কৃষি সম্পর্কে এই সামগ্রিক দৃষ্টিভঙ্গী থাকলে তবেই কৃষিক্ষেত্রে স্বয়ংনির্ভরতা অর্জন করা সম্ভব৷ আর এই নীতিই আমাদের গ্রহণ করা উচিত৷
কৃষি (Agriculture) বলতে ৰোঝায় বিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতিতে জমি চাষ, পশুপালন ইত্যাদি৷ মুখ্য ফসলের উৎপাদন এর অন্তর্ভুক্ত –– যেমন, বিভিন্ন রকমের ডালশস্য, খাদ্যশস্য, মোটাদানার শস্য, তৈলৰীজ, ইক্ষু ও শাকসব্জী ইত্যাদির উৎপাদন৷ ডাল থেকে শরীরের জন্যে অত্যাবশ্যক প্রোটিন তো পাওয়া যায়ই, তাছাড়া ডালচাষ জমিতে নাইট্রোজেনের মাত্রা প্রাকৃতিক ভাবে ৰাড়িয়ে দেয়৷ ডালচাষে অবশ্য ক্যালসিয়াম ফসফেট, পটাশ ইত্যাদি সার প্রয়োগেরও দরকার হয়৷
সব রকমের মূল খাদ্য শস্যই (cereals) শ্বেতসার সমৃদ্ধ –– যেমন ধান, গম, ভুট্টা, যব, ৰার্লি, রাই ইত্যাদি৷ মোটা দানার খাদ্য শস্য হ’ল বাজরা, জোয়ার, ৰার্লি, রাই ইত্যাদি৷
তৈলৰীজ বলতে ৰোঝায় সরষে, সোয়াৰীন, তিল, তিসি, সূর্যমুখী, বাদাম ইত্যাদি৷ এ ক্ষেত্রে ভারত ও বহির্বিশ্বের সঙ্গে ৰীজ–বিনিময় হওয়া উচিত৷
চাষের চীনী–শস্যের মধ্যে পড়ে ইক্ষু, সুগারবীট, খেজুর, তাল ইত্যািদ৷ মশলা চাষের মধ্যে পড়ে লবঙ্গ, দারুচিনি, ধনে, জিরা, হলুদ ইত্যাদির চাষ৷ এছাড়া বিভিন্ন রকমের ঔষধীয় উদ্ভিদের চাষ করা যেতে পারে৷ আনন্দনগরে ভেষজ–কেন্দ্র বা ভেষজ–উদ্যান স্থাপন করা উচিত৷ অন্যান্য চাষের মধ্যে পড়ে চা, কফি, কোকো, রবার ইত্যাদি৷ চা–বাগান ও রবার–বাগান স্থানীয় জনসাধারণের স্বার্থে অর্থকরী ফসল হিসেবে গণ্য হওয়া উচিত৷ স্থানীয় অর্থনীতির বিকাশ ও দারিদ্র্য দূরীকরণে অর্থকরী ফসলের উৎপাদন সহায়কতত্ত্ব হিসেবে কাজ করবে৷ অর্থকরী ফসলের উৎপাদন সমবায়ের মাধ্যমে হলে দেশের গরীব স্থানীয় জনসাধারণের আর্থিক মান অল্প সময়ের মধ্যেই উন্নত হওয়ার সম্ভাবনা৷
ভারতবর্ষে গ্রীষ্ম, শীত বা সব ঋতুর উপযোগী বিভিন্ন শাকসব্জীর চাষ হয়ে থাকে৷ তরিতরকারীর উৎপাদন ৰাড়ানো উচিত৷ পেঁয়াজ–রসুনের উৎপাদন করা হয় সাধারণ মানুষের কাছে বিক্রয়ের জন্যে, ও ঔষধ প্রস্তুতের জন্যে, যদিও সাধনা ও যোগাসন–ভ্যাসকারীদ্ পক্ষে তা উপযোগী নয়৷
