পূর্বপ্রকাশিতের পর
কতগুলো আরোপিত গুণ বা বৈশিষ্ট্য দেহধারে মানুষকে প্রবৃত্তিগত বা স্বভাবগত মানুষে পরিণত করে৷ আরোপটা প্রকৃতিগত, পরিবেশগত,জীবনে চলার পথে ঘাত -প্রতিঘাতগত, বৈবহারিক জীবনে মানুষ পারস্পরিক মিথষ্ক্রিয়াগত, শিল্পজাত ও দেহযন্ত্রের আন্তঃগ্রন্থী গ্রন্থীরস ক্ষরণজাত প্রভাবের সামূহিক ফল৷ সবটাই মনের অন্তঃক্রিয়ার ক্রমবিকাশের ধারা৷ বিবর্তনবাদ অনুসারে পৃথিবীর বুকে এ্যামিবা জাতীয় এককোষী প্রাণী থেকে কোটি কোটি বছরের বিবর্তনের ধারায় সব পৃথিবীর বুকে এ্যামিবা জাতীয় এককোষী প্রাণী থেকে কোটি কোটি বছরের বিবর্তনের ধারায় সব পৃথিবীর বুকে এ্যামিবা জাতীয় এককোষী প্রাণী থেকে কোটি কোটি বছরের বিবর্তনের ধারায় সব শেষে মানুষের আবির্ভাব৷ যুক্তির খাতিরে যদি নেয়া হয় ক থেকে খ-এর জন্ম, খ থেকে গ-এর, গ থেকে ঘ-এর---এইরকম ধারাটা চলমান৷ কিন্তু একটা স্তর থেকে যখন অন্য স্তরটা আসছে---জীবের উত্তরণ ঘটছে উন্নত স্তরে তখন তো ভিত্তি স্তরটার শেষ হয়ে যাচ্ছে বা হারিয়ে যাচ্ছে, বিনাশ হয়ে যাচ্ছে৷ তাহলে বিবর্তনটা কার হচ্ছে? নিরবিচ্ছিন্নভাবে একটা মৌলিক সত্তা তো থেকেই যাচ্ছে, নইলে বিবর্তন কথাটা মানে হয় না! একথা মেনে না নিলেই যত অনুপপত্তি৷ তাই তো বিরাট জিজ্ঞাসা---বিবর্তনটা কার? এর একটাই উত্তর---সেটা মনেরই বিবর্তন৷ দর্শন ও আধ্যাত্মবিজ্ঞানের দৃষ্টিতে মনেরই ক্রমবিকাশের ধারাতেই জীববৈচিত্র্য, সৃষ্টির বিচিত্ররূপ৷ তাই তো বলা হয়---এককোষী প্রাণী থেকে মানুষের আসাটা আসলে মনেরই ক্রমবিকাশের ধারা৷ মানুষের বা জীবের জীবনের ইতিহাস এক মনস্তাত্ত্বিক বিকাশের ধারা৷
বিকশিত মন যখন মানব আধার পেল, ‘মানুষ’ নামবাচক পদের স্বীকৃতি পেল তখন মানুষের মধ্যে কতগুলো গুণ বা ভাব বা বোধ লগ্ণ হ’তে শুরু করেছে৷ তা হল---ভাল, মন্দ ন্যায় অন্যায়-হিতাহিত-সদাসদ-ধর্মাধর্ম-কর্ত্তব্য, অকর্ত্তব্য-শুভাশুভাদি যাচাই বা বিচারের অন্তর্হিত শক্তি৷ একে এক কথায় বলে বিচারশীল মানসিকতা বা ‘বিবেক’ (কন্শেন্স্)৷ আর এই বিবেকবোধ মানুষের মনে তৈরী করে সহমর্মিতা, স্নেহ- মায়া মমতা প্রীতি- ভালবাসা- ক্ষমা - সৌজন্য-শিষ্টাচার-ভদ্রতা, সভ্যতা মানসিকতাদি৷ পক্ষান্তের এগুলো পারস্পরিকভাবে বিবেকবোধকেও পুষ্ট করে৷ আবার ভৌতিকগতভাবে এগুলোর উৎস মানুষের জৈববৈজ্ঞানিক যন্ত্রের ভিতরের চক্র (প্লেক্সাস্)-গ্রন্থির উপগ্রন্থির (গ্ল্যাণ্ড-সাব্গ্ল্যাণ্ড) রসক্ষরণে৷ যাই হোক, এগুলোকে সাধারণভাবে মানবীয় বা মনুষ্যসুলভ গুণাবলী বলে মানা হয়৷ আর এই গুনগুলো না থাকলে মানুষের সঙ্গে পশুর, জন্তু-জানোয়ারের কোন পার্থক্য না৷
