প্রভাতী

উপস্থিত ৰুদ্ধি

Baba's Name
শ্রী প্রভাতরঞ্জন সরকার

‘তন্’ ধাতুর অর্থ হ’ল ৰেড়ে যাওয়া, অভিব্যক্ত হওয়া৷ যে মানুষ তার ভাবধারাকে নাচে–গানে অভিনয়ে–আবৃত্তিতে অভিব্যক্ত করতে পারে তার জন্যে ‘তন্’ ধাতুর উত্তর ড প্রত্যয় করে ‘ত’ শব্দ ব্যবহূত হয়৷ তাই এক্ষেত্রে ‘ত’–শব্দের একটি অর্থ হ’ল ণট বা অভিনেতা৷

অভিনেতার মধ্যেও অনেক সময় অদ্ভুত রকমের উপস্থিত ৰুদ্ধি দেখা যায়৷ সে বিচারে তিনি দু’দিক দিয়েই ‘ত’৷ অভিনয় জগতের ‘ত’–এদের উপস্থিত–ৰুদ্ধি সম্ৰন্ধে বা উপস্থিত ৰুদ্ধির স্বভাব সম্ৰন্ধে অনেক গল্প প্রচলিত আছে৷ দু’একটি গল্প তোমাদের শোনাচ্ছি ঃ

 সেটা তখন ইংরেজ আমল৷ আমি তখন দিনাজপুরে৷ উত্তর ৰাঙলার অন্যান্য শহরের মত দিনাজপুরও একটি মাঝারি রকমের ছিমছাম শহর ছিল৷ শহরটি ছিল আমার খুব প্রিয়৷ দিনাজপুর–বাসীর স্বভাবের একটি বৈশিষ্ট্য আমার খুবই ভাল লাগত৷ ওঁরা*(*ওনারা, যেনারা, তেনারা শব্দগুলি গ্রাম্য দোষে দুষ্ট৷ ওঁরা, যাঁরা, তাঁরা–ই শুদ্ধ ওনারা, যেনারা, তেনারা না লেখাই ভাল৷) ছিলেন খুবই নাচ–গান–ভিনয় প্রিয়৷ সেকালে স্থায়ী অভিনয়মঞ্চ কোলকাতার বাইরে আর কোনো শহরেই ৰড় একটা ছিল না৷ কিন্তু দিনাজপুরে তা–ও ছিল৷ কয়েকজন স্থানীয় অভিনেতা তখন রীতিমত প্রথিতযশা হয়ে পড়েছেন৷ কেবল শহরেই নয়, গ্রামাঞ্চলের দিকেও থিয়েটারের রমরমা৷ সেই সময়টায় ওই দিকটায় ‘সীতা’ নাটকটি জনপ্রিয়তার তুঙ্গে৷ সীতার ভূমিকায় অভিনয় করে যিনি দু’হাতে যশ কুড়িয়েছিলেন, তাঁর নাম ছিল সম্ভবতঃ আব্দুল লতিফ৷

সীতা নাটকের অভিনয় চলছে৷ শহরে হাজার হাজার গোরুর গাড়ীর ভীড়৷ গ্রামের লোক ঝেঁটিয়ে এসেছে অভিনয় দেখতে৷ হাতে পাট বেচার তাজা টাকা৷ দরকার পড়লে অভিনয়ের জন্যে ৰেশ কিছু খরচ করতেও তৈরী৷

অভিনয় চলছে৷ নাটক তার চরম স্তরে ন্তুপ্তন্প্প্ত্রপ্রগ্গ এসে পৌঁছেছে৷ এবার সীতার পাতাল প্রবেশ৷ ধরিত্রী মাতাকে সম্বোধন করে সীতাকে যা বলতে হবে তার মোদ্দা কথা হচ্ছে–‘‘মাতঃ বসুন্ধরে, দ্বিধা হও, আমি তোমার স্নেহময় অঙ্গে স্থানলাভ করি’’৷ আব্দুল লতিফে.র নাটকের ভাব ষোল আনাই জানা, ভাষাও অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ঠোঁটস্থ৷ এই বিশেষ স্থানটিতে সীতা ধরিত্রী মাতাকে সম্ৰোধন করে যা বলবেন তার ভাবটিও তাঁর জানা আছে৷ কিন্তু ভাষা একটু গোলমেলে হয়ে গেছে৷ সেই মাহেন্দ্রক্ষণে ‘‘মাতঃ বসুন্ধরে’’ বলার পরই স্মারকের হ্মব্জপ্সপ্পহ্মব্ধন্দ্ এসে গেল দারুণ কাশি৷ সে কাশির চোটে আর কথা বলতে পারছে না অথচ সীতা তো আর তার প্রত্যাশায় মুখ ৰন্ধ করে দাঁড়িয়ে থাকতে পারে না৷ সে তখন উপস্থিত ৰুদ্ধি প্রয়োগ করে বললে–‘‘মাতঃ বসুন্ধরে, তুই ফাঁক হ, মুই ভিতরত্ ঢুকিম্’’৷

