্তমানেও হারিয়েছে৷ এটা ব্যতিরেকে ধর্ম পুনঃস্থাপন, বা ধর্মরাজ্য প্রতিষ্ঠা কী সম্ভব! আকাশ কুসুম কল্পনা মাত্র৷ কেননা এই ধর্মের অন্তরে লগ্ণ হয়ে আছে চারটি ভাব---দায়বদ্ধতা, সেবা, কল্যাণ বা প্রগতি ও অন্যের সামাজিক ধর্মপালনে শ্রদ্ধা আর মান্যতা৷ দায়বদ্ধতা থেকেই সেবার প্রেরণা আসে, সেবার লক্ষ্য কল্যাণ, কল্যাণ মাত্রা পায় অন্যের সত্তাগত ও সামাজিক ধর্মপালনে মান্যতা ও শ্রদ্ধার্ঘ্যে৷ আর এর সংবেদ বা আকর্ষন হচ্ছে জ্ঞান ও কর্ম সমন্বিত ভক্তি (ভক্তির সমিকরণটা= জ্ঞান+ কর্ম৷ কর্ম বেশি হল, জ্ঞান কম হল---তাহলে কর্মের বাড়তিটা হচ্ছে অহংকার আবার জ্ঞান বেশী হল, কর্ম কম হল, তাহলেও জ্ঞানের বাড়তিটা হবে অহংকার৷ সুতরাং জ্ঞান ও কর্মের সমন্বয়েই ভক্তিমার্গের উদ্ভব৷ আর এগুলোর সঞ্চালক শক্তি ধর্মসাধনা বা আধ্যাত্মিকতা (স্পিরিচ্যুয়াল্ কাল্ট)৷ কাজেই আধ্যাত্মিকতা ছাড়া ধর্মরাজ্য সংস্থাপনা যেমন সম্ভব নয়, তেমনি মানুষের প্রকৃত সেবা বা কল্যাণ করাও সম্ভব নয়৷
প্রাসঙ্গিকভাবেই এসে যাচ্ছে দুটি বিষয়--- ১) কৃষ্ণ চরিত্রের দুটো দিক একটা হল বাল্য ও কৈশরে বৃন্দবনের বা ব্রজের কৃষ্ণ, অন্যটা হল মথুরা-দ্বারকার রাজা কৃষ্ণ বা পার্থসারথি কৃষ্ণ৷ বৈষ্ণবদের কাছে, তথাকথিত কৃষ্ণভজা প্রেম-ভক্তিবাদীদের কাছে পার্থসারথী কৃষ্ণের কোন গল্প নেই৷ কথিত কৃষ্ণভজা প্রেম-ভক্তিবাদীদের কাছে পার্থসারথী কৃষ্ণের কোন গল্প নেই৷ কৃষ্ণ চরিত্র মাধুর্য ভরা৷ কিন্তু কৃষ্ণ চরিত্রের আসল মাধুর্যই তাদের কাছে অধরা৷ এ মাধুর্য কেবল ভক্তের ভগবানের নয়, ‘‘এ মাধুর্য হলো হৃদয়বত্তার মাধুর্য৷ সবাইকার কল্যাণ করবো, সবাইকে পাপীর হাত থেকে মুক্ত করবো, সবাইকে নিশ্চিন্ত মনে প্রশ্বাস নিতে দেবো---এই ভাবনা, এটাই মাধুর্য৷ ‘‘ মহাভারত রচনা করা, সমাজের বুক থেকে অধর্মকে উৎখাত করে, অন্যায়-অবিচার নাশ করে ধর্মরাজ্য প্রতিষ্ঠার দৃঢ় সংকল্প পালনার্থেই তাঁর ধরাধামে আসা৷ অথচ নিছক কৃষ্ণপ্রেম-ভক্তির ধবজাধারীরা মধুর রসের ন্যাজা ছুঁয়ে কান্তাপ্রেমের ভনভনানিতে স্থূল লৌকিক প্রেমের আধারে কৃষ্ণ চরিত্রকে গণমুখী করতে গিয়ে লোক সমক্ষে কৃষ্ণকে কলঙ্কিতই করেছে৷ ফাইট ইজ্ দ্য এসেন্স অব্ লাইফ্’--- কিন্তু সেই সংগ্রামে বিমুখ হয়ে, সংগ্রাম করার ভয়ে নৈষ্কর্মবাদকে আঁকড়ে ধরে জগৎ ও জীবনের প্রতি সামাজিক দায়বদ্ধতাকেও বিসর্জন দিয়েছে৷ কৃষ্ণ চরিত্রের গভীরে যাওয়ার সদিচ্ছা হয়নি, নেইও৷ কার্যতঃ ভূয়োদর্শিতার বিচারে--- জগতে মানুষের সামূহিক কল্যাণে মানুষের সমাজে একটা আধ্যাত্মিকতা ভিত্তিক অখণ্ড আর্থ-সমাজ-রাজনৈতিক দৃঢ় ভিত্তি অবশ্যই দরকার৷ পার্থসারথি কৃষ্ণ তারই প্রবক্তা, কৃষ্ণ চরিত্রের গভীরে যাওয়ার সদিচ্ছা হয়নি, নেইও৷ কার্যতঃ ভূয়োদর্শিতার বিচারে---জগতে মানুষের সামূহিক কল্যাণে মানুষের সমাজে একটা আধ্যাত্মিকতা ভিত্তিক অখণ্ড আর্থ-সমাজ-রাজনৈতিক দৃঢ়ভিত্তি অবশ্যই দরকার৷ পার্থসারথি কৃষ্ণ তারই প্রবক্তা, কৃষ্ণ কুরুক্ষেত্রের মহারণের দৃষ্টান্তে তাকেই মাত্র দিয়েছেন৷ ধর্ম সংস্থাপনের প্রচেষ্টার এটা ছিল একটা প্রকরণ৷ (ক্রমশ)
- Log in to post comments