এই বিচারশীল বিবেকী মানুষের সভ্যতাই আমাদের আলোচ্য৷ কিন্তু ‘সভ্যতা’ বিষয়টার ধারণা পেতে গেলে কিছু কথা মনে রাখা দরকার, লক্ষ্য করাও দরকার যে, মানুশ যূথবদ্ধ সমাজবদ্ধ জীব৷ মানুষের জীবনে চলমানতা রয়েছে৷ চলমানতা থাকলে জীবন যুদ্ধে টিকে থাকতে এসে যায় জীবনের নানান বহুমুখী অভিপ্রকাশ৷ (এই যে মনের ভিতরের ভাব বা চিন্তাভাবনা-কল্পনা কোন প্রত্যক্ষ-মূর্ত মাধ্যমে বাইরে আসা বা ইন্দ্রিয় হওয়া---একে এক কথায় বলে অভিব্যক্তি বা অভিপ্রকাশ৷) বলা বাহুল্য অভিপ্রকাশের ধরণ-ধারণ, বা বহিঃপ্রকাশ ঘটে, ও পারস্পিক মিথষ্ক্রিয়াও ঘটে৷ আর জগৎ ও জীবনের সঙ্গে মানিয়ে চলতে চলতে এসে যায় নানা আচার-আচরণ, চর্যাচর্য৷ --- এ সব কিছুই মানুষের সুকুমার মনের অভিব্যক্তি, অন্তরকে বাইরে আনার ভঙ্গিমা৷ অর্থাৎ সহজভাবে বলতে গেলে বলতে হয়---ব্যষ্টিজীবনে ও সমাজ জীবনে চলার পথে---জীবন সংগ্রামে মানুষ মানুষ ক্রিয়া প্রতিক্রিয়া হয়, ভাবের আদান প্রদান হয়, এতে ভিতরের ভাবের ভাব বাইরে আসে---অর্থাৎ ভিতরের ভাবনা চিন্তার বহিঃপ্রকাশ আছে৷ মানুষের এই বহুমুখী সার্বিক অভিব্যক্তির যেটা মধুরতর সূক্ষ্মতর ভাব---সেটাকে বলে সংস্কৃতি (দ্য সাম্টোটাল অব্ হিউম্যান এক্সপ্রেশন্স ইজ্ কলড্ কাল্চার্)৷ যেমন মানুষের খাদ্য গ্রহণ মানব সংস্কৃতির একটা দিক কিন্তু হাত-পা-মুখ-না ধুয়েই খাওয়াটা নয়, শুদ্ধাচার ও স্বাস্থ্যসম্মত বিধি অনুযায়ী সংস্কৃতির অঙ্গ৷ আবার এই সংস্কৃতিরও যে সূক্ষ্মভাব তাকেই বলে সভ্যতা৷ তবে মনে রাখা দরকার বিশ্বের সকল মানুষের সংস্কৃতি এক৷ কেননা স্বতন্ত্র স্পেসিস্ হিসেবে জগতের সব দেশের মানুষই খায়, পরে, বাস করে, শিক্ষা নেয়, রোগে ওষুধ খায়, গান গায়, ছবি আঁকে, সিনেমা দেখে্ শিল্পচর্র্চ সাহিত্য চর্চা করে৷ এ গুলো সবই মানুষ জাতের অভিপ্রকাশের ধরণ---যা পশুর মধ্যেই নেই৷ তাই মানুষ জাতের সংস্কৃতি একই৷ কিন্তু ভৌগোলিক পরিবেশ অঞ্চল ভেদে বিভিন্ন জায়গায় এর অভিব্যক্তির ধরণ-ধারণে কিছুটা স্থানিক পার্থক্য আছে৷ যার জন্যেই উদ্ভব হয়েছে বঙ্গসংস্কৃতি, ভারতীয় সংস্কৃতি, ইউরোপীয় সংস্কৃতি ইত্যাদি৷ একই কারণে পৃথিবী বুকে সিন্ধু সভ্যতা-গাঙ্গেয় সভ্যতা, মায়া সভ্যতা-মোচে সভ্যতা, মোনোমোটাসা সভ্যতা, হাটুসাস্-সভ্যতা, মিশরের সভ্যতা, মেসোপটেমিয়ার সভ্যতার মত বহু বিখ্যাত সভ্যতার উদ্ভব হয়েছিল৷