হলুদ, সর্ষে, ৰড় দানার মুসূর আর গমের ক্ষেত্রে আশু বা জলদী (early variety), মধ্যম (medium variety) ও বিলম্বিত (late variety) এই তিন প্রজাতিরই চাষ করা যেতে পারে৷ কিন্তু ধানের ক্ষেত্রে এই রকম বাছাইয়ের সুযোগ নেই ঙ্মবোরো ধান ছাড়াৰ৷ যদি কোন ফসলের তিন প্রজাতিরই চাষের সুযোগ থাকে, আর তার জন্যে যথেষ্ট সময়ও পাওয়া যায় তাহলে জলদী প্রজাতিরই চাষ প্রথমে করা উচিত৷ এর জন্যে এমনভাবে পরিকল্পনা তৈরী করতে হবে যে, সামগ্রিকভাবে সেই ফসলের উৎপাদন বৃদ্ধি পায়৷ যদি কোনও কারণে জলদী প্রজাতির চাষ ব্যর্থ হয় তাহলে মধ্যম প্রজাতির চাষ করা উচিত৷ যদি সবকিছু ঠিকঠাক চলে তাহলে এই মধ্যম প্রজাতির উৎপাদন আশু অর্থাৎ জলদী প্রজাতির প্রায় সমানই হবে৷ আর যদি দ্বিতীয়টির চাষ ব্যর্থ হয় তখন বিলম্বিত প্রজাতিকে বেছে নেওয়া উচিত৷ যদি মরসুমের প্রথমেই নাবী (late) জাতের চাষ করা হয় আর তা ব্যর্থ হয়, তাহলে পরে আর কোনও চাষের সুযোগ থাকবে না, ও চাষীর সেই মরসুমটাই সম্পূর্ণ মার খাবে৷ জমিতে দ্বিতীয়বার সেচ দেওয়ার সময় আগাছা পরিষ্কার করে’ নিয়ে তরল সার প্রয়োগ করা উচিত৷ জমিতে তরল সার দেওয়ার সময় দেখতে হবে সেই সার যেন বিষাক্ত না হয়, ও তাতে ধানের জমিতে পালিত ক্ষুদ্র মৎস্যের ক্ষতি না হয়৷
পাথুরে জমিতেও ভাল মাটি ফেলে চাষের উপযুক্ত করে’ তৈরী করা যেতে পারে৷ ছোট ছোট ডুংরিতে যেখানে যেখানে সম্ভব সেখানে গোষ্ঠ খাদ্য হিসাৰে নেপিয়ার ঘাসের চাষ করা যেতে পারে৷ অবশ্য তার থেকে উঁচু পাহাড়ী এলাকায় জলের প্রাচুর্য না থাকায় এই ঘাসের চাষ অত্যন্ত কঠিন৷ তবুও সম্ভবপর হলে সেই চেষ্টা করা উচিত, যাতে উত্তম মানের চাষের জমিকে শুধু ফসল উৎপাদনেই কাজে লাগানো যায়৷
যদি চাষের জমির মধ্য দিয়ে রেলের লাইন গিয়ে থাকে তবে লাইনের দু’–পাশে ঠিক্রে মটর ও বিলম্বিত আউশ অথবা কালো ছোলার চাষ করা উচিত৷
যদি শীতপ্রধান বা নাতিশীতোষ্ণ অঞ্চলের গাছের বা ফসলের চারা গ্রীষ্মপ্রধান অঞ্চলে লাগানো হয় তাহলে তা লাগানো উচিত উঁচু জমিতে, সম্ভব হলে পাথর বা পাহাড়ের ধারে, যাতে রাতে তারা ঠাণ্ডা আবহাওয়া পায়৷
সব চাষের জমির (যেখানে পুষ্পোদ্যান আছে বা পার্ক আছে তা বাদে) সীমানা সংলগ্ণ যে জায়গা থাকে তাতে নিম্নোক্ত চাষ করা উচিত –– বসন্ত ও গ্রীষ্মকালে সেই সময়ের উপযোগী শাক, গ্রীষ্ম ও বর্ষাকালে বীন, শরৎ ও শীতেও বীন৷ বিউটি স্পটের ক্ষেত্রে (শোভা কানন) বেড়ায় (fencing) লতানে ফুল লাগানো উচিত৷
চাষবাসের মধ্যে আরও কিছু বিশেষ ক্ষেত্র আছে যা জরুরী পরিস্থিতিতে মানুষের প্রাণধারণের সহায়ক হতে পারে –– তা হচ্ছে শাক–সব্জী, ডাল, আলু, এমনকি গোষ্ঠখাদ্যের চাষ, যা দুগ্ধ উৎপাদনের জন্যে অত্যাবশ্যক৷
