প্রভাতী

উপধর্ম

লেখক
সুকুমার রায়

ধর্ম হয় সত্যবলি যারে

উপধর্মের রকম কত সংসারে,

ভবে গুরু কত মার্র্কধারী

নবাবী বেশে করছে দখলদারী৷

ধর্মমূলে নেইত মহড়া

বাহ্যিক তামাসায় গড়া

বাক্যবাণের বিদ্বেষ লড়াই৷

বিচার বুদ্ধির কথা নাই---

গুরুজীর হাতে বাঁধা পুতুল

অন্ধমনে আবোল তাবোল

বিদ্যাবুদ্ধি যশ থাকুক যত

অলৌকিকতার ফাঁদে নত

মানবে মিলন কোন মতে

শুভবুদ্ধি আর হয় না তাতে৷৷

 

অথ খারো কাহিনী

Baba's Name
শ্রী প্রভাতরঞ্জন সরকার

কোনো নূতন শাড়ি–বাড়ি–গাড়ি আনলে অথবা হাঁড়িতে কোনো নূতন রান্না চাপালে লোকে চায় সে সম্বন্ধে অন্যে কিছু বলুক৷ কারণ নূতন অর্থে ‘কোরা’ মানেই যা ধ্বনিকে উৎসাহ দেয়৷ নূতন শাড়ি পরলে মন চাইবে প্রতিবেশিনী জিজ্ঞাসা করুন, ‘‘হ্যাঁ দিদি, শাড়িটা কবে কিনলে কত পড়ল’’ নূতন বাড়ি করলে ইচ্ছে জাগে, ৰন্ধু–ৰান্ধবরা বলুক, বাড়িটা ৰেশ হয়েছে৷ নূতন গাড়ি কিনলে ৰন্ধুর মুখ থেকে শুনতে চাইবে, ‘‘এটা কোন্ বৎসরের মডেল’’ হাঁড়িতে রান্না চাপালে প্রশ্ণ অপেক্ষিতই থাকবে, ‘‘রান্না কোথায় শিখলি রে’’

নতুনের সম্বন্ধে জানার আগ্রহ ও প্রশ্ণ পাওয়ার আগ্রহের কথা বলতে গিয়ে আমার সেই ইতিহাসপ্রসিদ্ধ খারো গ্রামের ততোহধিক প্রসিদ্ধ ঘটনাটির কথা মনে পড়ল৷ খারো একটি বিরাট সুশিক্ষিত গ্রাম৷ কিন্তু দুষ্টুলোকে বলে থাকে, বিদ্বান হলে কী হবে, গ্রামের ৰৌদ্ধিক মান বৈদুষ্যের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে এগোতে পারেনি৷ যেদিন গ্রামেরপঞ্চাশৎতম ছেলেটি এম. এ. পাস করলে সেদিন গ্রামবাসীরা সর্বসম্মতিক্রমে একটি প্রস্তাব গ্রহণ করেছিল যে এই উপলক্ষ্যে তারা একটি বিরাট উৎসবের আয়োজন করবে৷ পটনা থেকে লাটসাহেৰকে আমন্ত্রণ জানানো হবে (তখন ইংরেজ আমল৷ রাজ্য ও রাজ্যপাল শব্দের প্রচলন হয়নি৷ বলা হত প্রদেশ ও প্রদেশের গভর্ণর বা ছোট লাটৰহাদুর)৷ যেমনটি ভাবা, তেমনটি কাজ ৷ খারো গ্রাম উৎসবমুখর হয়ে উঠল৷ মিষ্টি হেসে লাটসাহেৰ সভাপতিত্ব করে গেলেন......উচ্ছ্বসিত ভাষায় খারো গ্রামের মানুষদের ঐতিহ্যের, তাঁদের বৈদুষ্যের উচ্চকণ্ঠে প্রশংসা করে গেলেন .....নিমন্ত্রিত হয়ে যেমনটি করতে হয়৷ লাটসাহেৰ বলে গেলেন, খারো গ্রাম সম্বন্ধে এদিক ওদিক দু’চারটে উল্টোপাল্টা কথা আমার কানে ভেসে আসত৷ অবশ্য সে সব কথায় আমি কখনই আমল দিইনি৷ আজ চাক্ষুষ দেখে গেলুম খারো গ্রাম সাংস্কৃতিক দিক থেকে কত উন্নত৷ এখানকার মানুষের ৰৌদ্ধিক স্তর কত গগনচুম্বী৷ আমি রাজধানীতে ফিরেই এ সম্বন্ধে একটি প্রেস বিজ্ঞপ্তি দোব যাতে সমস্ত কটু সমালোচনার শেষ নির্যাসটুকুও শূন্যে মিলিয়ে যায়৷