দেখলুম, এ জিনিসটা শ্রোতারা সহজেই গ্রহণ করলেন৷ নাটকের কিছুমাত্র রসভঙ্গ হ’ল না৷

রাঢ়ের মাটি সৃষ্টির ঘাঁটি

লেখক
শিবরাম চক্রবর্ত্তী

রাঢ় বাংলাই এই পৃথিবীর

সৃষ্টির মূলে থাকার ফলে,

শুনেই তাই আনন্দের ক্ষীর

খেয়ে বাঙালী নেচেই চলে৷

শ্রী প্রভাতরঞ্জন সরকার

যুক্তিসহ প্রমাণ দিতে,

‘সভ্যতার আদিবিন্দু রাঢ়’

বই লিখে তার কাটেন ফিতে৷

পুরাতত্ত্ববিদগণেরা

এই বইটি বিষদ ভাবে,

পড়লেই ভাল জানবেন তাঁরা

জগৎ সৃষ্টি হলো কবে৷

সে যাই হোক, সৃষ্টির মূলেই

রাঢ় বাংলাকে পেয়ে যেতে,

সভ্যতাও তাই রাঢ় থেকেই

ছড়িয়ে যায় বিশ্বের ক্ষেতে৷

রাঢ়ের মাটি নিয়ে ল্যাবে

কেহ পরীক্ষা করলে পরে,

সে ঠিক নোবেল প্রাইজ পাবে

আর অর্থও আসবে ঘরে৷

পি.আর. সরকারের এই আবিষ্কার

সে দিন সত্য প্রমাণ হ’লে

তখন তাঁর খুব বাহবার

পথে আসবে সবাই চলে৷

আর এতেই বিশ্বের সাথে

আম বাঙালীর ভরবে বুক,

তখন সবাই একাত্মাতে

রাঢ় বাংলার মিটাবে দুখ৷

নির্ভীক বাঙালী ব্যরিষ্টার

লেখক
প্রণবকান্তি দাশগুপ্ত

নোয়াখালিতে এসেছেন এক বাঙালী ব্যরিষ্টার৷ আসামীর বিরুদ্ধে চুরির অভিযোগ৷ আসামীর পক্ষ নিয়ে তিনি এসেছেন৷ বিপক্ষে কারগিল সাহেব৷

বাঙালী ব্যরিষ্টার---সে আবার কেমন ধারা প্রাণী--- বিশেষ করে যে সাহেবের সঙ্গে লড়তে আসে? কৌতূহল হলো গ্রামবাসীদের৷ কৌতূহল চরিতার্থ করবার জন্য তারা দলে দলে আদালত প্রাঙ্গনে এসে ভীড় জমালো৷ বেলা হবে বলে কাপড়ের কোণে চিড়ে মুড়ি বেঁধে আনলো৷

শুরু হলো মামলা৷ শুরু হলো জেরা৷ অভাবনীয় ব্যাপার৷ মূহূর্ত্তে সকলের দৃষ্টি কারগিলের থেকে সরে গিয়ে পড়লো বাঙালী ব্যরিষ্টারের ওপর৷

বাঙালী ব্যরিষ্টার যেন অক্টোপাশ৷ কারগিল অক্টোপাশের ঘেরাজালে যেন পোকার মতো ধরা পড়েছে৷ আষ্টেপৃষ্টে বাঙালী ব্যরিষ্টার ঠেসে ধরলেন কারগিলকে৷ জেরার পর জেরা.. তার ওপরে জেরা...পালাবার পথ নেই যম আছে পিছে৷

হিমশিম খেয়ে গেলেন কারগিল৷ ঘাম ছুটে গেল সারা শরীরে৷ এত সহজেই নেটিভ ব্যরিষ্টারের কাছে হার স্বীকার অসম্ভব৷ তিনি শুরু করলেন জেরা৷ কিন্তু তা কতক্ষণ? ক্ষুরের কাছে ব্লেড কতক্ষণ? নাস্তানাবুদ হয়ে পড়লেন কারগিল৷ কালো ব্যরিষ্টারের প্রতি ঘৃণায় সারা শরীর বিষিয়ে উঠলো তাঁর৷ তারপর? তারপর বাচ্ছা ছেলেরা হেরে গিয়ে কি করে? গালাগালি দিতে শুরু করে বিপক্ষকে৷ প্রথম থেকেই কারগিল বাঙালী ব্যরিষ্টারকে ‘বাবুবাবু’ বলে সম্বোধন করছিলেন৷ হেরে গিয়ে এবার যেন আরো বাড়াবাড়ি শুরু করলেন৷ কারণে অকারণে ‘বাবু’ সম্বোধনে বাঙালী ব্যরিষ্টারকে হেয় প্রতিপন্ন করতে লাগলেন৷ নিয়ম হচ্ছে ‘মিস্টার’ বলে সম্বোধন করার৷