ফলোদ্যান চর্চা বা ফলের চাষ –– (Horticulture)
Horticulture অর্থ হ’ল মূলতঃ ফলের চাষ৷ বিভিন্ন রকমের ফল চাষ কৃষি পরিকল্পনার অন্তর্ভুক্ত হওয়া উচিত৷ ফল থেকে জ্যাম, মার্মালেড, জেলী, মেওয়াফল ইত্যাদি তৈরী হতে পারে৷
বিভিন্ন ফুলের চাষ এর মধ্যে পড়ে –– যেমন, যুঁই, চাঁপা ও গোলাপ ইত্যাদি ফুল থেকে এসেন্স তৈরী হতে পারে, যা থেকে অন্যান্য সুগন্ধি দ্রব্যও প্রস্তুত করা যায়৷ গোলাপের মত রজনীগন্ধার ব্যাপক উৎপাদন করে’ সারা পৃথিবীতে তা বিক্রয় করা যেতে পারে৷ গোলাপ লাল মাটিতে ভাল জন্মায়৷ পদ্ম থেকে পদ্মমধু সংগ্রহ করা যেতে পারে, যা অক্ষিপটের স্থানচ্যুতি সহ সর্বপ্রকার চক্ষুরোগের মহৌষধ৷ পদ্ম, লিলি, কলকে, কটনফুল (কটন গাছের ফুল) ইত্যাদি থেকে ভাল জাতের মধু পাওয়া যায়৷ শাল গাছের ও কটনফুলের গাছ থেকে প্রচুর মধু পাওয়া যায়৷ এই সব গাছ থেকে প্রাপ্ত মধু ফুল থেকেই সরাসরি সংগৃহীত হয়, মউমাছির মাধ্যমে নয়৷ এরা সব পুষ্প চাষের অন্তর্ভুক্ত৷
ইনজেক্শনের সিরিঞ্জ বা ড্রপারের সাহায্যেও পুষ্প মধু সংগৃহীত হয়৷ আমরা ছোটৰেলায় পদ্ম ৰীজ খেতুম৷ সেই সময়ে সমগ্র বর্দ্ধমানেই পদ্ম পাওয়া যেত৷ তখন আমরা ফুল থেকে মধু চুষে বা চেটে খেতুম৷ যেহেতু পুষ্প মধু থেকে নানা ঔষধ প্রস্তুত হয় তাই বাজারে তা ভালো দামেই বিক্রয় হতে পারে৷ আগেই বলা হয়েছে চিকিৎসকেরা সিরিঞ্জের সাহায্যে যেভাবে শরীর থেকে রক্ত নিষ্কাশন করেন, সেই পদ্ধতি প্রয়োগ করে’ ফুল থেকে মধু সংগ্রহ করতে হয়৷ এর কারণ হচ্ছে পিঁপড়ে ও নানা রকমের কীট মধু খেতে গিয়ে ওখানেই আটকে যায়৷ তাই একমাত্র সিরিঞ্জের মাধ্যমেই ৰাধাহীন ভাবে মধু নিষ্কাষণ করা সম্ভব৷
ঢেঁড়সের শুকনো গাছ একটি বিশেষ কাজে লাগানো যায়৷ আনারসের ক্ষেতে কখনও কখনও ফুল–ফল কিছুই আসে না, বা আসতে অনেক দেরী হয়৷ সেক্ষেত্রে এই ঢেঁড়সের গাছ পুড়িয়ে তার ধোঁয়া ক্ষেতে ছড়িয়ে দিলে তার ছাই–এর প্রভাবে আনারসের ফুল–ফল তাড়াতাড়ি এসে যাবে৷ এতে আনারসে গাছের কোন ক্ষতি হবে না, শুধু সতর্ক থাকতে হবে যেন গাছ পুড়ে না যায়৷
যাইহোক, এই পুষ্প চাষকে অবহেলা করা হয়েছে, সেভাবে কাজে লাগানো হয়নি৷ একে ঠিকভাবে বিকশিত করা উচিত৷ আনন্দনগরের গোলাপ বাগান থেকে গোলাপের নির্যাস আর গোলাপ জল সহজেই তৈরী হতে পারে৷