(আগের সংখ্যার আলোচনার পর)
আজ ককেশীয় রক্ত ও মঙ্গোলীয় রক্তের মিশ্রণ ঘটায় তাঁদের গাত্রবর্ণে পরিবর্তন অবশ্যই এসেছে, আকারে প্রকারে তফাৎ অবশ্যই এসেছে৷ কিন্তু মুখ্যতঃ আকারে রাঢ়ী৷ জাত–বাঙাঙ্গলীরা যদি হয় খাঁটি সোণা, তা হলে তথাকথিত উচ্চ–বর্ণীয়েরা বিশেষ করে কায়স্থরা সেই সোণার ওপর একটি চক্চকে ধরনের মিনের কাজ (enameled gold)৷
ককেশীয় আর্যদের দ্বিতীয় বাসভূমি হ’ল ককেশাস, ইয়ূরাল ও আংশিকভাবে ভালগা নদীর অববাহিকা৷ ভূমির কঙ্করময়তা ও শৈত্যাধিক্যের দরুণ বৎসরের অনেক সময়েই তাদের নিষ্ক্রিয় হয়ে থাকতে হ’ত.....খাদ্যের চিন্তায় তাদের ব্যতিব্যস্ত করে দিত ও অতিমাত্রায় মাংসভোজী হতে বাধ্য করত৷ জীবনধারণের তাড়নায় তাই তারা বেরিয়ে পড়ল নবদেশের সন্ধানে নব সূর্যের আহ্বানে৷ এবার হ’ল তারা দক্ষিণমুখী৷ হ্যাঁ, ককেশীয় আর্যদের যে শাখাটি পশ্চিমমুখী হয়েছিল তারাই বর্তমানে ইযূরোপীয়ান বা ইয়ূরো–এরিয়ান৷ যারা দক্ষিণমুখী হ’ল তারা হ’ল ইয়ূরো–ইরানিয়ান বা আর্য–পারসিক৷ পারস্য দেশে তারা কিছুকাল থমকে দাঁড়াল৷ তারপর একটি শাখা পারস্যে থেকেই গেল৷ তারা ককেশীয় শাখার পাশাপাশি থেকে যাওয়ায় আকারে–প্রকারে অনেকখানি ককেশীয়দের কাছাকাছি থেকে গেল৷ গায়ের রঙের জেল্লা–জৌলুষ ততটা রইল না ঠিকই, তবে গাত্রবর্ণে শ্যামবর্ণ বা কৃষ্ণবর্ণ তারা হয়নি৷ এদেরই আরেকটি শাখা হ’ল পূর্বাভিমুখী৷ তারা গান্ধারদেশ, কশ্মীর–সন্তসিন্ধু (পঞ্জাব), হরিৎধান্য হয়ে প্রবেশ করল গঙ্গা–যমুনার অববাহিকায় ব্রহ্মাবর্তে ও ব্রহ্মর্ষিদেশে৷ এবার তারা চলল পূর্বাভিমুখে৷ তাঁদের রক্তের ছাপ, রক্তের ছোঁয়াচ কিছুটা লাগল রাঢ়ের কায়স্থদের অস্থি–মজ্জায়–চর্মে–চ্৷ রাঢ়ী কায়স্থরাই পদ্মা পার হয়ে হ’ল বঙ্গজ কায়স্থ, মহানন্দা পেরিয়ে হ’ল বারেন্দ্র কায়স্থ (কলিতা)৷ বাঙলার সমস্ত কায়স্থ সাবেকী রাঢ়ী কিন্তু তাতে ককেশীয় আর্যদের ছাপ কিছুটা রয়ে গেছে৷ তাঁরা যদি নিজেদের বহিরাগত বলে ভাবেন তাহলে তাঁরা ভুল করবেন৷
