মানব সভ্যতার ত্রিবেণী সঙ্গম

লেখক
একর্ষি

পূর্ব প্রকাশিতের পর,

স্পেসিস হিসাবে বৃহত্তর মানবগোষ্ঠীর, জাতিসত্তা (এথনিক গ্রুপ) হিসাবে মানুষের, ছোট ছোট গোষ্ঠী হিসাবে মানুষের, এমনকি পারিবারিক পরিচয়েও মানুষের বিভিন্ন অভিপ্রকাশের একটা সামগ্রিক রূপ আছে৷ নানা অভিব্যক্তি যখন নানা ক্রিয়ার মাধ্যমে সম্যকভাবে সম্পাদিত হয় বা হয়ে থাকে তখন তা হল ‘কৃতি’৷ এই ‘কৃতি’৷ এই ‘কৃতি’ই যখন সামূহিকভাবে  প্রকাশ পায়, বিশিষ্ট হয়ে ওঠে তখন্‌ তারই যে অমার্জিত রূপ তা হচ্ছে ‘কৃষ্টি’---যা অভিপ্রকাশের জড়াভিমুখি স্থূল রূপ ও এটা মন্দ দিক বত্রা নেতিবাচক দিকও বটে৷ আর এরই বৃহৎ-সিমবায়োটিক্‌ -সূক্ষ্ম রূপটা হল সংস্কৃতি, যা কৃতির সামূহিক ভালো দিক বা ইতিবাচক দিক৷ অর্থাৎ কৃষ্টির সূক্ষ্ম রূপটা হল সংস্কৃতি, কৃষ্টি হল সংস্কৃতির ভিত্তি৷ ব্যাপারটা দাঁড়াল---সংস্কৃতির ‘ভালো’ ও মন্দ--- দুটো দিকই আছে৷ মোট কথা জীবনের অভিজ্ঞতার স্থূল ও সূক্ষ্ম অভিব্যক্তির সমষ্টিগত রূপই হচ্ছে সংস্কৃতি, ইংরেজীতে বলে কাল্‌চার্‌৷ এজন্য গোষ্ঠীতে গোষ্ঠীতে কৃষ্টিগত পার্থক্য থাকতে পারে কিন্তু সংস্কৃতি সব সময়ই এক৷

