মানব ইতিহাস গড়ে ওঠে সামূহিক আকুতি বা সামবায়িক মনস্তত্ত্বকে কেন্দ্র করে৷ অতীতে ইতিহাস সম্বন্ধে জনগরের ধারণা ছিল এই যে ইতিহাস মানেই হ’ল কোন রাজা বা রাণী কিছু দিনের জন্যে রাজ্যশাসন করৰেন, কয়েকটা যুদ্ধ পরিচালনা করৰেন,---কোনটাতে জিতৰেন, কোনটাতে হারৰেন---কোথাও বা তারা শত্রুপক্ষকে হত্যা করছেন, কোথাও বা তারা নিজেরাই নিহত হচ্ছেন---এ সৰেরই ঘটনাপঞ্জী৷ কিন্তু আজকের ইতিহাস সম্বন্ধে ধারণা সম্পূর্ণ ভিন্ন৷ আজকাল ইতিহাস ৰলতে কেবল রাজা-মহারাজাদের ইতিহাস ৰোঝায় না৷ সাধারণ মানুষের ইতিহাসকেও ৰোঝায়৷ সাধারণ মানুষের এষণা, আকুতি, মনোজাগতিক চিন্তাধারা এ সবকিছুই ইতিহাসের আলোচ্য বিষয়৷
সুপ্রাচীন সমাজে নারী-পুরুষের সমানাধিকার ছিল৷ পরবর্ত্তীকালে সমাজে নারীর গুরুত্ব ৰেড়ে যাওয়ায় এক নূতন ধরণের সমাজ ব্যবস্থার উদ্ভব হ’ল যাকে ৰলা যেতে পারে মাতৃগত(Matrilineal) ও মাতৃপ্রধান(Matriarchal) ব্যবস্থা৷ এর আরও পরবর্ত্তীকালে দৈহিক শক্তির গুরুত্ব অন্য্যান্য শক্তির চেয়ে আরও ৰড় হয়ে দেখা দিল৷ স্বভাবতই নারীর চেয়ে পুরুষের দৈহিক শক্তি বেশী থাকায় তাদের গুরুত্ব গেল ৰেড়ে৷ এরই ফলশ্রুতিতে এক নূতন ধরণের সমাজ ব্যবস্থার উদ্ভব হ’ল যাকে ৰলা যেতে পিতৃগত(Patrilineal) ও পিতৃপ্রধান(Patriarchal) সমাজ ব্যবস্থা৷ কিন্তু আজকের যুগে মানুষ অনুভব করছে যে ৰৌদ্ধিক শক্তির তুলনায় দৈহিক শক্তির গুরুত্ব কম৷ অতীতে মানুষ একটা হাতুড়ি চালাতে গিয়ে প্রচুর দৈহিক শক্তি প্রয়োগ করত৷ কিন্তু আজকে একটা বৈদ্যুতিক হাতুড়ি একটা লোহার হাতুড়ির চেয়ে শতগুণ বেশী শক্তিশালী৷ আর একটা বৈদ্যুতিক হাতুড়িকে একটা অতি সাধারণ ইলেকট্রিক সুইচ টিপে দিয়েই চালানো যায়৷ এটাই প্রমাণ করে যে আজ ৰৌদ্ধিকতার গুরুত্ব ৰেড়ে চলেছে৷ হ্যাঁ, এখন প্রশ্ণ হ’ল নারী জাতির জাগরণ ঘটৰে কি ভাবে? ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে এখানে কয়েকটা কথা ৰলা দরকার মনে করছি৷ নারী জাগরণের ফলে আগামী দিনে নারী-পুরুষের সমানাধিকার আসৰে৷ কেউ কারো চেয়ে ছোট বা ৰড় ৰলে গণ্য হৰে না৷ অনাগত দিনগুলিতে যা সবচেয়ে গুরুত্ব পাৰে তা হচ্ছে ৰৌদ্ধিক প্রাখর্য৷ আর সেই প্রখর ৰুদ্ধি কেবল পুরুষের বা কেবল মেয়েদেরই একচেটিয়া ভাবে থাকৰে এমন কোন কথা নেই৷ আর যারই এই ৰৌদ্ধিক প্রাখর্য থাকৰে সে-ই সমাজে প্রতিষ্ঠা লাভ করৰে৷ অবশ্য এ ব্যাপারে সকলের ৰুদ্ধির প্রাখর্য সমান হৰে না৷