আসল কথায় আবার ফিরে আসি৷ ককেশীয় আর্যদের পিতৃভূমি ছিল কঙ্করময় অনুর্বর এলাকা৷ আর্যরা যখন চাষ করতে শিখল অতিকষ্টে তাঁরা ফলালেন যই (‘যবকা’ ঃ oats) ও যব (বার্লিক ঃ barley)৷ পেটের দায়ে তাঁরা ওই সব জিনিস অবশ্যই খেতেন, যেমন খেতেন নির্দ্বিধায় পশু বধ করে তাদের যকৃৎ, প্লীহা, হৃদপিণ্ড৷ সিংহ–নেকড়ে–হায়েনা তাঁদের খাদ্যতালিকা থেকে বাদ পড়ত না (ওটা ঠাণ্ডা দেশ....বাঘের দেশ নয়, নইলে তাঁরা বাঘকেও খেত)৷ খাদ্যের সন্ধানে পারস্যে এসে তাঁরা এলেন ধানের ও গমের সংস্পর্শে৷ মনে রেখো, ধানের সংসৃক্ত ‘ধান্য’ নয়, –ব্রীহি৷ ‘ধান্য’ মানে শষ্প, অর্থাৎ সবুজ গাছপালা বা green vegetation৷ ‘ব্রীহি’ শব্দের অর্থ হ’ল মুখ্য খাদ্য৷ ধানের স্বাদ পেয়ে আর কি কারোর জিবে যব–যই রোচে৷ তাঁরা ধানের নাম দিলেন ‘ব্রীহি’৷ পরবর্তীকালে লাতিনে হয়ে দাঁড়াল ‘ব্রীহি’...বর্তমান ইংরেজী rice বা রাইস এসেছে স্কাণ্ডিনেবিয়ার এ্যাংলো–স্যাক্সনদের মুখের বাহকতায়৷ ধানকে বলা হয় ‘ব্রীহি’ কারণ ধানের মাধ্যমে তাঁরা পেলেন নানান ধরনের ভোজ্য–মুড়ি (‘হুড়ম্ব’ বা ‘হুড়ুম্বু), রুটি (রোটিকা), চাপাটি (চর্পটিকা), পুরি (সোমালিকা), লুচি (সক্কুলী বা সঙ্কুলী), পরোটা (প্রিয়রোটিকা বা পররোটিকা), চিঁড়ে (চিপিটকম্), খই (লাজ বা খাদিকা ঃ খদিকা > খইআ > খই ঃ মদিকা > মইআ > মই), সুজি (স্বাদজিৎ), চাল (তণ্ডুল), ভাত ও (দনম্) প্রভৃতি৷
তোমরা যারা ব্যাকরণ ভাল জানো তারা নিশ্চয়ই জানো, যে সমাসে অনেক ভাবের খোরাক রয়েছে তাকে বলে বহুব্রীহি সমাস অর্থাৎ বহুপ্রকারের খাদ্য তাতে মজুদ রয়েছে৷ বহুব্রীহি সমাসের ব্যাসবাক্যে থাকে ‘যাহার’ বা ‘যাহাতে’, সংসৃক্তে ‘যস্য’ বা ‘যস্মিন’৷ আর্যরা দেশটাকে ভালবেসে ফেললেন৷ তোমরা কোন দেশকে ভাসবাস কখন? যদি দেখ সেখানকার পরিবেশটা ভাল, আবহাওয়া ভাল, নৈসর্গিক দৃশ্য ভাল, তার সঙ্গে খ্যাটনের ব্যবস্থাটাও ভাল–তাই নয় কি ঐতিহাসিকেরা বলেন, প্রাচীন রাঢ়ের রাজধানী আস্তিকনগরের নাম বর্দ্ধমান মহাবীরের নাম থেকে রাখা হয়েছিল বর্দ্ধমান কিন্তু খ্যাটনদাস খাসনবীশ বলেন–বর্দ্ধমানে খ্যাটনের ব্যবস্থাটা ছিল ক্রমবর্দ্ধমান, তাই তার নাম বর্দ্ধমান৷ এ নিয়ে তোমরা ধীরে সুস্থে গবেষণা করে দেখতে পার আমার তাতে কোন আপত্তি নেই৷ এই পারস্য বা ইরাণে তাঁরা ওই তত্ত্বগুলির অনেকগুলিই পেয়ে গেলেন৷ তাই আর্যরা দেশটির নাম দিলেন আর্ষণ্যব্রজ৷ ‘ব্রজ’ ধাতুর অর্থ আনন্দে ঘোরা–ফেরা করা৷এ প্রসঙ্গে ‘ব্রজভূমি’, ‘ব্রজপরিক্রমা’ শব্দগুলি তুলনীয়৷ এইখানেই তাঁরা গমের সংস্পর্শে এলেন৷