সামূহিক অভিব্যক্তি মানুষের পারস্পারিক আচার আচরণের মধ্যে দিয়ে প্রকাশ পায়৷ একে এককথায় বলে ‘শিষ্টাচার’ এই শিষ্টাচারের দুটো রূপ বা ভাব আছে৷ একটা ভাব হচ্ছে স্থূল-অমার্জিত, অন্যটা সূক্ষ্মভাব৷ শিষ্টাচারের সূক্ষ্মভাবটাই হচ্ছে সভ্যতার কষ্টি পাথর৷ স্মরণীয়, শিষ্টাচারের সূক্ষ্মভাব মানুষের ‘বিচার-ক্ষমতা’ বৃদ্ধি করে৷ আর এই বিচার-ক্ষমতা বলে প্রত্যেক জিনিসটার একটা মার্জিত রূপ দেবার নাম সভ্যতা৷ এ প্রসঙ্গে আর একটা কথা খেয়াল রাখার--- সংস্কৃতি তো জীবনের সকল অভিব্যক্তির সামূহিক রূপ৷ তাই অনিবার্যভাবে সংস্কৃতিটা বৌদ্ধিক স্তরের অভিব্যক্তি৷ কিন্তু সভ্যতায় বৌদ্ধিকতার সঙ্গে মানব জীবনের ও সমাজের ভৌতিক দিকটার  প্রগতিও তো আছে৷ তাই কোন দেশ তার বৈষয়িক সমৃদ্ধির দ্বারাও সভ্য দেশ হিসাবে পরিগণিত হতে পারে৷ তবে বৌদ্ধিকতার  ছায়া-সঙ্গ ছাড়া বৈষয়িক সমৃদ্ধি আসে না৷ বৌদ্ধিক বিকাশ না হলে সভ্যতার  নাগালও পাওয়া যায় না, একজন মানুষের পক্ষে যথার্থ সভ্য হওয়াও সম্ভব নয়৷ কিন্তু মনে রাখা দরকার  যে বৌদ্ধিক বিকাশ ও বৈষয়িক সমৃদ্ধি উভয়ক্ষেত্রেই সমস্ত মধ্যে যে সূক্ষ্ম মার্জিত মানসিক বোধ হৃদয়বত্তার দিকটা থেকে যায়---তাই সভ্যতার মাপকাঠি৷ তবে এই ভাবনা থেকে একটা সত্য প্রকট হচ্ছে যে বিজ্ঞানের সহায়তা ভিন্ন বৈষয়িক সমৃদ্ধি হয় না৷ আবার বিজ্ঞান বা  বুদ্ধিবৃদ্ধির উৎকর্ষতা সূক্ষ্ম মার্জিত মানবিক বোধ ও হৃদয়বত্তাকে ছেড়ে ধোপে টেকে না৷  তার মানে দাঁড়াল সভ্যতা-সংস্কৃতির সঙ্গে অভিব্যক্তির দুটি ভাব জড়িয়ে আছে---একটা মানসিক, অপরটা ভৌতিক৷ মানসিক দিকটার পুষ্টি ঘটায় সূক্ষ্ম মার্জিত মূল্যবোধ, হৃদয়বত্তা তথা বিচারশীলতা বা বিবেকবত্তা৷ বলা বাহুল্য, এই মার্জিত বোধের জননী হচ্ছে অধ্যাত্মবাদ৷ তাই অধ্যাত্মবাদের পরশমণি যেখানে নেই সেখানে মানবিক বোধ ও হৃদয়বত্তার বিকাশও সম্ভব নয়৷ সভ্যতাও মাত্রা পায় না৷ পক্ষান্তরে ভৌতিক বিকাশ  বা সমৃদ্ধির  কারিগর হল বিজ্ঞান৷ বিজ্ঞান মানে বিশেষ জ্ঞান--- যা বস্তুর যথাযোগ্য ব্যবহার শিখিয়ে দেয়৷ বিজ্ঞান বিনা সভ্যতার অগ্রগতি থমকে যায়৷ সে কারণে বিজ্ঞান ও সভ্যতা হাত ধরাধরি করে চলে৷ আমেরিকা-আফ্রিকার প্রাচীন সভ্যতা গুলো বিজ্ঞানে অগ্রগতি আনতে পারেনি বলে অকালে হারিয়ে গেছে৷ অন্যদিকে মিশরের সভ্যতা বিজ্ঞান বলে এগিয়ে গেলেও মানসিক ঐশ্বর্যে পিছিয়ে পড়ায় ধবংস হয়ে গেছে৷ ভারতে ঘটলো উল্টোটা৷ ভারতের ইতিহাসে স্বর্ণযুগ, গুপ্তযুগের পরে বিজ্ঞানের উন্নতির জন্যে নজর দেয়া হয়নি৷ ফলে ভারতীয় সভ্যতায় নেমে এলো ক্রমাবনতি ও অধঃপতন৷ আবার পাঠানযুগে সভ্যতা ও বিজ্ঞানের কোনটারই বিকাশ হয়নি৷ ফলে পাঠান যুগে সমাজের উন্নতিও স্তব্ধ ছিল৷ বিজ্ঞানকে সর্বাধিক মূল্য দেওয়া কিংবা অবহেলা করা দুই-ই সমান বিপজ্জনক৷ কাজেই দুয়ের সমান্তরাল বিকাশটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ৷ সভ্যতার সংস্থিতিতে মানব জীবনের বিভিন্ন অভিপ্রকাশের ক্ষেত্রে সংযম, যৌক্তিকতা ও  বিচারশীলতার সংবেদ তাই আবশ্যিক৷ বলা বাহুল্য, সামুহিক অভিব্যক্তিতে সংযম যৌক্তিকতা-বিবেকের স্পর্শ যত বেশী থাকবে সভ্যতার প্রকাশ তথা বিকাশ ও তত বেশী হবে৷ সংস্কৃতি ও সভ্যতার যুগলবন্দীত্ব ব্যষ্টি ও সমাজের অগ্রগতি ও প্রগতিতে একটা উল্লেখযোগ্য অঙ্গন৷ তাই সভ্যতা ও সংস্কৃতির নিবিড় রসায়নটা দেখা যাক---‘‘ সংস্কৃতি জীবনের সকল অভিব্যক্তির সমাহার রূপ৷ পক্ষান্তরে-মানবসভ্যতা হচ্ছে সংস্কৃতি জাত শিষ্টাচারের সূক্ষ্মবোধ৷ সংস্কৃতি মানসিক বা বৌদ্ধিক স্তরের অভিব্যক্তি৷ তবে সভ্যতা মূলতঃ জীবনের ভৌতিক দিকটার প্রকাশ৷ একজন মানসিক বিকাশের দিক থেকে সংস্কৃতি সম্পন্ন নাও হতে পারে,---কিন্তু সে ভৌতিক উন্নতির ব্যাপারে সভ্য হতে পারে৷ সংস্কৃতির মধ্য দিয়ে মানুষের বৌদ্ধিক বিকাশ হয়, মানুষ বিচারশীল হয়৷ পক্ষান্তরে, মানুষের বৌদ্ধিক বিকাশ না হলে সভ্য হওয়া যায় না৷  সভ্যতার একটা বড় দিক হচ্ছে টিকে  থাকা বা অস্তিত্ব রক্ষা করা৷ পৃথিবীতে অনেক সভ্যতা এসেছে আবার হারিয়েও গেছে৷ অস্তিত্ব রক্ষা করতে পারেনি৷ আবার বেশ কিছু সভ্যতা নোতুন রূপে ফিরে এসেছে, হারিয়ে যায়নি---যেমন চৈনিক সভ্যতা, গাঙ্গেয় সভ্যতা ইত্যাদি৷ আসলে সভ্যতা ব্যষ্টি বা সমাজ সবাইকে নিজের অস্তিত্ব বজায়  রাখার জন্যে তিনটি তত্ত্বের ওপর নির্ভর করতে হয়৷  তা হচ্ছে--- অস্তি, ভাতি ও আনন্দম্‌৷ এই তিনের যে কোন একটা না থাকলেই ধবংস ডেকে আনতে পারে৷ যেমন খাদ্য,বস্ত্র,বাসস্থান, শিক্ষা ও চিকিৎসা---এগুলো নিয়মিত পাওয়ার গ্যারান্টি ছাড়া বাঁচা যায় না, অস্তিত্ব থাকে না---তা ব্যষ্টি, সমাজ বা সভ্যতা যে ক্ষেত্রেই ধরা হোক না কেন৷ এগুলো নিত্যকাল-চিরকাল অত্যাবশ্যক৷ এটাই হ’ল অস্তি৷ কিন্তু খাওয়া, পরা, বাস করা দি সত্যিকারের অস্তিত্বের পোষক হয়ে উঠতে পারে না--- যদি না তা দিয়ে ব্যষ্টি সমাজ-সভ্যতা পুষ্ট হয় উন্নতি ও প্রগতির ভিতর দিয়ে---যেমন একটা কুঁড়ি ফুলে বিকশিত হয়ে ওঠে৷ একেই বলে ভাতি বা উন্নতিও বলা যায়৷ তবে ভাতি কখনো লক্ষ্যহীন হয় না৷ ভাতির লক্ষ্য অনন্ত সুখ পাওয়া৷ মানুষ এমন কিছুই করে না যার পিছনে কোন সুখের অনুভূতি নেই তবে মানুষ চায় সীমাহীন সুখ৷ এত কথায় যে কথাটা বলার তা হ’ল---সভ্যতাকে টিকে থাকতে হলে ক্রমোন্নতি ঘটাতে হবে৷ যেমন অনেকটা এই রকমই ---এখনকার যুগমানস ‘আপডেট’্‌ (স্থান-কাল-পাত্র তথা যুগের পরিবর্তনের সঙ্গে পরিবর্তিত পরিস্থিতির সঙ্গে সঙ্গতি বিধান করে চলা৷)  কথাটা ব্যবহার করে৷ সব সময় আপডেট চাই৷ যার আপডেট নেই অচল পয়সা মত, অবলুপ্ত সত্তার মত তা হারিয়ে যাবে৷ বলাবাহুল্য, সভ্যতার ক্রমোন্নতি বা প্রগতির জন্যে কতগুলো তত্ত্বের প্রয়োজন৷ উল্লেখযোগ্য তত্ত্বগুলি হলঃ-