স্পেসিস হিসাবে বৃহত্তর মানবগোষ্ঠীর, জাতিসত্তা (এথনিক্ গ্রুপ) হিসাবে মানুষের ছোট ছোট গোষ্ঠী হিসাবে মানুষের, এমনকি পারিবারিক পরিচয়েও মানুষের বিভিন্ন অভিপ্রকাশের একটা সামগ্রিক রূপ আছে৷ নানা অভিব্যক্তি যখন নানা ক্রিয়ার মাধ্যমে সম্যকভাবে সম্পাদিত হয় বা হয়ে থাকে তখন তা হল ‘কৃতি’৷ এই ‘কৃতি’ই যখন সামূহিকভাবে প্রকাশ পায়, বিশিষ্ট হয়ে ওঠে তখন্ তারই যে অমার্জিত রূপ তা হচ্ছে ‘কৃষ্টি’---যা অভিপ্রকাশের জড়াভিমুখী-স্থূল রূপ ও এটা মন্দ দিক বা নেতিবাচক দিকও বটে৷ আর এরই বৃহৎ-সিম্বায়োটিক্-সূক্ষ্মরূপটা হল সংস্কৃতি, যা কৃতির সামূহিক ভালো দিক বা ইতিবাচক দিক৷ অর্থাৎ কৃষ্টির সূক্ষ্ম রূপটা হল সংস্কৃতি, কৃষ্টি হল সংস্কৃতির ভিত্তি৷ ব্যাপারটা দাঁড়াল---সংস্কৃতির ‘ভালো’ ও মন্দ---দুটো দিকই আছে৷ মোট কথা জীবনের অভিজ্ঞতার স্থূল ও সূক্ষ্ম অভিব্যক্তির সমষ্টিগত রূপই হচ্ছে সংস্কৃতি, ইংরেজীতে বলে কাল্চার্৷ এজন্য গোষ্ঠীতে কৃষ্টিগত পার্থক্য থাকতে পারে কিন্তু সংস্কৃতি সব সময়ই এক৷
সামূহিক অভিব্যক্তি মানুষের পারস্পরিক আচার আচরণের মধ্যে দিয়ে প্রকাশ পায়৷ এক কথায় বলে ‘শিষ্টাচারের দুটো রূপ বা ভাব আছে৷ একটা ভাব হচ্ছে স্থূল-অমার্জিত, অন্যটা সূক্ষ্মভাব৷ শিষ্টাচারের সূক্ষ্মভাবটাই হচ্ছে সভ্যতার কষ্টি পাথর৷ স্মরণীয় শিষ্টাচারের সূক্ষ্মভাব মানুষের ‘বিচার-ক্ষমতা’ বৃদ্ধি করে৷ আর এই ‘বিচার ক্ষমতা’ বলে প্রত্যেক জিনিসটার একটা মার্জিত রূপ দেবার নাম সভ্যতা৷ এ প্রসঙ্গে আর একটা কথা খেলায় রাখার---সংস্কৃতি তো জীবনের সকল অভিব্যক্তির সামূহিক রূপ৷ তাই অনিবার্যভাবে সংস্কৃতিটা বৌদ্ধিক স্তরের অভিব্যক্তি৷ কিন্তু সভ্যতায় বৌদ্ধিকতার সঙ্গে মানূব জীবনের ও সমাজের ভৌতিক দিকটার প্রগতিরও তো আছে৷ তাই কোন দেশ তার বৈষয়িক সমৃদ্ধির দ্বারাও সভ্য দেশ হিসেবে পরিগণিত হতে পারে৷ তবে বৌদ্ধিকতার ছায়া-সঙ্গ ছাড়া বৈষয়িক সমৃদ্ধি আসে না৷ বৌদ্ধিক বিকাশ না হলে সভ্যতার নাগালও পাওয়া যায় না, একজন মানুষের পক্ষে যথার্থ সভ্য হওয়াও সম্ভব নয়৷ কিন্তু মনে রাখা দরকার যে বৌদ্ধিক বিকাশ ও বৈষয়িক সমৃদ্ধি উভয় ক্ষেত্রেই সমস্ত কিছুর মধ্যে যে সূক্ষ্ম মার্জিত মানসিক বোধ ও হৃদয়বত্তার দিকটা থেকে যায়---তাই সভ্যতার মাপকাঠি৷ তবে এই ভাবনা থেকে একটা সত্য প্রকট হচ্ছে যে বিজ্ঞানের সহায়তা ভিন্ন বৈষয়িক সমৃদ্ধি হয় না, আবার বিজ্ঞান বা বুদ্ধিবৃত্তির উৎকর্ষতা সূক্ষ্ম