লাটসাহেৰ ফিরছেন৷ তিনি গাড়িতে উঠে বসলেন৷ চারিপাশে অনেক শিক্ষিত তরুণদের ভিড়৷ লাটসাহেৰকে সঙ্গে নিয়ে রাজধানী পর্যন্ত পৌঁছে দেবার দায়িত্ব যে তরুণটি নিলেন তিনি আবার ত্ত.ট্ট.–তে তেরস্পর্শ (ত্র্যহস্পর্শ)৷

তাঁর সহযোগী হিসেবে ছিলেন আরও দু’টি তরুণ৷ বৈদুষ্যে তারা এ বলে আমায় দ্যাখ, ও বলে আমায় দ্যাখ৷

চারিপাশে দিগন্তবিস্তৃত কৃষিক্ষেত্র.....ফসলে মাঠ লালে লাল৷ লাটসাহেৰ শুধোলেন–ওই লাল লাল ফলগুলি কী সকলেই উৎসাহের সঙ্গে বলে উঠলেন–মরচাই......মরচাই (লঙ্কা,......লঙ্কা৷ হিন্দীতে ‘মীর্চ্’)৷

লাটসাহেৰ বললেন–বা! ভারী সুন্দর দেখাচ্ছে তো! তরুণেরা সমস্বরে ড্রাইভারকে বললেন–একটু থেমে যান ড্রাইভার সাহেৰ৷

তাঁরা সবাই মাঠের দিকে ছুটলেন৷ যিনি যতটা পারলেন লঙ্কা তুলে এনে বস্তাবন্দী করে লাটসাহেৰের পাশে রেখে দিলেন৷ বললেন–আমাদের অঞ্চলের লঙ্কা বিশ্ববিখ্যাত৷ ভারতের ও বহির্ভারতের নানান জায়গায় এই লঙ্কা গিয়ে থাকে৷ আপনি যে দয়া করে আমাদের গ্রামে এলেন ও দয়া করে লঙ্কাগুলোকে দেখলেন এতে এদের ‘লঙ্কা’ নাম সার্থক হ’ল৷ রাজধানী কিছুটা দূরের পথ৷ পথে কিছুটা একঘেয়েমি লাগতে পারে৷ এই টুকটুকে লাল লঙ্কাগুলো সঙ্গে দিলুম৷ যখনই মন চাইবে টুকটাক করে মুখে ফেলতে ফেলতে যাবেন৷ পথের ক্লান্তি এতে দূর হবে৷

লাটসাহেৰ বিস্ফারিত নেত্রে তাকিয়ে রইলেন৷

 এই সেই ইতিহাসপ্রসিদ্ধ খারো গ্রাম৷ সেই গ্রামের নূতনের পরিচিতি সম্বন্ধে একটা গল্প মনে এল৷

গ্রামের ৰর্দ্ধিষ্ণু কর্ষক ও সুশিক্ষিত মার্জিতরুচি তরুণ শ্রীভূতনারায়ণ সিং মহাশয় তাঁর ৰন্ধু শ্রীভূতনন্দন সিং–এর সঙ্গে আলোচনা করে স্থির করলেন–তাঁদের গ্রাম এত উন্নত, কিন্তু গ্রামে কারো ঘড়ি নেই ৷ একটা ঘড়ি না কিনলে গ্রামের মর্যাদাই থাকে না৷ যেমন ভাবা তেমনি কাজ৷ সিংজী কিছুটা জমি বেচে ৫০০০ টাকা নিয়ে কলকাতায় এলেন৷ ঘড়িওয়ালাকে বললেন–এই ৫০০০ টাকা দিচ্ছি৷ তোমার দোকানের সর্বশ্রেষ্ঠ ঘড়িটি আমি কিনতে চাই৷