প্রথম প্রথম বাঙালী ব্যরিষ্টার খেয়াল করলেও প্রতিবাদ করবার অবকাশ পাননি৷ এবার তিনি হুংকার দিয়ে উঠলেন, ‘বাবু’ আপনি কাকে বলছেন?

তাও কি বুঝতে অসুবিধা হচ্ছে? ভ্রূ কুঁচকে জবাব দিলেন কারগিল৷

বাঙালী ব্যরিষ্টার বললেন, আমি জানতাম কারগিল সাহেব এক শিক্ষিত লোক৷ এখন দেখছি তিনি সামান্য ভদ্রতা বা নিয়মটুকুও জানেন না৷

আদালতের সকলের দৃষ্টি যেন এবার হুমড়ি খেয়ে পড়লো কারগিলের ওপর৷

কারগিল লজ্জায় অপমানে রাগে লাল হয়ে উঠলেন৷ ঝাঁঝিয়ে বলে উঠলেন, তা আপনাকে কি বলে সম্বোধন করতে হবে?

কেন, আপনার দেশই ইংল্যাণ্ড আর এখানে হাইকোর্টে জজেরা ‘মিস্টার দাশ’ বলেই আমাকে সম্বোধন করেন৷ ব্যরিষ্টারের প্রতি ব্যরিষ্টারের সম্বোধনের ওটাই রীতি৷ আপনিও সেইভাবে সম্বোধন করবেন৷ ধীরে সুস্থে অথচ বেশ জোর দিয়েই কথাগুলো বললেন বাঙালী ব্যারিষ্টার৷

কী, এতবড় স্পর্ধা! খাড়া হয়ে উঠলেন কারগিল৷ ভাবটা এইরকম--- আদালতের বাইরে হলে তোমায় দেখে নিতাম৷

বাঙালী ব্যরিষ্টার মৃদু হাসলেন৷ তিনি যেন বলতে চান--- সাহেব, তোমার ওই আস্ফালনই সার৷

কে জানো এই নির্ভীক বাঙালী ব্যরিষ্টার? ইনিই হলেন দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ৷ দেশের জন্য যিনি সর্বস্ব বিলিয়ে দিয়েছিলেন৷

কৌশিক খাটুয়ার কবিতা

 

(১)

পূব দিগন্তে রবির হাসি

কাটিয়ে বর্ষা রাত

শিশির ভেজা শিউলি ফুলে

স্নিগ্দ সুপ্রভাত৷

 

কালো মেঘের চোখ রাঙানি

কোথায় ভেসে যায়

হৃদয়ে বাইরে সোনালী ভোর

ছিল যে প্রতিক্ষায়৷

 

(২)

তোমার চরণ রেখা

চির প্রত্যাশিত সখা

সেই পথ মোর গতিপথ,

যে পথে আলোক শিখা

সূর্য চন্দ্র নীহারিকা

সুসজ্জিত করে তব রথর

কাঁচা বেঁশো হ্যাংলামি

Baba's Name
শ্রী প্রভাতরঞ্জন সরকার

‘ক্রুড্’ ধাতুর একটি অর্থ ‘হ্যাংলামি করা’ বা ‘ন্যালা খ্যাপামি করা’ –কাঁচা বাঁশের মত হ্যাংলামি বা ন্যালা খ্যাপামি যা শুণলেই বোঝা যায়, দেখলেই ধরা যায় অথবা এমনও কেউ কেউ থাকে যারা ধরা পড়বার জন্যেই এই রকম হ্যাংলামি বা ন্যালাখ্যাপামি করে থাকে৷ যেমন নেম্তন্ন বাড়ীতে তোমার আরও কয়েকটা রসগোল্লা খাবার ইচ্ছে হল৷ তুমি পাশের ভদ্রলোকটির পাত দেখিয়ে বললে......ও দাদা, এদিকে, এদিকে, এঁর পাতে কয়েকটা রসগোল্লা দিন৷

