মহাসম্ভূতি শ্রীশ্রীআনন্দমূর্ত্তিজী ১৯৯০ সালের ২১শে অক্টোবর বিকেল প্রায় তিন ঘটিকায় তাঁর কলকাতার ভি.আই.পি. নগরস্থিত বাসভবন ‘মধুকোরক’-এ সমস্ত ভক্ত অনুগামীদের চোখের জলে ভাসিয়ে তাঁর পাঞ্চভৌতিক শরীর ত্যাগ করেন৷ এই আকস্মিক সংবাদ শুনে সারা বিশ্বের তাঁর লক্ষ লক্ষ অনুগামী শোকাচ্ছন্ন হয়ে পড়েন৷ এই অবস্থায় সবাই যাতে তাঁদের পরমারাধ্য গুরুকে শেষ বারের মত দর্শন করতে পারেন এই কারণে তাঁর পাঞ্চভৌতিক দেহকে বিশেষভাবে রক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়৷ ছয় দিন পর ২৬শে অক্টোবর বিকেল তিনটের সময় কলকাতাস্থিত আনন্দমার্গ আশ্রম কম্পাউণ্ডের মধ্যেই সারা বিশ্বের লক্ষ লক্ষ অনুগামীদের সামনে তাঁর শেষকৃত্য সম্পন্ন করা হয়৷
এই ছয়দিন সমাগত সমস্ত আনন্দমার্গীরা সর্বক্ষণ ‘বাবানাম কেবলম্’ কীর্ত্তনের মাধ্যমে আত্মসমর্পণের ভাব নিয়ে তারকব্রহ্ম শ্রীশ্রীআনন্দমূর্ত্তিজী হৃদয়ে অনুভব করতে থাকেন৷
এর পরের বৎসর থেকে ভক্তরা স্বতস্ফূর্তভাবেই কলকাতায় তাঁর স্মারক ভবনে ২১শে অক্টোবর থেকে ২৬শে অক্টোবর সমবেত হয়ে অখণ্ড ‘বাবানাম কেবলম্’ কীর্ত্তনের মাধ্যমে তাঁর প্রতি আত্মসমর্পণ জ্ঞাপন করেন ও প্রত্যেকে নিজ নিজ হৃদয়ে মার্গগুরুদেবের উপস্থিতি অনুভব করেন৷ সঙ্গে সঙ্গে তাঁর আদর্শকে জীবনে ও সমাজে রূপায়িত করার জন্যে শপথ গ্রহণ করেন৷
প্রতি বছর এই ভাবে মার্গগুরুদেবের পাঞ্চভৌতিক দেহের মহাপ্রয়াণ অনুষ্ঠান পালন ভক্ত হৃদয়ের থেকে উৎসারিত স্বতঃস্ফূর্ত সিদ্ধান্ত৷
অনেক অতি তাত্ত্বিক এই মহাপ্রয়াণ অনুষ্ঠানের যথার্থতা নিয়ে প্রশ্ণ তোলেন ও কিছু কিছু আনন্দমার্গীকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করেন৷ তাঁদের প্রধান প্রশ্ণ তারকব্রহ্ম তো অনন্ত কাল ধরে আছেন, ছিলেন ও থাকবেন৷ তাঁর তো মহাপ্রয়াণের প্রশ্ণ ওঠে না৷ তাই তাঁর মহাপ্রয়াণ অনুষ্ঠান কেন? তাঁদের প্রশ্ণের উত্তরে শ্রীশ্রীআনন্দমূর্ত্তিজী একটি প্রবচনের অংশ তুলে ধরছি৷
‘তারকব্রহ্ম এক নির্দিষ্ট দিনে জন্ম নেন আর তেমনই নির্দিষ্ট দিনে পৃথিবী থেকে বিদায় নেন৷ তিনি পাঞ্চভৌতিক আধারের আশ্রয় নেন৷ আবার সেই পার্থিব দেহের মহাপ্রয়াণও হয়৷ (সুইজারল্যাণ্ডে ফিয়েসে ১৩মে ১৯৭৯, সন্ধ্যায় প্রদত্ত প্রবচনের অংশ)৷