১. অধ্যাত্ম আদর্শ---এটা লক্ষ্য স্থির করে দেয়৷  উদ্দেশ্য পূরণে সামনে আসে অধ্যাত্ম আদর্শ৷

২. অধ্যাত্ম সাধনা--- মানুষের একটা দৈহিক সংরচনা আছে---যা আসলে একটা জৈববৈজ্ঞানিক যন্ত্র বিশেষ৷ এই জৈববৈজ্ঞানিক যন্ত্রে প্রয়োজন হয় অধিক থেকে অধিক ‘চিত্তধাতু’  তৈরী করা  ও এগুলোকে চৈতন্য (কনসাসনেস) রূপান্তরিত করা৷ এর জন্যে দরকার বিশেষ পদ্ধতির৷ অধ্যাত্ম সাধনা হ’ল সেই পদ্ধতি৷ সমাজ থেকে এই দুটো (অধ্যাত্ম আদর্শ ও অধ্যাত্ম সাধনা) ছেড়ে গেলে বিজ্ঞান বিভাগে উন্নতি আসলে সভ্যতাকে গ্রাস করে৷

সভ্যতার কথা বলতে গেলে মানুষের ভৌতিক মানসিক-আত্মিক স্তরের অবস্থার কিছু কথা অনিবার্যভাবে এসে যায়৷ আর সেই অবস্থাটা সামনে আসে, সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করে, সবাই বুঝতে পারে  কিছু মাধ্যম ধরে তা প্রকাশ্যে আসলে পরে৷ এই যে মনের ভিতরের ভাব বা চিন্তা-ভাবনা কল্পনা কোন প্রত্যক্ষ-মূর্ত মাধ্যমে বাইরে আসা বা ইন্দ্রিয় গ্রাহ্য হওয়া---একে এক কথায় বলে অভিব্যক্তি বা অভিপ্রকাশ৷ প্রকৃতপক্ষে , অভিপ্রকাশের ধরণ-ধারণ, চলমানতা-গতিহীনতা, স্থূলের বা সূক্ষমের দিকে অভিমুখে বা গতির লক্ষ্য ইত্যাদি ধরেই সভ্যতার উদ্ভব, কালিক পরিচয় জানা যায়, জাত-গোত্র, ঠিকুজি-চরিত্র চেনা যায়৷ আর এসব থেকেই কতগুলো সূত্র পাওয়া যায়৷

(অ) মানবজীবনের অভিব্যক্তি নানান দিকে ঘটে থাকে৷ জীবনে অভিযোজনের পথও তাই বহুমুখী কর্মধারায় বিন্যস্ত৷ কিন্তু লক্ষ্য সেই এক-অনন্ত সুখ পাওয়া৷

(আ) বহুমুখী কার্যধারার মধ্যে সংস্কৃতিই সমাজের প্রতিচ্ছবি বহন করে (এক কথায় মানবজীবনের বহুমুখী অভিব্যক্তির-স্থূল ও সূক্ষ্ম-সমাহারকেই বলা হয় সংস্কৃতি)৷

(ই) বৌদ্ধিক উন্নতির মাধ্যমে জীবনের অভিপ্রকাশ বাড়ানো যেতে পারে৷ কারণ এটাই সত্য যে, সভ্যতার বিবর্ধন হয় চিন্তাধারা, আদর্শ ও ব্যক্তিত্বের অবিরাম সংঘাতে৷ সযত্ন প্রয়াসে এগুলোকে সমাজে আরোপ করা হয়৷

(ঈ) তথাকথিত অনুন্নত গোষ্ঠীভুক্ত মানুষের মধ্যে শিল্প, সাহিত্য সঙ্গীতের অর্থাৎ নন্দন বিজ্ঞান- মোহন বিজ্ঞানের কোন স্থান নেই৷ তাই স্বভাবতই তাদের ক্ষেত্রে জীবনের অভিব্যক্তি তুলনামূলক বিচারে কম৷

(উ) যেখানে অভিব্যক্তির ধারাগুলোর সংখ্যা বেশী, বলা যায় যে জাগতিক দিক থেকে সেখানেই সাংস্কৃতিক উন্নতি অপেক্ষাকৃত বেশী, সভ্যতার ধারাটাও উচ্চাঙ্গ-মুখী৷ একইভাবে কোন ব্যষ্টির মধ্যে জীবনের এই অভিব্যক্তির বৈচিত্র্য যত বেশী, বলা যায়, সেই তত বেশী  সংস্কৃতি সম্পন্ন, সভ্য হওয়ার সারিতে এগিয়ে৷ (ক্রমশঃ)    (তথ্যসূত্র ঃ নমঃ শিবায় শান্তায---শ্রীশ্রীআনন্দমূর্ত্তিজী )