রসগোল্লা পরিবেশনকারী কাছে এলে তাকে বললে–আমায় আর দেওয়া কেন! আমার পাতে পরে দেবেন (আসলে পরিবেশনকারী তাকে দিতে আসেন নি, এসেছিলেন পাশের লোকটিকে দিতে)৷ পরিবেশনকারী দিতে গেলে বললে–না, আমার আর চাই না, পেট ভরে গেছে৷ আবার হ্যাংলামি করে বললে–তা দেবেন যখন অন্ততঃ চারটে দিন৷ একগণ্ডার কমে কি ভাল দেখায়! এতে পরিবেশনকারী বুঝে নিলেন, যিনি পরিবেশনকারীকে ডেকেছিলেন তাঁরই রসগোল্লা দরকার......আর চারটে দরকার৷ এই ধরণের হ্যাংলামির জন্যে ক্রুড/ক্রুড়, শব্দটি চলবে৷ চলবে ক্রুূযৎ ঞ্চ ক্রড্য শব্দটিও (ক্রুড়া হয় না)৷ একবার দেখেছিলুম জনৈকা মহিলা–তিনি ছিলেন একজন মস্তবড় অফিসারের মাতাঠাকুরাণী–একজন মধ্যবিত্তের বাড়ীতে গিয়ে তার লক্লকে লাউগাছটি দেখে বলেছিলেন–লাউ–এর ডগাগুলো ভারী সুন্দর দেখাচ্ছে তো৷ পোস্ত–বাটার সঙ্গে লাউডগা সেদ্ধ খেতে খুব ভাল লাগে৷ চাকরটাকে রোজই বাজারে পাঠাই৷ এসে বলে বাজারে আজকাল লাউডগা পাওয়া যাচ্ছে না৷ লাউডগা–পোস্ত সেই যে কোন মান্ধাতার আমলে খেয়েছিলুম, আজও যেন জিবে লেগে আছে৷ লাউ–ডগার মালিক কি আর করেন! মহিলার সঙ্গে কিছু লাউডগা পাঠিয়ে দিলেন৷ যাই হোক, এই কাঁচাবেঁশো হ্যাংলামি ভালভাবেই বুঝলে৷ সুতরাং ওই হ্যাংলা মহিলা হচ্ছেন ‘ক্রুড্যা’৷

আমার পরিচিত ভোলা মোড়লের ভাল রকমের বেগুনের চাষ ছিল৷ বর্ষার শেষে একদিন সে তার বেগুনবাড়ী থেকে বছরের প্রথম ফসলটি তুলে নিয়ে বাড়ীর দিকে যাচ্ছিল৷ আশা করেছিল, বর্ধমানের বাজারে নতুন মুক্তকেশী বেগুনের ভালই দর পাবে........তার একটু টেনেটুনে সংসার চলত৷ রাস্তায় সে পড়ে গেল হরু ভটচাজের খপ্পরে৷ হরু ভট্চাজ্ বললে–কি রে ভোলা, আজকাল তোর দেমাগে যে মাটিতে পা–ই পড়ে না৷ বামুন–বোষ্টমের প্রতি শ্রদ্ধাভক্তি হারালে ফল কি ভাল হয় জানিস তো মাথার ওপর নারায়ণ রয়েছেন৷ তিনি আমাকেও দেখছেন, তোকেও দেখছেন, বেগুনগুলোকেও দেখছেন৷ যাই হোক, বেগুনগুলো বেশ তেল কুচকুচে৷ কম আঁাঁচে পোড়াতে গেলে গায়ে তেলও মাখাতে হবে না৷ তা তু’ এক কাজ কর গা৷ আমাকে বেগুনগুলো দিতে হবে না৷ তু’ ওগুলো পুড়িয়ে যেন আমার প্রসাদ খাচ্ছিস ভেবে নিজেই খা গা যা৷ ভোলা মোড়ল আর কি করে! তার বুকের পাঁজর–ভাঙ্গা আট–দশটা বেগুন হরু ভটচাজকে দিয়ে দিলে৷ এই হরু ভটচাজ ছিল একটি নির্ভেজাল ‘ক্রুডা’৷

কোন একটা বিয়ে বাড়ীতে ভিয়েন বসেছে৷ অনিমন্ত্রিত পুণ্ডরীকাক্ষ ভট্টাচার্য্য হঠাৎ সেখানে পৌঁছে গেলেন৷ পুণ্ডু ভট্চাজ্ ছিলেন আমাদেরই বর্ধমান জেলার পুতুণ্ডু গ্রামের বাসিন্দে৷ মস্ত বড় ভিয়েন, কলকাতা থেকে বাছাইকরা হালুইকারেরা এসেছে৷