মার্জিত মানবিক বোধ ও হৃদয়বত্তাকে ছেড়ে ধোপে টেকে না৷ তার মানে দাঁড়াল সভ্যতা-সংস্কৃতির সঙ্গে অভিব্যক্তির দুটি ভাব জড়িয়ে আছে---একটা মানসিক , অপর ভৌতিক৷ মানসিক দিকটার পুষ্টির ঘটায় সূক্ষ্ম মার্জিত মূল্যবোধ, হৃদয়বত্তা তথা বিচারশীলতা বা বিবেকবত্তা৷ বলা বাহুল্য, এই মার্জিত বোধের জননী হচ্চে অধ্যাত্মবাদ৷ তাই অধ্যাত্মবাদের পরশমণি যেখানে নেই সেখানে মানবিক বোধ ও হৃদয়বত্তার বিকাশও সম্ভব নয়৷ সভ্যতাও মাত্রা পায় না৷ পক্ষান্তরে ভৌতিক বিকাশ বা সমৃদ্ধির কারিগর হল বিজ্ঞান৷ বিজ্ঞান মানে বিশেষ জ্ঞান---যা বস্তুর যথাযোগ্য ব্যবহার শিখিয়ে দেয়৷ বিজ্ঞান বিনা সভ্যতার অগ্রগতি থমকে যায়৷ সে কারণে বিজ্ঞান ও সভ্যতা হাত ধরাধরি করে চলে৷ আমেরিকা-আফ্রিকার প্রাচীন সভ্যতাগুলো বিজ্ঞানে অগ্রগতি আনতে পারেনি বলে অকালে হারিয়ে গেছে৷ অন্যদিকে মিশরের সভ্যতা বিজ্ঞান বলে এগিয়ে গেলেও মানসিক ঐশ্বর্যে পিছিয়ে পড়ায় ধবংস হয়ে গেছে৷ ভারতে ঘটলো উল্টোটা৷ ভারতের ইতিহাসে স্বর্ণযুগ, গুপ্তযুগের পরে বিজ্ঞানের উন্নতির জন্যে নজর দেয়া হয়নি৷ ফলে ভারতীয় সভ্যতায় নেমে এলো ক্রমাবনতি ও অধঃপতন৷ আবার পাঠানযুগে সভ্যতা ও বিজ্ঞানের কোনটারই বিকাশ হয়নি, ফলে পাঠান যুগে সমাজের উন্নতিও স্তব্ধ ছিল৷ বিজ্ঞানকে সর্বাধিক মূল্য দেওয়া কিংবা অবহেলা করা দুই-ই সমান বিপজ্জনক৷ কাজেই দুয়ের সমান্তরাল বিকাশটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ৷ সভ্যতার সংস্থিতিতে মানব জীবনের বিভিন্ন অভিপ্রকাশের ক্ষেত্রে সংযম, যৌক্তিকতা ও বিচারশীলতা সংবেদ তাই আবশ্যিক৷ বলা বাহুল্য, সামূহিক অভিব্যক্তিতে সংযম-যৌক্তিকতা-বিবেকের স্পর্শ যত বেশী থাকবে সভ্যতার প্রকাশ তথা বিকাশ ও তত বেশী হবে৷ সংস্কৃতি ও সভ্যতার যুগলবন্দীত্ব ব্যষ্টি ও সমাজের অগ্রগতি ও প্রগতিতে একটা উল্লেখযোগ্য অঙ্গন৷ তাই সভ্যতা ও সংস্কৃতির নিবিড় রসায়নটা দেখা যাক--- সংস্কৃতি জীবনের সকল অভিব্যক্তির সমাহার-রূপ৷ পক্ষান্তরে -মানবসভত্যা হচ্ছে সংস্কৃতি মানসিক বা বৌদ্ধিক স্তরের অভিব্যক্তি৷ তবে সভ্যতা মূলতঃ জীবনের ভৌতিক দিকটার প্রকাশ৷ একজন মানসিক বিকাশের দিক থেকে সংস্কৃতি সম্পন্ন নাও হতে পারে, কিন্তু সে ভৌতিক উন্নতির ব্যাপারে সভ্য হতে পারে৷ সংস্কৃতির মধ্য দিয়ে মানুষের বৌদ্ধিক বিকাশ হয়, মানুষ বিচারশীল হয়৷ পক্ষান্তরে, মানুষের বৌদ্ধিক বিকাশ না হলে সভ্য হওয়া যায় না৷ (ক্রমশঃ)
- Log in to post comments