পরমপুরুষ তারকব্রহ্ম রূপে ধরাধামে অবতীর্ণ হয়েছিলেন ১৯২১ সালের বৈশাখী পূর্ণিমা তিথিতে৷ মহাপ্রয়াণ ১৯৯০ সালের ২১শে অক্টোবর৷ প্রকৃতপক্ষে শ্রীশ্রীআন্দমূর্ত্তিজীর মহাপ্রয়াণ যদি অবাস্তব হয় তাহলে জন্মদিবসই বা বাস্তব হয় কীভাবে? প্রকৃতপক্ষে তিনি যখন পাঞ্চভৌতিক শরীর ধারণ করেন, এই অবস্থায় তাঁর জন্মদিনও যেমন বাস্তব, মহাপ্রয়াণ দিবসও তেমনই বাস্তব৷
আমরা তাঁর ভক্তরা ‘মহাপ্রয়াণ অনুষ্ঠান’ উপলক্ষ্যে ছয় দিন ধরে ভক্তিভরে ‘বাবানাম কেবলম্’ কীর্ত্তন করি৷ কীর্ত্তনের মধ্য দিয়ে অনুভব করি, (যদিও পাঞ্চভৌতিক শরীরে তিনি নেই) তিনি আমাদের হৃদয়ে সদা বিরাজ করছেন৷ আমরা কখনো একেলা নই৷ তিনি সবসময় আমাদের সঙ্গে আছেন, অন্তরে যেন আমরা তাঁর আনন্দস্বরূপ উপলব্ধি করতে করতে তাঁর দিকে এগিয়ে যাই, সঙ্গে সঙ্গে আদর্শ মানব সমাজ রচনায় তাঁর সুমহান আদর্শকে বাস্তবায়িত করার জন্যে সংকল্প গ্রহণ করি---আমরা একলা নই, তিনি সবসময় আমাদের সঙ্গে আছেন৷ তাই আমরা সফল হবই৷ এইভাবে তাঁর চরণে আমরা আমাদের সমর্পণ করি৷ তাঁর আদর্শের সঙ্গে আমরা আমাদের এক করে দিই৷ এতে সমালোচকদের আপত্তি থাকলে বুঝতে হবে তারা হয় ইষ্ট আদর্শকে বুঝতে ভুল করেছেন নতুবা ইচ্ছাকৃতভাবে মার্গী ভাইবোনদের বিপথে চালিত করছেন৷ তা না হলে সমালোচকদের আপত্তির কোনমাত্র সঙ্গত কারণ থাকতে পারে না৷ তাই আর কোনো দ্বিধাদ্বন্দ্ব নয়৷ শুষ্ক জ্ঞানের অহঙ্কার ত্যাগ করে সবাই ভক্তি আপ্লুত পবিত্র হৃদয়ে স্মরণ করি তাঁর বাণী---
‘‘আমরা জানি যে পরমপুরুষ বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের পরম নিয়ন্তা হিসেবে, পুরুষোত্তম হিসেবে নৈর্ব্যষ্টিক সত্তা৷ কিন্তু যখন তিনি দেশ-কাল-পাত্রের আপেক্ষিকতার মধ্যে এসে গেলেন তখন তিনি আর নৈর্ব্যাষ্টিক সত্তা থাকলেন না৷ তখন তিনি হয়ে গেলেন বৈযষ্টিক সত্তা---অত্যন্ত কাছের, অত্যন্ত নিকট সম্পর্কযুক্ত৷ আর তিনি হলেন আমাদের তারকব্রহ্ম৷.......
তাই সমাজ যখন শোষণ ও অবসাদের কবলে পড়ে, যখন সমাজে ভেদ-বিভেদ ও তামসিকতা প্রবল হয়ে ওঠে তখন পরমপুরুষ মানুষের আকুলতা, তাদের ক্রন্দন, তাদের প্রাণঢালা আহ্বানে সাড়া না দিয়ে থাকতে পারেন না৷ একমাত্র সেই অবস্থাতেই তিনি তারকব্রহ্ম রূপে আসেন৷ তারক মানে যিনি ত্রাণ করেন আর সেই তারকব্রহ্মই হলেন এই সৃষ্ট জগতের বাবা৷ তার জন্যেই ভক্তেরা ‘বাবানাম কেবলম্’ কীর্ত্তন করেন (ফিয়েস সুইজারল্যাণ্ড, ---১৩ই মে ১৯৭৯, সন্ধ্যা)
(এই নিবন্ধে শ্রীশ্রীআনন্দমূর্ত্তিজী দুটি উদ্ধৃতিই, ‘তারকব্রহ্মের আগমন’ (প্রবচন - ২২৫) থেকে নেওয়া হয়েছে৷৷ আনন্দবচনামৃতম দ্বাদশ খণ্ড দ্রষ্টব্য)৷
- Log in to post comments