পুণ্ডু ভটচাজ্ বললেন–খাওয়াদাওয়ায় আমার তেমন আগ্রহ নেই৷ কিন্তু রান্নাবান্না দেখতে বড্ড ভালবাসি.....সেই ছোটবেলাকার স্বভাব৷

সবাই বললে–এসো,এসো, বসো, বসো৷ দেখো, কেমন খাবার তৈরী হচ্ছে৷

দেখে বোঝা গেল হালুইকারেরা খুব উন্নত মানের চমচম*(*সংস্কৃতে ‘চম্’ ধাতু হল গোগ্রাসে গিলে খাওয়া৷ একপক্ষের সৈন্য অন্য পক্ষের দেশে গিয়ে সব কিছুকে গোগ্রাসে গিলে খায়৷ এই অর্থে চম্ ধাতুূউস্ প্রত্যয় করে ‘চম্’ শব্দটি পাচ্ছি৷ ‘চমু’ মানে সৈন্যবাহিনী৷ ‘চমূড্ণ্’ করে ‘চম্’ শব্দটি পাচ্ছি, অর্থাৎ যা দেখে গোগ্রাসে গিলে খেতে লোকের ইচ্ছে হয়৷) তৈরী করছে৷ পুণ্ডু ভট্চাজ্ আর নোলা সামলাতে পারছে না৷ প্রাণে আকুতি জেগেছে, চমচম একেবারে খোলা থেকে নোলায় চলে আসুক৷ সে তখন স্বগতভাবে বললে, (বললে এমন ভাবে যাতে আর পাঁচটা লোকের বধির কর্ণেও তা প্রবেশ করে)–এককালে চমচম খেতে খুবই ভালবাসতুম৷ কবে সেই খেয়েছিলুম.......বাহাৰপুরের ঘোষেদের বাড়ীতে৷ এখনও যেন ভুলতে চাইলেও ভুলতে পারছি না৷ মন বারে বারে সেই চমচমে ফিরে যেতে চায়৷ এখন দু’চারটে চাখতে পারতুম কিন্তু সন্ধ্যে হয় হয়৷ সন্ধ্যে আহ্ণিক না করে খাই বা কি করে– তিন কাল গিয়ে এককালে ঠেকেছে–সে কথাও ভুলি কি করে৷

হালুইকারেরা বললে–সন্ধ্যে হতে এখনও একটু দেরী আছে৷

পুণ্ডু ভটচায্ আকাশের দিকে তাকিয়ে বললে–হ্যাঁ মনে হয় আধঘন্টাটাক সময় আছে৷

হালুইকারেরা বললে–তৰে দুটো সন্দেশ চেখেই দেখুন৷ আমার মনে হয় গণ্ডাখানেক চেখে নিয়ে হাত মুখ ধুয়ে ফেলাও সম্ভব৷

হালুইকারেরা কি আর করে! পুণ্ডু ভট্চাজ্কে একটা শাল পাতায় মুড়ে চারটে চমচম দিলে৷ এও সেই কাঁচা বেঁশো হ্যাংলামি৷ পুণ্ডুরীকাক্ষ ভট্টাচার্য হলেন একটি ডাকসাইটে ‘ক্রুড্ড’৷ যাই হোক, তোমরা ‘ক্রুড্’ ধাতুর রকমারি ব্যবহার দেখলে তো৷ (শব্দ চয়নিকা)

গল্পের গল্পকথা

Baba's Name
শ্রী প্রভাতরঞ্জন সরকার

অনেকে ভাবে ‘গল্পষৰ’ বুঝি একটি সংস্কৃত শব্দ৷ না, এটি একটি গৃহীত সংস্কৃত শব্দ অর্থাৎ যে শব্দ মূলতঃ সংস্কৃত নয়, অন্য ভাষা থেকে নেওয়া হয়েছে যেমন ‘গুবাক’, ‘রজ্জু’, পান অর্থে ‘পর্ণ’, মাছ অর্থে ‘মীন’, গ্রাম অর্থে ‘পল্লী’---এরা সবাই গৃহীত সংস্কৃত৷ ‘গল্প’ শব্দটি তাই-ই৷ গল্প / গল্পিকা দুটোই গৃহীত শব্দ৷ সংস্কৃতে এরকম গৃহীত শব্দগুলির অন্যতম বৈশিষ্ট্য হ’ল এদের ব্যুৎপত্তি পাওয়া যায় না৷