ইতিহাস রচিত হয় সামূহিক মনস্তত্ত্বের ভিত্তিতে৷ রাজতন্ত্রের দিন চলে গেছে৷ রাজতন্ত্রের সেই গৌরবোজ্জ্বল যুগে রাজা বা রাণীই ছিলেন ইতিহাসের কেন্দ্রৰিন্দু৷ আর ইতিহাস বলতে ৰোঝাত রাজা-মাহারাজাদের ইতিহাস৷ পরবর্ত্তীকালে ইতিহাস হয়ে দাঁড়াল মন্ত্রী-অমাত্যদের ইতিহাস৷ আৰার শীঘ্রই এমন দিন আসছে যখন ইতিহাস রচিত হৰে সাধারণ মানুষকে নিয়ে৷ রাজতন্ত্রের যুগে কেউ ভাবতেও পারত না যে রাজা-রাণীদের বাদ দিয়ে ইতিহাস লেখা যেতে পারে৷ আজও যেখানে রাজতন্ত্র নেই সেখানেও সরকারী ভবনগুলোকে রাজভবন ৰলা হয়৷ ‘রাজা’ শব্দের যাদু থেকে মানুষ এখনও নিজেদের পুরোপুরি মুক্ত করতে পারেনি৷ কোন একটা শহরে দেখেছিলুম সাইনৰোর্ডে লেখা রয়েছে, ‘‘রাজানুকুল হাসপাতাল’’ যার মানে হচ্ছে সরকার পরিচালিত হাসপাতাল৷ সেকালে দেওয়ানীখাসে রাজা ও আমীর-ওমারাহরা প্রাধান্য পেতেন৷ আজকাল সরকারী কর্মচারীদেরই প্রাধান্য৷ তাই নূতন শব্দ ‘‘সেক্রেটারিয়েট’’-এর উদ্ভব হয়েছে৷ অনুরূপভাবে সাধারণ মানুষের মধ্যেও একটা নূতন চেতনা জাগৰে৷ সঙ্গে সঙ্গে জনসাধারণের মধ্যেও শক্তি ৰুদ্ধির প্রাখর্য-ও জাগৰে, তারই ফলশ্রুতি হিসেৰে ইতিহাস লেখার ধারা পাল্টে যাৰে৷ বস্তুতঃ এক নূতন ধাঁচের ইতিহাস ইতোপূর্বেই পাল্টানো শুরু হয়েছে, ভবিষ্যতে আরও পাল্টাৰে৷ মনে রাখৰে তোমরা মানুষের সমাজে কেউ অপাংক্তেয় নও৷ এমনকি একশ’ বছরের যে অতি ৰৃদ্ধা বিধবা মহিলা, তারও জীবনের মূল্য অপরিসীম৷ এই বিশ্বসভায় সে-ও বর্জনীয় নয়, সেও তুচ্ছ নয়, আমরা তার সঠিক মূল্যায়ণ করতে পারিনি ৰলে আমরা ভাবি যে সে বুঝি পৃথিবীর ৰোঝা৷ এরকম ভাবাটা আমাদেরই ৰুদ্ধির অল্পতার নিদর্শন, তার দোষ নয়৷ এইভাবেই সৰের পেছনেই আছে একটা ঐতিহাসিক প্রয়োজন৷ আমরা মাথা ঘামাইনা৷ এই প্রায়োজনটা কী তা খুঁজে ৰার করবার জন্যে যদি মাথা ঘামাতুম তৰে জানতে পারতুম, প্রতিটি ব্যাপারেই, পৃথিবীর প্রতিটি অতি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র উহ-অবোহের পেছনে রয়েছে এই জিনিসটা৷ আমরা যদি তলিয়ে ভাবি, তলিয়ে দেখি, ইতিহাস খোঁজার চেষ্টা করি তাহলে দেখৰ কোন কিছুই ব্যর্থ নয়৷ সব কিছুই ঘটে চলেছে ভবিষ্যতের একটা বিরাট সম্ভাবনা নিয়ে৷ বিশ্বের কোন কিছুই গুরুত্বহীন নয়৷ কোন কিছুকেই তাই তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করা চেলে না৷ অণু-পরমাণুকে এককালে খুবই ক্ষুদ্র ও গুরুত্বহীন ৰলে মনে করা হত৷ কিন্তু আণবিক ৰোমার আবিষ্কারের পর থেকে মানুষ সেই অণুকেই ভয়ের চোখে দেখতে লাগল৷ কেউই ঠিক ভাবে জানে না কোন জিনিসটার মধ্যে কী ধরণের সম্ভাবনা নিহিত আছে৷ কেবল পুঙ্খানুপুঙ্খ গবেষণার পরেই কোন বস্তুর অন্তর্নিহিত শক্তি সম্বন্ধে মানুষ একটা সম্যক ধারণা গড়ে তুলতে পারে৷ এ জগতে সকলেই একটা ঐতিহাসিক প্রয়োজন পূর্ত্তির জন্যেই আসে৷ আনন্দমার্গেরও তাই কোন ঐতিহাসিক উদ্দেশ্যের পরিপূর্ত্তির জন্যে আবির্ভাব ঘটেছে৷
