কৃত্তিবাস ঃ কৃত্তি+বস+ঘঞ্৷ ভাবারূঢ়ার্থে ‘কৃত্তিবাস’ মানে কৃত্তি বা চর্মকে যিনি বসন রূপে ব্যবহার করেন৷ যোগারূঢ়ার্থে ‘কৃত্তিবাস’ বলতে বোঝায় শিবকেও কারণ তিনি ব্যাঘ্রাম্বর৷ তোমরা নিশ্চয়ই জান বাংলা সাহিত্যের অন্যতম আদি পুরুষের নাম ছিল কৃত্তিবাস ওঝা৷ তাঁর পাণ্ডিত্যে মুগ্ধ হয়ে বাংলার নবাব হুসেন শাহ্ (তিনি বাঙালী ছিলেন) তাঁকে ভূ–সম্পত্তি দান করেছিলেন, বাংলায় রামায়ণ লিখতে উৎসাহ দিয়েছিলেন ও অনুরোধ জানিয়েছিলেন৷ হুসেন শাহ্কে সঙ্গত ভাবেই বলা হয় বাংলা সাহিত্যের জনক (ফাদার অব্ বেঙ্গলি লিটারেচার)৷ কৃত্তিবাস ঠাকুর সম্ভবতঃ হুসেন শাহের জীবিতকালে রামায়ণ রচনা শেষ করতে পারেননি৷ শেষ করেছিলেন তৎপুত্র নসরৎ খাঁ–এর শাসনকালে৷ শোণা যায় হুসেন শাহ্ কৃত্তিবাস ওঝাকে রামায়ণ রচনার দায়িত্ব দেবার আগেই গৌড়ে এক পণ্ডিতসভা ডেকেছিলেন৷ বাংলার নানান স্থান থেকে বড় বড় পণ্ডিতেরা সেখানে এসেছিলেন৷ এসেছিলেন নদীয়া জেলার রাণাঘাট মহকুমার শান্তিপুরের নিকটবর্তী ফুলিয়া গ্রাম থেকে কৃত্তিবাস ওঝাও৷ তাঁর নাম ছিল বনমালী মুখোপাধ্যায়, মাতার নাম ছিল মালিনী দেবী৷ পণ্ডিতেরা অনেক তর্কের পরে কৃত্তিবাসের শ্রেষ্ঠত্ব মেনে নেন ও হুসেন শাহ্ তাঁকেই রামায়ণ রচনার দায়িত্ব দেন৷ তোমরা হয়তো বলতে পার, আমি রামায়ণ অনুবাদ না বলে রামায়ণ রচনা বলছি কেন? না–কৃত্তিবাসী রামায়ণ বাল্মীকি রামায়ণের হুবহু অনুবাদ নয়৷ কৃত্তিবাস বাল্মীকি রামায়ণ থেকে প্লট নিয়েছিলেন সত্য কিন্তু লিখেছিলেন যা তা তাঁর স্বকীয়তায় ভাস্বর.....লিখেছিলেন বাঙলার পাঁচালী রীতিতে৷
কৃত্তিবাস ঠাকুরের পাণ্ডিত্যে সেকালের বাঙলা ছিল মুগ্ধ.....অভিভূত৷
‘‘যতেক বিদ্বান জ্ঞানী আছয়ে সংসারে
ফুলিয়া পণ্ডিতে কেহ নিন্দিতে না পারে৷’’
তর্কে হেরে যাওয়া ব্রাহ্মণেরা কিন্তু গায়ের জ্বালা মেটালেন কিছুদিন পরে৷ তাঁরা বললেন–হিন্দু শাস্ত্র রামায়ণকে বাংলা ভাষায় লিখে কৃত্তিবাস ধর্মহানি ঘটিয়েছেন৷
হুসেন শাহ্ চাইলেন মহাভারতও বাংলায় লেখাতে, ভাগবৎ শাস্ত্রও বাংলায় লেখাতে৷ কিন্তু ব্রাহ্মণদের ঘোরতর বিরোধিতায় আর কোন পণ্ডিত তখন সেই কাজে এগিয়ে আসতে চাইলেন না৷ নবাব বাংলার তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী গোপীনাথ বসুর (পুরন্দর খাঁ) স্বীয় ভ্রাতা মালাধর বসু (গুণরাজ খাঁ ঃ বর্দ্ধমান জেলার নবাব সন্তুষ্ট হয়ে ভাগবতের বাংলা অনুবাদের নাম রাখলেন ‘শ্রীকৃষ্ণবিজয়’ ও মালাধর বসুকে খেতাব দেন গুণরাজ খাঁ৷ গোপীনাথ বসু কাটোয়ার নিকটবর্ত্তী সিদ্ধিগ্রামের কাশীরাম দাশকে (তিনিও কায়স্থ) মহাভারত রচনার অনুরোধ জানান৷ তাঁকেও হুসেন শাহ্ ভূসম্পত্তি দান করেন৷ যাই হোক কৃত্তিবাসের বিরুদ্ধে বাংলার ব্রাহ্মণ সমাজ প্রতিহিংসাপরায়ণ ও প্রতিহিংসামুখর হয়ে ওঠেন৷ তাঁরা রটনা করলেন যে কায়স্থ প্রধানমন্ত্রী ও মুসলমান নবাব মিলে বাঙলাকে ধবংস করার ষড়যন্ত্র করছে৷ তাঁরা বলতেন–‘‘কাশীদেশে, কৃত্তিবেসে, আর বামুন–ঘেঁষে এই তিন সর্বনেশে৷’’ অর্থাৎ ব্রাহ্মণেরা যেন সতর্ক থাকেন যাতে তাঁরা কোন কায়স্থ বা মুসলমান বা কৃত্তিবাস ঠাকুরের সমর্থক বামুনের সঙ্গে বেশী ঘেঁষাঘেঁষি মেশামেশি না করেন৷ ওঁরা বামুনের সাহায্যে হিন্দুশাস্ত্রকে বাংলায় অনুবাদ করে বাংলাকে ধবংস করে দেবে৷ ব্রাহ্মণ সমাজ কৃত্তিবাস ওঝাকে পতিত বলে ঘোষণা করেন ও ফুলিয়া মেল থেকে বহিষ্কার করে দেন৷ কৃত্তিবাস ঠাকুরের পুত্র–সন্তান ছিল না৷ তাই গ্লানির বোঝা বহন করতে হয়েছিল তাঁর ভ্রাতুষ্পুত্র অনুপম ওঝাকে (অনুপম ওঝার নাম নিয়ে কিছু মতভেদ আছে)৷