দোকানদার খদ্দেরের নাড়ীর গতি ভালভাবে ৰুঝে নিলেন৷ তিনি দোকানের সর্বশ্রেষ্ঠ একটা ছোট আকারের ঘড়ি সিংজীর হাতে তুলে দিলেন৷

সিংজী তাতে সন্তুষ্ট হবেন কেন! তিনি দেখলেন, দোকানে ওই ঘড়িটির চেয়ে অনেক ৰড় ৰড় ঘড়ি রয়েছে৷ তিনি বললেন–৫০০০ হাজার টাকা দিয়ে এত ছোট আকারের ঘড়ি নিতে যাব কেন সবচেয়ে ৰড় ঘড়িটি আমার পাওয়া উচিত৷ দোকানদার সেই সময়কার বাজারের সবচেয়ে সস্তা দামের হাতঘড়ি সিংজীর হাতে তুলে দিয়ে বললেন, এই ঘড়িটি থেকে আপনি দুই ধরনের কাজ পাবেন৷ প্রথমতঃ এতে সময় দেখতে পারবেন দ্বিতীয়তঃ প্রয়োজনবোধে ঘড়িটিকে ঢ়িলের মত ব্যবহার করে আঁৰ পাড়তে পারবেন৷ সিংজী তো মহা খুশী৷

সিংজী যথাসময়ে খারো গ্রামে ফিরে এলেন৷ দিবারাত্র........অষ্টপ্রহর.......চব্বিশ ঘণ্টা ঘড়ি পরে ঘুরে ৰেড়ান৷ যেখানেই দু’চার জনকে দেখেন পাঞ্জাবীর হাত গুটিয়ে সেইখানে গিয়ে পৌঁছেন৷ কিন্তু সিংজীর মন্দ ভাগ্য! কেউ কখনও জিজ্ঞেস করে না–হ্যাঁ সিংজী, ঘড়িটা কবে কিনলেন

একদিন শেষ রাতে সিংজী নিজের বাড়িতে আগুন লাগিয়ে দিলেন৷ আগুন দেখে পাড়া প্রতিবেশীরা তো এলেনই, এমনকি ভিন্ গাঁয়ের মানুষও ছুটে এল আগুন নেবাতে৷ বাড়ির চারি পাশে মানুষের ভীড়৷ ও ধরনের জায়গায় দমকলের কোনো ব্যবস্থা ছিল না৷ তাই তখন শুধু শোনা যাচ্ছিল কতকগুলি ধবনি ঃ–আগুন–ওদিকে–এদিকে–বালতি–জল–আয়–যা ইত্যাদি, ইত্যাদি৷

সিংজী যেখানেই দেখছেন ৪৷৫ জন লোক জড়ো হয়েছেন তিনি দৌড়ে সেখানে গিয়ে পৌঁছোচ্ছেন৷ নিজের ঘড়িটার দিকে তাকিয়ে বলছেন–আগ লগীথী পাঁচ বাজকে পঁচপন মিনিট মে৷ ইয়হ্ ঘড়ি টাইম্ বী দেতী হৈ, ইস্সে আম ভী তোড়ে জা শকতে হৈ৷ সেখানে কোনো প্রতিক্রিয়া না দেখে তিনি আবার আর একটা জটলার দিকে ছুটে যাচ্ছেন আর ওই কথাই বলছেন৷ এদিকে আগুন যে নিবে এল! শেষ প্রয়াস হিসেবে সিংজী দৌড়োতে দৌড়োতে আর একটা জটলার দিকে পৌঁছোলেন আর চীৎকার করে বলতে লাগলেন–আপনারা শুনেছেন আগুন লেগেছিল ৫টা বেজে ৫৫মিনিটে৷ এই ঘড়ি কত সুন্দর সময় দেয় কী বলব! এ দিয়ে আবার আঁৰও পাড়া যায়......আগ লগী থী ৫ বাজকে ৫৫ মিনিট মে৷ ইয়হ্ ঘড়ি টাইম বী দেতী হৈ, আম ভী তোড়ে জা শকতে হৈ৷ হঠাৎ ভিড়ের মধ্যে থেকে কে একজন বলে উঠল–আরে ঘড়ি কবে কিনলি.....আর একজন বললে–কোত্থেকে কিনলি.....আর একজন বললে–কত দাম পড়ল......আর একজন বললে–ভারী সুন্দর তো!

