‘গন্ধর্ব’ শব্দটি যদি পুংলিঙ্গে ব্যবহূত হয় (গন্ধর্বঃ) তার মানে হয় গন্ধর্ব অর্থাৎ নৃত্যে গীতে বাদ্যে দক্ষ এক প্রকারের দেবযোনি যা’ তেজ, মরুৎ আর ব্যোম এই তিনটি তত্ত্বে তৈরী অর্থাৎ যাতে ক্ষিতি ও অপ্ তত্ত্ব নেই, আর ক্ষিতি ও অপ্ তত্ত্ব না থাকায় সাধারণভাবে তা’ পরিদৃশ্য নয়৷ গন্ধর্ব–প্রেষিত ধ্বনি, রাগাত্মিকা অভিব্যক্তি শ্রুতিগ্রাহ্য, অনুভব্য কিন্তু স্বাভাবিক অবস্থায় দৃশ্য নয়৷ মনকে নিজের ক্ষিতি, অপ্ তত্ত্ব থেকে বিচ্যুত করে সম্পূর্ণতঃ ঔর্ধ্বদৈহিক ভাবে নিষিক্ত করতে পারলে তবেই তা’ মানসলোকে দৃশ্য৷
গন্ধর্ব একটি দেবযোনি যা’ কতকটা অপ্সরা পর্যায়ভুক্ত৷
‘‘যথাহদর্শে তথাহত্মনি যথা স্বপ্ণে তথা পিতৃলোকে৷
যথাহপ্সু পরীবদদৃশে তথা গন্ধর্বলোকে ছায়াতপয়োরিব ব্রহ্মলোকে’’৷৷
আজকাল যাকে মাইক্রোবাইটাম বলা হচ্ছে গন্ধর্ব সেই রকম এক ধরণের পজিটিব মাইক্রোবাইটাম যা’ জীবের শরীরকে মনকে স্নিগ্ধ করে ঊর্ধ্বতর তথা উন্নততর ভাবে অভিষিক্ত করে ক্ষুদ্রত্বের নিগড় ভেঙ্গে–চুরে খানখান করে দেয়৷ সপ্ত দেবযোনি সাতটি বিভিন্ন ধরণের পজিটিব মাইক্রোবাইটাম যার সঙ্গে আমাদের অহরহঃ কারবার চলছে কিন্তু যাদের কাছে পেয়েও কাছে পাচ্ছি না অথচ অনুভব করছি সে বা তাঁরা আশেপাশে ইতস্ততঃ উঁকিঝুঁকি মারছে৷
হ্যাঁ, পুংলিঙ্গে ব্যবহূত হলে ‘গান্ধর্ব’ শব্দের অর্থ হ’ল তথাকথিত অশরীরী সঙ্গীত জগতের বাসিন্দা....... এক ধরণের মাইক্রোবাইটাম যার গতায়াত স্থূল ও সূক্ষ্ম জগতে রয়েছে, কারণ–জগৎকে সে ছুঁই–ছুঁই করছে৷
‘নগর বাহিরি রে ডোম্বী তোহরি কুড়িয়া
ছোই ছোই জাওসি ব্রাহ্মণ নড়িয়া৷’
‘গান্ধর্ব’ শব্দটি যদি ক্লীবলিঙ্গে হয় (অর্থাৎ যদি গান্ধর্বং/গান্ধর্বে/গান্ধর্বাণি বলা হয়) তার মানে গন্ধর্ব সংক্রান্ত সব কিছু৷ তাদের আচার–ব্যবহার, ভাব–ভাষা, আঙ্গিক, অভিব্যক্তি–মুদ্রা–বাচ, বিবাহ, সামাজিক অবস্থা, বস্ত্র–পরিধানরীতি, উড্ডয়নরীতি– সব কিছুর সমাহার নিয়েই এই ক্লীবলিঙ্গাত্মক ‘গান্ধর্বং’ শব্দ ব্যবহূত হয়৷