গল্পের সংস্কৃত হচ্ছে ‘কথা’ আর ছোট গল্পের সংস্কৃত হয় ‘কথানিকা’ (কথানিকা খ কহানিয়া খ কহানি খ কাহিনী)৷ হ্যাঁ, ‘গল্প’, ‘গল্পিকা’ শব্দগুলি সংস্কৃতে আদিমকালে ছিল না, গৃহীত হয়েছিল সম্ভবতঃ বাংলা বা মৈথিলী থেকে কারণ ওই দুটি ভাষাতেই ‘গল্প’ বা ‘গপ্প’ শব্দ চলে যার উর্দু হচ্ছে ‘কিস্‌সা’৷ বাঙলায় কেউ কেউ ওই ‘কিস্‌সা’ থেকে ‘কেচ্ছা’ শব্দ তৈরী করে নিয়েছেন৷ ‘কেচ্ছা’ শব্দের আর একটি অর্থ হ’ল নিন্দা বা ‘কুৎসা’৷ এখানে ‘কেচ্ছা’ শব্দটি সংস্কৃত কুৎসা শব্দ থেকে আসছে না....আসছে উর্দূ ‘কিস্‌সা’ শব্দ থেকে৷ উর্দুতে যদি বলি ‘মতিবিবি কি কিস্‌সা’৷ তার বাংলা হবে ‘মতিবিবির কেচ্ছা’৷ এই কিস্‌সা শব্দের হিন্দী ভাষার তদ্ভব রূপ হচ্ছে ‘কহানী’, বাংলায় তদ্ভব রূপ ‘কাহিনী’ অর্থাৎ হিন্দীতে হবে ‘মতিবিবি কী কহানী’, বাংলায় হবে ‘মতিবিবির কাহিনী’৷ শোনা যায় একবার নাকি মিথিলার কমতৌলে বা সৌরাষ্ট্রের সভাগাছিতে অর্থাৎ নবদ্বীপের পোড়ামাতলায় অথবা ভাটপাড়ায় গঙ্গার ধারে কিংবা কোটালীপাড়ার বটতলায় অথবা কাঁথির কাছে জুনপুটের সমুদ্রতীরে কিংবা কোচবিহারের রাসময়দানে অথবা হাসিশহরের (পণ্ডিতী নাম ‘কুমারহট্ট’) ইট-বেরিয়ে যাওয়া গঙ্গার ঘাটে পণ্ডিতেরা সবাই জড় হয়েছিলেন৷ ‘গল্প’ শব্দটির ইতিহাস আবিষ্কার করতে৷ তাঁদেরজন্যে রাজারাজড়াদের এমন কিছু খরচ করতে হয়নি---আনতে হয়েছিল এক শ’ মণ চা আর পাঁচ শ’ মণ নস্যি৷ পণ্ডিতেরা তিন দিন তিন রাত এই নিয়ে তর্ক করেছিলেন, চর্চা করেছিলেন, শুরু হয়েছিল সেই তৈলাধার পাত্র বা পাত্রাধার তৈল নিয়ে গবেষণা৷ তারপর এল ‘তাল্‌ পড়িয়া চ ঢপ্‌ শব্দ হইল, না ঢপ্‌ শব্দ হইয়া তরু হইতে তাল্‌ পড়িল’! অবশেষে এল তামাকের গুণাগুণ৷ পণ্ডিতেরা এ সম্বন্ধে সিদ্ধান্তে পৌঁছে গেলেন ধোঁয়ারূপেই হোক অথবা চূর্ণ রূপেই হোক (দোক্তা বা জর্দা বা নস্যি) তামাক সেবন মহা ফলদায়ী৷ সংস্কৃতে তামাকের নাম ছিল না৷ পণ্ডিতেরা গবেষণা করে নাম দিলেন ‘তাম্রকূট’৷ কিন্তু কিছু পণ্ডিত বলেছিলেন নাম রাখা হোক ‘স্বর্ণকূট’৷ কিন্তু অন্যরা বললেন, হৈমবতী উমা অর্থাৎ পার্বতীর সঙ্গে নামটি যুক্ত৷ তাই এটি চলবে না৷ কেউ কেউ নাম রাখতে চাইলেন ‘রজতকূট’ অন্যে আপত্তি করে বললেন---না, তাও চলবে না কারণ শিবের ধ্যান মন্ত্রে আছে---‘ধ্যায়েন্নিত্যং রজতগিরিনিভম্‌ সুতরাং সে নামও চলবে না৷ তা নিয়ে দেবতাদের মধ্যে মতভেদ নেই৷ তাই নাম রাখা হ’ল ‘তাম্রকূট’৷ কথ্য ভাষায় লোকে নাম রাখতে পারে টোবাকু, তাম্বাকু, তামাকু, তাংকু, তাতে ব্যকরণ সমর্থন করুক বা না করুক৷ ‘যার সঙ্গে যার মজে মন / কিবা হাঁড়ি কিবা ডোম৷ তাঁরা সিদ্ধান্তে পৌঁছুলেন---