ৰাবু ভূতনারায়ণ সিং নিজ শিরে করাঘাত করে বললে–ইয়হ্ ৰাত অগর পহ্লে ৰোলতে তো কোন ৰুদ্ধু আগ লগানে জাতা৷ এই সেই ইতিহাসপ্রসিদ্ধ খারো গ্রাম৷

ক্ষুদিরাম স্মরণে

লেখক
পথিক বরl

‘‘একবার বিদায় দে মা ঘুরে আসি,

হাসি হাসি পরব ফাঁসী দেখবে ভারতবাসী৷’’

এই গানটি আজও অনেক বাঙালীর রক্তে আগুন ধরায়৷ ১৯০৫ সাল৷ সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশ বাঙলাকে দুর্বল করতে ভাগ করে দু’টি আলাদা রাজ্য ঘটন করে৷ প্রতিবাদে গর্জে ওঠে সারা বাঙলা৷ বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে পথে নাবেন বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও৷ আন্দোলনকে দমন করতে সাম্রাজ্যবাদী বিদেশী শাসকও দমন-পীড়ন ও অত্যাচারের আশ্রয় নেয়৷ এরই মাঝে বাঙলার একদল দামাল তরুণ ত্যাগের মন্ত্রে দীক্ষা নেয় অত্যাচারী শাসককে তারই ভাষায় জবাব দিতে৷ সেদিনের সেই অত্যাচারী শাসকদের একজন ছিলেন ম্যাজিষ্ট্রেট কুখ্যাত কিংসফোর্ড৷ এই কিংসফোর্ডকে উপযুক্ত জবাব দিতে তৈরী হলেন বিপ্লবী তরুণ দল৷ কিংসফোর্ড তখন মজফরপুরে৷ কিশোর ক্ষুদিরাম বসু আর এক কিশোর প্রফুল্ল চাকীকে সঙ্গে নিয়ে মজফরপুরে পৌঁছলেন অত্যাচারী শাসককে মুখের মত জবাব দিতে৷ জবাব তারা দিয়েছিলেন৷ কিন্তু ভুলবশতঃ কিংসফোর্ড বেঁচে যায়৷ মারা যান দুই ইংরেজ মহিলা৷ প্রফুল্ল চাকী ধরা পড়ার আগেই নিজের হাতের রিভলবার দিয়েই আত্মহত্যার পথ বেছে নেন৷ ধরা পড়েন ক্ষুদিরাম৷