তখন আমার বয়স খুবই কম৷ সেটাও অনেকদিন হয়ে গেল৷ তখন জীবনের সকল ক্ষেত্রেই ৰড় রকমের অবিচার চলছে৷ সঙ্গীতে, সাহিত্যে, সিনেমায় সামাজিক অবক্ষয়ের সুস্পষ্ট চিহ্ণ ফুটে উঠেছে৷ সর্বত্রই চলছে ব্যাপক শোষণ৷ সাম্রাজ্যবাদী শোষণ, সামাজিক শোষণ, অর্থনৈতিক শোষণ এরূপ কতরকমের শোষণ চলছে৷ সমাজে নারীর অবস্থা ছিল খুবই খারাপ৷ কিছুদিন আগে পর্যন্ত নারীর কোন বোটাধিকার ছিল না৷ প্রাচীন বিহারের বৈশালীতে যে লিচ্ছবি প্রজাতন্ত্র প্রচলিত ছিল সেখানে নারীর বোট দেবার অধিকার ছিল (আজ থেকে প্রায় আড়াই হাজার বছর আগে এই পৃথিবীতে সর্বপ্রথম প্রজাতন্ত্র ছিল এই লিচ্ছবি প্রজাতন্ত্র) কিন্তু তারা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় অংশ গ্রহণ করতে পারতেন না৷ সর্বত্রই নারীর অধিকারকে সঙ্কুচিত করার একটা প্রবণতা ছিল৷ কোন দেশেই কোন নারীর আইনের চোখে সমানধিকার ছিল না৷ শুধু সাম্প্রতিকালে কিছুটা সংঘর্ষের মধ্য দিয়ে নারীরা কিছুটা অধিকার অর্জন করেছে৷ কিছু শোষক পুরুষ (সব পুরুষই শোষক ছিলেন না, তাদের অনেকেই আবার যথেষ্ট বিবেকবান ছিলেন) চেয়েছিলেন নারীদের শোষণ করতে তারাই নারী সমাজকে স্বাধীনতা দিতে প্রস্তুত ছিলেন না৷ তারা ভাবতেন যে মেয়েরা মুক্তি-মোক্ষ লাভ করৰে৷ ভেবে দেখতো এই সব পুরুষের ঔদ্ধত্য ও দুষ্ট ৰুদ্ধি কতখানি৷ তারা নারী সমাজের মনে স্থায়ীভাবে হীনম্মন্যতাৰোধ জাগিয়ে দিয়ে নারীদের শোষণ করার কত শত উপায়ই না উদ্ভাবন করেছিল৷ আজ তাদের সমস্ত দুর্ৰুদ্ধির মুখোস খুলে গেছে৷ নারীকে শোষণের আরও ভুরি ভুরি উদাহরণ রয়েছে৷ ফ্রান্সের আইন অনুযায়ী মেয়েদের সিংহাসনে আরোহণের অধিকার ছিল না৷ মনুর যুগে স্বামীরা স্ত্রীদের জুতো দিয়ে মারত কিন্তু আজকের দিনে হলে মানুষ এতে ক্ষুব্ধ হয়ে জোরাল প্রতিবাদ জানাৰে৷
সামূহিক মনস্তত্ত্বে একটা দ্রুত পরিবর্তন আসছে৷ মানুষের সমাজে দৈহিক শক্তির চেয়ে ৰুদ্ধির মূল্য ৰেড়ে চলেছে ও ৰুদ্ধি কেবল মুষ্টিমেয়ের নয়, সামূহিক জীবনেও ৰাড়ছে৷ তাই এই পরিবর্তন৷ এই পরিবর্তন আরও আসৰে, আরও ত্বরান্বিত হৰে৷
শ্রাবণী পূর্ণিমা ১৯ আগষ্ট, ১৯৮৪ কলিকাতা