‘‘তাম্রকূটং মহদদ্রব্যং শ্রদ্ধয়া দীয়তে যদি৷

অশ্বমেধসমপুণ্যং টানে টানে ভবিষ্যতি৷’’

অর্থাৎ তামাকু একটি মহৎদ্রব্য৷ কেউ যদি শ্রদ্ধার সঙ্গে কাউকে তামাক অফার করে তাহলে প্রাপক যেমন এক-একটা টান দেবেন দাতা তেমনি এক-একটি করে অশ্বমেধ যজ্ঞের সমান ফল পেতে থাকবেন৷

সবই তো হয়ে গেল৷ এবার পণ্ডিতেরা এলেন আসল বিষয়ে৷ অনেক গবেষণার পর ওঁরা বললেন ঃ তিন বন্ধু ছিল---গণেশ, ললিত, পরেশ৷ ওরা একবার বক্সীর হাট থেকে বেড়িয়ে তোর্সা নদী পার হয়ে যাচ্ছিল মাথাভাঙ্গা গণেশ লম্বা চেলে সে গরমকালে তোর্সা নদীর কোমড় জল পার হয়ে গেল৷ পরেশ আরো লম্বা৷ গরমকালে তোর্সা নদী তারকাছে হাঁটু জলের সামিল৷ কিন্তু ললিত বেঁটেখাটো৷ তাকে বলা হ’ল তুই নদী পার হতে পারবি?

ও বললে---মুই পরিম না৷

তখন পরেশ ওকে নিজের কাঁধের ওপর বসিয়ে নিল৷ এখন পণ্ডিতেরা মানস দৃষ্টিতে ওই ছবিটা দেখে নিলেন ঃ তোর্সা নদীর মাঝ বরাবর দাঁড়িয়ে আছে গণেশ আর নামের প্রথম অক্ষর ‘গ’৷ আর একটু পেছনে দাঁড়িয়ে আছে পরেশ যার নামের অক্ষর ‘প’৷ আর পরেশের কাঁধে রয়েছে ললিত যার নামের প্রথম অক্ষর ‘ল’৷ সবার আগে ‘গ’, পেছনে ‘প’ অক্ষর তার মাথার ওপরে ‘ল’৷ এই হ’ল ‘গল্প’ এর ইতিহাস....নবতর পুরাণ৷          (শব্দচয়নিকা ২১/১০৭)

লক্ষ্মী যখন আসবে

লেখক
প্রণবকান্তি দাশগুপ্ত

কোজাগরী পূর্ণিমায় অনুষ্ঠিত হয় লক্ষ্মীপূজা৷ লক্ষ্মীপূজার ইতিহাস খুব বেশি প্রাচীন নয়৷ দ্বাদশ শতকের পর থেকেই লক্ষ্মীপূজার প্রচলন ঘটে! তার আগে শুধু কোজাগরী পূর্ণিমা পালিত হত৷

লক্ষ্মীর মত বাঙালীর আর কোন পূজায় এমন অঙ্কন-শিল্পের অবকাশ নেই৷ যদিও আঁকা-আঁকির ব্যাপারটা প্রায় সব মেয়েলি ব্রতে অল্প-বিস্তর আছে৷ লক্ষ্মীপূজা মেয়েদেরই পূজা, তাই এর সজ্জার দায়িত্বও প্রধানত মেয়েরাই পালন করে পূজায় অঙ্কন-শিল্পের বেশিরভাগই জুড়ে থাকে আল্পনা৷ সকাল থেকে ঘরে ঘরে মেয়েরা আল্পনা দেয়৷ বিভিন্ন ব্রতের বিভিন্ন আল্পনা! লক্ষ্মীপূজার আল্পনায় থাকে পদ্মলতা, লক্ষ্মীর পদ-চিহ্ণ, লক্ষ্মী পেঁচা ও ধানছড়া৷ নিয়ম ছিল যেখানে সেখানে আল্পনা আঁকার রীতি নেই৷ যে-ঘরে ধান চাল বা অন্যান্য জিনিসপত্র থাকে সেই বড়ঘরের মেঝেতে আল্পনা এঁকে তার ওপর লক্ষ্মীর চৌকি পাততে হয়৷ আল্পনায় থাকবে নানারকম অলংকার৷ চৌকিতে লক্ষ্মীর মুকুট আর পদদ্বয় অথবা পদ্মের ওপর পদযুগল৷ খুঁটি বা দেওয়ালের গায়ে আঁকতে হয় লক্ষ্মীনারায়ণ, লক্ষ্মী পেঁচা, পদ্ম, ধানছড়া, কলমীলতা, দোপাটিলতা ও লক্ষ্মীর পা৷ রচনার ভাঁড়ের. গায়ে আঁকতে হয় ধানছড়া ও লক্ষ্মীর পা৷