যথারীতি অত্যাচারী শাসকের বিচারের প্রহসনে ফাঁসীর আদেশ হয় ক্ষুদিরামের৷ ১৯০৮ সালের ১১ই আগষ্ট সেই আদেশ কার্যকর হয়৷ প্রত্যক্ষদর্শী ক্ষুদিরামে উকিলের বর্ণনা থেকেই জানা যায় ফাঁসীর মঞ্চে ওঠার আগে ক্ষুদিরাম এতটুকু বিচলিত ছিলেন না৷ বরং হাসতে হাসতে তিনি ফাঁসীর মঞ্চে ওঠেন৷ দেশের জন্য আত্মত্যাগের, বলিদানের পথ দেখিয়ে গেলেন ক্ষুদিরাম৷ পরবর্তীকালে সেই পথ ধরেই দেশের জন্য জীবন বলিদান দিয়ে যায় আরও শত-সহস্র তরুণ৷ তাঁদের আত্মত্যাগ ও বলিদানেই দেশ স্বাধীন হয়৷ কিন্তু আজ একদল ক্ষমতালোভী, ধূর্ত, কপট নেতারা সেই ত্যাগ ও বলিদানকে ব্যঙ্গ করে দেশের কর্ণধার হয়ে বসেছে৷ তাই আসুন ক্ষুদিরামের বলিদানে দেশবাসীর প্রার্থনা হোক---আর এক বার ফিরে আসুক ক্ষুদিরাম, আর একবার জেগে উঠুক জালাবাদ, বুড়িবালাম৷ নোতুন করে উদয় হোক চট্টগ্রামের সূর্য৷ আর একবার দুর্নীতিপরায়ণ ধূর্ত শাসকের বুকে কাঁপন ধরিয়ে দিক মহাকরণের অলিন্দ৷ বঙ্গভঙ্গ প্রতিরোধ করতে জীবন দিয়েছিলেন ক্ষুদিরাম৷ সেদিন সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশ মাথা নত করতে বাধ্য হয়েছিল৷ কিন্তু ক্ষুদিরাম ও শত শহীদের আত্মত্যাগ ব্যর্থ করে ক্ষমতা লোলুপ নেতারা বাঙলাকে ভাগ করেই ব্রিটিশের হাত থেকে ক্ষমতা গ্রহণ করেছিল৷ আজ আবার খণ্ডিত বাঙলার বুকে আবাজ উঠছে বঙ্গভঙ্গের৷ বাঙালী কি সত্যই চেতনাহীন জড়ে পরিণত হয়েছে! ক্ষুদিরামের আত্মত্যাগের দিন বাঙলার ছাত্রযুব সমাজ নূতন করে শপথ নিক ঐকবদ্ধ বাঙলা গঠনের৷

আত্মত্যাগে মহান, দেশের জন্য নিবেদিত প্রাণ হে মহান ক্ষুদিরাম লহ প্রণাম৷

‘মোহন বাঁশী’

লেখক
কৌশিক খাটুয়া

তোমার বাঁশীর সুরে

বুঝি তুমি নাইকো দূরে,

কাছে থেকেও নাই নজরে

 হারাই সৃষ্টির ভীড়ে!

 

আকুল হয়ে এত ডাকি

তবু কেন দাও যে ফাঁকি,

রাতুল চরণে মনটা রাখি

 থাকো হৃদয়-নীড়ে৷

 

সমুখ পথে চেয়ে থাকি

 তোমায় দেখার ছলে,

তোমার বাঁশীর সুর

কেবল তোমার কথাই বলে৷

 

তোমার লীলার ছন্দে নাচি

 ‘যা’ খুশি তাই কর,

অজ্ঞ বিজ্ঞ প্রাজ্ঞ সাজাও

 রাজা-ফকির গড়৷

 

তোমার হাতের খেলনা আমি

 নয়কো আদৌ ফেলনা,

মোহন বাঁশীর তালে দোলে

 বিশ্ব-দোলার দোলনা!

 

বাঁশীর সুরে তালে নাচে

 সাগরে ঊর্মি মালা,

 তটিনীর ধারা রবি শশী তারা

 স্বর্গীয় সুরে উতলা!

 

যে বাঁশীর আবেগ অশ্রু ঝরায়

সে’ বাঁশীর প্রভাব হাসিতে ভরায়,

 আশা-হতাশা, বেগ-উদ্বেগ

বাঁশীর সুরে কোথা সরে যায়!

 

দখিনা হাওয়ায় ঝর্ণাধারায়

বিহগ রহেনা আপন কুলায়,

সুরের ধারায় আত্মহারায়

মর্ম মাঝে কে বংশী বাজায়!

 

আমার অনেক বলার ছিল

 রাতুল চরণ তলে,

সুর হয়ে ‘তা’ মিশে গেছে

 ভক্তি অশ্রু-জলে!

 

কেউ কি জানে তুমি কোথায়

 বাঁশীর সুরে সুরে,

হৃদয় মাঝে হৃদয় জুড়ায়

 হৃদয় অন্তঃপুরে! 