তোমরা অনেকেই হয়তো জান, জিবের একটি নাম ‘গো’৷ ‘ধূমধাম’ শব্দের সঙ্গে তোমরা পরিচিত আছ নিশ্চয়ই৷ কোন উৎসব জাঁকজমকের (pomp and grandeur) সঙ্গে করা হলে উত্তর ভারতে বলে ঃ ‘‘বড়ে ধূমধাম সে উৎসব মনায়ে গায়ে’’ ঃ বাংলায় বলি–‘‘খুব ধূমধামের সঙ্গে জমিদারবাবু নাতির বিয়ে দিলেন’’৷
এই গম খাবার সুযোগ প্রথম যখন আর্যরা পেলেন তাঁদের জিবে শুরু হয়ে গেল মহা আনন্দ...মহাধূম৷ তাই তাঁরা গমের নাম দিলেন (গোধুম’৷ তামিল ‘গোধুমাই’ শব্দটি এই ‘গোধুম’ থেকেই এসেছে৷ পাঞ্জাবীতে এর সোণালী রঙের জন্যে কর্ষকরা বলে থাকেন ‘কনক’...উর্দু–ফার্সীতে যে ‘গোন্দুম’ শব্দ সেও এসেছে ‘গোধুম’ শব্দ থেকে৷ একে মাগধী প্রাকৃতে বলা হয় ‘গোহুম’, শৌরসেনী প্রাকৃতে ‘গেহুম’....যার থেকে হিন্দীতে ‘গেহু’৷ মাগধী প্রাকৃত থেকে প্রাচীন বাংলায় ‘গহম’....বর্তমান রাঢ়ী বাংলায় ‘গহম’–ই বলা হয়৷ এই‘গহম’–এর দ্রুত উচ্চারিত সংক্ষিপ্ত অভিপ্রকাশ হ’ল ‘গম’৷
এখানেই কি গমের ইতিকথার পূর্ণচ্ছেদ? –না, তা নয়৷ আরো আছে, শোণো৷ গমকে যখন তাঁরা পাথরে চূর্ণ করে (যন্ত্রক বা যাঁতা গোড়ার দিকে তো ছিল না৷ পাথরে ভেঙ্গে গমকে চূর্ণ করতে হত৷ চাকি–বেলুনও ছিল না) হাতে চাপড়ে চাপড়ে চাপাটি বা ‘চপটিকা’ (হিন্দীতে ‘চাপাটি’) তৈরী করতেন৷ তখন এই চাপাটিকে আগুনে সেঁকবার সময় চাপাটির ভেতর থেকে গন্ধ বেরিয়ে আসত৷ তাতে তাঁরা খুব বেশী আকৃষ্ট হতেন–ফুলের গন্ধে যেমন আকৃষ্ট হও তোমরা, মধুর গন্ধে যেমন আকৃষ্ট হয় মউ মাছি৷ সুতরাং সেকালের আর্যরা তৈরী রুটির আশায় উনুনকে ঘিরে বসে থাকতেন৷ আর যখন ওই রুটি বা চাপাটি সেঁকবার সুগন্ধ ভেসে আসত তাঁরা আনন্দে উদ্বেল হয়ে উঠতেন....তাঁদের মন তখন আশায় হেলে দুলে উঠত...হিন্দোলিত হ’ত–এইবার বুঝি আর্যকন্যা (সেকালের স্বামীরা স্ত্রীকে আর্যকন্যা ও স্ত্রীরা স্বামীকে আর্যপুত্র বলে সম্বোধন করতেন) তাঁদের পাতে খর্জূর সহ চাপাটি দিয়ে আপ্যায়ন করবেন (‘খর্জুর’ বানান দীর্ঘ ‘উ’–কার দিয়ে লিখবে, হ্রস্ব–‘উ’ কার দিয়ে ‘খর্জুর লিখলে তার মানে হচ্ছে রূপো৷ তোমরা খর্জুর খাও, খর্জুর খাও না৷) যে বস্তুর গন্ধে সেকালে আর্যদের দেহ–মন আনন্দে হেলে দুলে উঠত সেই বস্তুটির অর্থাৎ গম বা গোধুমের জন্যে তাঁরা আরেকটি নাম রাখলেন ‘গন্ধবিহ্বল’৷