আল্পনায় রঙের কাজও আছে৷ বেশিরভাগ আপ্পনাই সাদা চালের গুঁড়ো বা চাল ভিজিয়ে বেটে তার গোলা দিয়ে আঁকা হয়৷ রচনার পাতিলের ওপর যে-লক্ষ্মীর সরা’ থাকে সেই, সরার পিঠে লাল নীল সবুজ হলদে কালো এই কয়টি রঙ দিয়ে-লক্ষ্মীনারায়ণ লক্ষ্মী পেঁচা ইত্যাদি আঁকতে হয়৷ লক্ষ্মীর কাপড়ের রঙ হবে’ সবুজ ৷ পদযুগল ঠোঁট এবং করতল লাল ৷ গাত্র হলুদ৷ বিচিত্র কারুকার্য সমম্বিত নীল বর্ণ পটভূমিকায় হয় মা লক্ষ্মীর স্থাপনা !

আল্পনার চালের গোলা রঙিন করার জন্য হলুদ বাটা, শিমপাতার রস ও আলতা ব্যবহার করা হয়৷

(লক্ষ্মীকে মানুষ ধানের অধিষ্ঠাত্রী দেবী বলে মনে করে৷ পূর্ব ভারতের অনেক জায়গায় মেয়েরা বারোমাসে বা সাপ্তাহিক লক্ষ্মী হিসাবে তাঁর পূজা করে৷ (নমঃ শিবায় শান্তায়--- শ্রীশ্রীআনন্দমূর্ত্তি)

শুভ বিজয়া

লেখক
কৌশিক খাটুয়া

আজি বিজয়ার পুণ্য শুভ লগনে,

একতার সুর বহিছে পবনে গগনে৷

 দূর কেহ নয় পর কেহ নয়

 সকলেই আমার আত্মীয়,

 সবার মাঝে লুকিয়ে যিনি

 তিনি আমার ধ্যানের ধ্যেয়৷

ছোটোদের স্নেহ, বড়োদের প্রীতি,

 প্রণামে করি স্মরন,

শ্রীচরণে মোর প্রণাম নিবেদনে

গুরুকে স্মরিয়া জগৎ বরণ৷

ভগিনী নিবেদিতা (২৮শে অক্টোবর জন্মদিন)

লেখক
প্রণবকান্তি দাশগুপ্ত

তোমার ছিলনা জাতি ভেদ-বিদ্বেষ,

ভারতকে তাই করেছিলে নিজ দেশ৷

সারাটা জীবন ভারতের হিত-কাজে

ছিলে নিয়োজিত শত সঙ্কট মাঝে৷

স্বামীজীর মুখে শুনে ভারতের বাণী

দেখেছিলে মহাজীবনের হাতছানি৷

প্রিয় দেশ, প্রিয় জন, প্রিয় সংসার---

সব কিছু ফেলে নিয়েছিলে মহাভার৷

মুগ্দ হয়েছো ভারতের মহিমায়,

ধন্য হয়েছো ভারতের সাধনায়৷

জীবন সঁপেছো ভারতের কল্যাণে---

ভারতের শাশ্বত ভাব রূপ দানে৷

তাই তো আমরা

আজিকে তোমায় স্মরি---

আমাদের মাঝে ফের আহ্বান করি৷৷

ব্যাপ্তির শিক্ষা

লেখক
আচার্য গুরুদত্তানন্দ অবধূত

দেখবো ঘুরে জগতটাকে

শিখবো সব হেকে ডেকে

চরণ চিহ্ণ এঁকে যাবো

এই করেছি পণ,

যতই বাধা আসুক পথে

চলবো অনুক্ষণ৷

আসছে মানুষ যাচ্ছে ফিরে

হচ্ছে দেখা ক্ষণিক তরে

নিচ্ছে প্রীতি পরাণ ভরে

তুলি, মধু রণন...

যতই বাধা আসুক পথে

চলবো অনুক্ষণ৷

দুঃখ বেদন যাহা থাকুক

শীত উত্তাপ যতই লাগুক

খাবার দাবার যাহা জুটুক

লক্ষ্যে সদা মন,

যতই বাধা আসুক পথে

লড়বো অনুক্ষণ৷

প্রিয়জনে কাছে পাওয়া

মধুতাণে হচ্ছে নাওয়া,

সবার সুখে সুখী হওয়া

এইতো জীবন,

যতই বাধা আসুক পথে

চলবো অনুক্ষণ!