ইছামতীর দেশে

লেখক
শঙ্কর মণ্ডল

সেদিন ছিল সকাল বেলা অন্য একটা সকাল

পরিপাটি হাসি-খুশি চলবে অবধি বিকাল

তপ্ত দহণ তপ্তগহণ জ্যৈষ্ঠ মাসের শেষে

তৃষ্ণায় প্রাণ ওষ্ঠাগত ইচ্ছামতীর দেশে

আকুল মনের ব্যাকুল প্রাণ ঘূর্ণিচাপের মন

কতক আশায় কতক নেশায় চলল সর্বোক্ষণ

হাতের মধ্যে হাতটি রাখা মনের মধ্যে মন

ইছামতীর সুখের স্মৃতি অস্থায়ী যতন

ইচ্ছে করেই ঘাটের ধারে দাঁড়িয়ে দীর্ঘক্ষণ

সুখের স্মৃতি রাঙা হল মনের বিসর্জন৷

 

তুমি যে দয়াল

লেখক
সুকুমার রায়

তুমি যে দয়াল আমার প্রাণাধন

অনন্তে মিশে আছ পতিত পাবন

দীপনি জ্বলিছে সদা তোমারি আশে

ধরা দাও হে মোর শুন্য হৃদয় মাঝে

হাসি-কান্না ভরা ব্যথিত হৃদয়ে

নিশিদিন বসে তোমারি পথচেয়ে৷

 

কার পরশে

লেখক
প্রণবকান্তি দাশগুপ্ত

কার পরশে মন ভুলেছে ক্রন্দন,

কার ডাকে মন ছিঁড়েছে সব বন্ধন৷

কে বাজালো বন্ধ দ্বারে ঘন্টা

উঠলো জেগে ঘুমন্ত মোর মনটা৷

বিশ্বজুড়ে কে মেতেছে কর্মে

কার আহ্বান পেলাম আমি মর্মে৷

কার প্রবচন ঘুচায় মনের জড়ত্ব,

কার আদর্শ জাগায় মনে মহত্ব৷

খুঁজবো তাঁরে পূজব সকাল সন্ধ্যে,

কাটাবো দিন ধর্মে কর্মে আনন্দে৷

মাটির ঈশ্বর বিদ্যাসাগর

লেখক
সুপর্ণা মজুমদার রায়

মেদিনীপুরের সেই যে এক বীরসিংহ গ্রাম,

সেই গাঁয়েরই সিংহ শিশু বিদ্যাসাগর নাম৷

বিদ্যাসাগর কেমন ছিলেন

জানতে কিনা ভাই---?

বীরদর্পে কন্ঠে যার নারীশিক্ষা চাই৷

পড়া নাকি চালিয়ে গেছেন

পথের আলোর বাঁকে,

অংক তিনি শিখেছিলেন সংখ্যা ফলক দেখে৷

বিদ্যাসাগর কেমন ছিলেন জানেন কটা লোক?

গোঁড়ামিকে তুড়ি মেরে বিধবা বিবাহ হোক!!

বলতে পারো বিদ্যাসাগর তবে কেমন ছিলেন?

ঢিলের বদলে পাটকেলটি মারতে যিনি বলেন৷

বিদ্যাসাগর কেমন ছিলেন জানতে ইচ্ছে করে?