গান্ধর্ব বিবাহ একটি হিন্দুশাস্ত্রসম্মত বিবাহ৷ মনু এই বিবাহকে স্বীকৃতি দিয়েছেন, ভারতের ন্যয়াধিকারও এই বিবাহকে স্বীকৃতি দিয়েছে৷ গান্ধর্ব বিবাহে বর–বধূর সম্মতি থাকলেই হ’ল৷ কেবল মালা বিনিময়েই বিবাহ নিষ্পন্ন হয়৷ সাত পাক, সিঁদুর, সামাজিকতা, কন্যাদান, অগ্ণিসাক্ষী কোন কিছুই এতে নেই৷ কেবল একটি স্থায়ী সত্তার সামনে এই মালা বিনিময় অনুষ্ঠিত হয়৷ এই স্থায়ী সত্তা বলতে প্রাচীনকাল থেকে সূর্য, চন্দ্র, তাঁবাঁ, তুলসী, মহাভারত ও গঙ্গোদককে বুঝিয়ে আসছে৷ মূল মহাভারত যে রামায়ণের চেয়ে প্রাচীনতর এ থেকে তারও খানিকটা ঝিলিক মেলে৷ ভারতে বসবাসকারী আর্য বা আর্যেতর প্রাচীন দ্রাবিড়েরা বা ক্ষাঙলার আদি অষ্ট্রিকেরা কেউই এ ব্যাপারে রামায়ণকে স্বীকৃতি দেননি৷ বরং পরবর্ত্তীকালে কেউ কেউ গীতা বা শ্রীশ্রীচণ্ডীকে (দুর্গাসপ্তসতী) সাক্ষীরূপে মেনে নিয়েছিলেন৷ যাই হোক, গান্ধর্ব বিবাহ কী তা’ বুঝে গেলে৷
আনন্দমার্গ–বিবাহ তাই হিন্দুশাস্ত্রসম্মত গান্ধর্ব বিবাহ যাতে সাক্ষী থাকেন উভয় পক্ষের মাননীয় প্রতিভূরা৷ তাঁরাও মন্ত্র পাঠ করে নিজেদের সাক্ষিত্বকে স্পুষ্টীকৃত করে থাকেন৷
প্রাচীন ভারতে ও মধ্যযুগীয় ভারতে গন্ধর্বদের নিয়ে অনেক গল্প রচিত হয়েছিল৷ মানবে গন্ধর্বে বিবাহাদির গল্প কিছু কিছু রয়েছে৷ মানবে গন্ধর্বে মিলিত ভাবে পূজানুষ্ঠান, নৃত্যানুষ্ঠান, গীতানুষ্ঠানেরও উল্লেখ রয়েছে৷ কাশীর রাজা নামে পরিচিত চিত্রসেন ছিলেন গন্ধর্ব৷ তাঁর স্ত্রী মদালসা গন্ধর্বী ছিলেন কিনা তার জোরালো প্রমাণ নেই৷ মদালসার সন্তান বিক্রান্ত ও অলর্ক গন্ধর্ব ছিলেন না৷ প্রাচীন ও মধ্যযুগীয় ইতিহাসে দন্তকথায় চারণগাথায় মিলেমিশে এক হয়ে গেছে৷ যাঁর কথা ক্ষললুম এই সেই মদালসার পুত্রের নাম ছিল অলর্ক (ক্ষ্যাপা কুকুর)৷ চিত্রসেনের সঙ্গে মত বিরোধ হওয়ায় যিনি দেহত্যাগ করেন ও যাবার সময় চিত্রসেনের হাতে অঙ্গুরী–গ্রথিত বাণীতে লিখে গেছলেন, ‘‘জগতে কোন কিছুই কামনা করিবে না৷ যদি কোন কামনা করিতেই হয় তবে মুক্তি কামনা করিও৷ জগতে কোন কিছুর প্রতি আসক্তি রাখিবে না৷ যদি কোন আসক্তি রাখিতেই হয় তবে পরানুরক্তি রাখিও’’৷ এই সেই মদালসা যিনি নিজপুত্র শিশু অলর্ককে ঘুম পাড়াতে গিয়ে যে ঘুমপাড়ানী গান গেয়েছিলেন সে গান বৈরাগ্যের গান, সে গান বন্ধন ছেঁড়ার গান–
‘‘শুদ্ধোইসি বুদ্ধোইসি নিরঞ্জনোহসি
সংসারমায়া পরিবর্জিতোহসি৷
সংসারস্বপ্ণং ত্যজ মোহনিদ্রাং
মদালসোল্লাপমুবাচ পুত্রম্’’৷৷
এই সেই অলর্ক যিনি এককালে মহর্ষি অষ্টাবক্রের কাছে রাজাধিরাজযোগে শিক্ষা নিয়েছিলেন৷
(‘‘গান্ধর্ব, শব্দ চয়নিকা, ২২শ পর্ব)