জানতে পারো তবে তাঁর বর্ণপরিচয় পড়ে৷

বিদ্যাসাগর দয়ার সাগর যা ছিল তাঁর টাকা,

দীনের তরে বিলিয়ে দিতেন

হোক না পকেট ফাঁকা৷

এমনি এক বিদ্যাসাগর অসামান্য দ্বিজবর,

মায়ের ডাকে দিলেন পাড়ি উত্তাল দামোদর৷

বিদ্যাসাগর জ্ঞানের সাগর ভাষা’র শিক্ষাগুরু,

বঙ্গসাহিত্যের নবজাগরণ

(তাঁর) হাতটি ধরেই শুরু৷

দীপ্ত ভাষী সদা ব্যস্ত মানুষ গড়ার কাজে,

নিন্দুকেরা বলুক তাঁকে মাথামোটা কিংবা বাজে৷

এমনি মোদের বিদ্যাসাগর সমাজ প্রগতি শিখা,

প্রশস্ত ললাটে আঁকা ছিল জ্ঞানের জয়ের টীকা৷

এমনই ছিলেন বিদ্যাসাগর বিশাল উদার চিত্ত,

বীরসিংহের বীরের পায়ে সব বাঙালী ভৃত্য৷

সব পীড়িতের ঈশ্বর যিনি করুণার মিলন সাগর,

শিষ্টের যিনি পালনকারী ঈশ্বর চন্দ্র বিদ্যাসাগর৷

নাচাতে নাচাতে

Baba's Name
শ্রী প্রভাতরঞ্জন সরকার

ঠাকুরের অর্থাৎ শ্বশুরের কন্যা এই অর্থে ঠক্করদুহিতাঞ্ছঠক্ক্ ঞ্ছঠাকুরঝি৷ ননদকে বাংলায় ‘ঠাকুরঝি’ বলে সম্বোধন করা হত ও আজও করা হয়ে থাকে৷

ননদের স্বামী নন্দাইকে (ননন্দাপতিঞ্ছননন্দ্) সম্ৰোধন করা হত ‘ঠাকুর জামাই’ বলে৷ ঠাকুর জামাই মানে ঠাকুরের জামাই অর্থাৎ শ্বশুরের জামাই৷ রাঢ়ের কোনো কোনো অংশের পুরুষেরা পত্নীর ভগিনীকেও ‘ঠাকুরঝি’ বলে সম্বোধন করে৷ ভাষাবৈজ্ঞানিক মতে এ ব্যবহার শুদ্ধ৷

‘ননন্দা’ মানে যে আনন্দিতা নয়৷ ভ্রাতৃজায়া ঘরে আসার সময় সব ননদের না হলেও কোনো কোনো ননদের মনে একটা বিক্ষোভ জন্মায়৷ সে ভাবে, অন্য বাড়ির মেয়ে এসে আমার বাপের বাড়িতে সর্বময়ী কর্ত্রী, একেবারে রাজরাণী হয়ে বসল আর আমি কি না পরের বাড়িতে গিয়ে দু’বেলা হেঁসেল ঠেলছি!

সেকালে ননদ ও ভাজ দু’য়েরই শিক্ষার স্তর খুব উন্নত ছিল না৷ তাই ছোটখাট ব্যাপারে একে অন্যকে ঠেস দিয়ে কথা শোনাত, একে অন্যকে সহ্য করতে পারত না৷ আজকাল কিন্তু চাকা ঘুরে গেছে৷ অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ননদ–ভাজ দুই–ই শিক্ষিত৷ তাই দু’য়ের মধ্যে আজকাল অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দারুণ ভাব৷ এ যেন একেবারে–

‘‘ভাবে গদগদ তেলাকুচো

কেঁদে মরে গেল কাল ছুঁচো৷’’

সেকালে কিন্তু সব ক্ষেত্রে না হোক, অনেক ক্ষেত্রেই ননদ–ভাজে দিব্যি রেষারেষি চলত৷ সেই যে গল্প আছে না ঃ

ননদ–ভাজে ঘাটে গেছে চান করতে৷ এমন সময়ে কুমীর এসে ননদকে ধরে নিয়ে গেল৷ ভাজ কিন্তু কথাটি চেপে রাখল৷ মনে মনে তার খুব আনন্দ, কারণ ননদ তাকে জ্বালা দিত৷

          ‘‘ননদিনী রায়বাঘিনী, ননদিনী কুলের কাঁটা,

          উঠতে বসতে দেয় গো খোঁটা৷৷’’

সে বাড়িতে এসে কাউকে কিচ্ছুটি বললে না, একবারও মুখটি খুললে না, কেননা মুখ খুললেই তো বিপদ৷ খাওয়া–দাওয়া শিকেয় উঠবে.......রাঁধা ভাতের হাঁড়ি ফেলে দিতে হবে.......শুক্তো–ঘণ্ট–ডাঁটা–চ গোরু–ছাগলে খাবে৷ ভাজ তাই মুখে কুলুপ এঁটে রইল৷ তারপর পেট ভরে ৰেড়াল ডিঙ্গোতে পারে না এমন পরিমাণ ভাত খেয়ে, লাউডগা–পোস্তবাটা থেকে শুরু করে ঝালের ঝোল, অম্ৰল সব কিছু চেটেপুটে খেয়ে হাতে ভর দিয়ে উঠে দাঁড়াল৷ আর মনে মনে বললে, কী জ্বালা হয়েছে, এঁটো পাতা আবার আমাকেই তুলতে হবে!

‘‘ঢ়লাঢ়লা পুঁইয়ের পাতা মলুকচালের ভাত ৷

খেয়ে দেয়ে রইনু বসে কে ফেলাবে পাত৷’’

বউ কোনোক্রমে গেল আঁচাতে৷

কুম্ভীরবর্গীয় সমস্ত জানোয়ারেরাই চলবার সময় একটু লাফাতে লাফাতে যায় (সে বিরাট আকারের কুমীর থেকে শুরু করে টিকটিকি পর্যন্ত সবাই এই রীতিতেই চলে) ও এই একই রীতিতে শিকার ধরে ৷ শিকার ধরে মুখে নিয়ে যাবার সময় তারা নিজেরা লাফাতে লাফাতে যায় বলে দেখে মনে হয় শিকারটাও ৰোধহয় নাচতে নাচতে যাচ্ছে৷ কুমীর যখন ননদকে ধরে নিয়ে যাচ্ছিল তখন কুমীরটা নিশ্চয় ওই ভাবেই যাচ্ছিল৷ বউ দেখলে খ্যাঁটনের পালা তো চুকে গেছে৷ এখন ননদকে কুমীরে নিয়ে গেছে বললেও ক্ষতি নেই৷ হাঁড়ি যদি ফেলে দেওয়াও হয়, হাঁড়িতে এক কণা ভাতও অবশিষ্ট নেই৷ বউ সবই চেটেপুটে খেয়ে নিয়েছে৷ তাই বউ (অর্থাৎ ভাজ) আঁচাতে আঁচাতে ঘাটের আর সবাইকে ডেকে বললে ঃ

          ‘‘ভাল কথা মনে পড়ল আঁচাতে আঁচাতে৷

          ঠাকুরঝিকে নিয়ে গেল নাচাতে নাচাতে৷৷’’

সবাই বললে–তোমার ঠাকুরঝিকে কুমীরে নিয়ে গেছে এই খবরটা এতক্ষণ চেপে রেখেছিলে কেন ভাজ বললে– এতক্ষণ কথাটা মনে ছিল না৷ আঁচাতে আঁচাতে মনে পড়ল৷

অভিষেক

লেখক
আচার্য গুরুদত্তানন্দ অবধূত

হে বীর, ভারতবর্ষের ভাগ্যাকাশে

তুমি এক উজ্জ্বল ধুমকেতু৷

যুদ্ধক্ষেত্রে নির্ভিক সৈনিক,

আপোষহীন সংগ্রামী তুমি,

ত্যাগ তিতীক্ষার মূর্ত্ত প্রতীক৷

উদার চিত্তে ছিল তব আহ্বান

‘‘আমায় রক্ত দাও,

আমি স্বাধীনতা দোব’’

গড়লে আজাদহিন্দ ফৌজ,

শক্ত হাতে দিলে তাতে নেতৃত্ব,

সৈনিক বেশে তুললে

জাতীয় পতাকা

গড়লে সরকার দেশের মাটিতে৷

জানে নি সে মানুষ পাওনি,

মর্যাদা সেদিন তাই,

সাম্রাজ্যবাদীর কোমড় ভেঙে

হলে তুমি নিরুদ্দেশ,

কিন্তু না, দমেনি মানুষ,

থামেনি যুদ্ধ,

হ’ল বিদ্রোহ ঘোষণা---

সৈন্যদলে স্থানে স্থানে,

পালাবার পথ নেই জেনে

হ’ল হস্তান্তরিত শোষণ শাসনের,

পেলো রাজনৈতিক

স্বাধীনতা ভারতবর্ষ,

নেই তাতে অন্ন বস্ত্র

বাসস্থানের গ্যারান্টি,

পচে গলে মরছে

মানুষ রাস্তার ধারে,

দ্বীপান্তরে শুস্ক বনভূমিতে৷