ঠাকুরের অর্থাৎ শ্বশুরের কন্যা এই অর্থে ঠক্করদুহিতাঞ্ছঠক্ক্ ঞ্ছঠাকুরঝি৷ ননদকে বাংলায় ‘ঠাকুরঝি’ বলে সম্বোধন করা হত ও আজও করা হয়ে থাকে৷
ননদের স্বামী নন্দাইকে (ননন্দাপতিঞ্ছননন্দ্) সম্ৰোধন করা হত ‘ঠাকুর জামাই’ বলে৷ ঠাকুর জামাই মানে ঠাকুরের জামাই অর্থাৎ শ্বশুরের জামাই৷ রাঢ়ের কোনো কোনো অংশের পুরুষেরা পত্নীর ভগিনীকেও ‘ঠাকুরঝি’ বলে সম্বোধন করে৷ ভাষাবৈজ্ঞানিক মতে এ ব্যবহার শুদ্ধ৷
‘ননন্দা’ মানে যে আনন্দিতা নয়৷ ভ্রাতৃজায়া ঘরে আসার সময় সব ননদের না হলেও কোনো কোনো ননদের মনে একটা বিক্ষোভ জন্মায়৷ সে ভাবে, অন্য বাড়ির মেয়ে এসে আমার বাপের বাড়িতে সর্বময়ী কর্ত্রী, একেবারে রাজরাণী হয়ে বসল আর আমি কি না পরের বাড়িতে গিয়ে দু’বেলা হেঁসেল ঠেলছি!
সেকালে ননদ ও ভাজ দু’য়েরই শিক্ষার স্তর খুব উন্নত ছিল না৷ তাই ছোটখাট ব্যাপারে একে অন্যকে ঠেস দিয়ে কথা শোনাত, একে অন্যকে সহ্য করতে পারত না৷ আজকাল কিন্তু চাকা ঘুরে গেছে৷ অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ননদ–ভাজ দুই–ই শিক্ষিত৷ তাই দু’য়ের মধ্যে আজকাল অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দারুণ ভাব৷ এ যেন একেবারে–
‘‘ভাবে গদগদ তেলাকুচো
কেঁদে মরে গেল কাল ছুঁচো৷’’
সেকালে কিন্তু সব ক্ষেত্রে না হোক, অনেক ক্ষেত্রেই ননদ–ভাজে দিব্যি রেষারেষি চলত৷ সেই যে গল্প আছে না ঃ
ননদ–ভাজে ঘাটে গেছে চান করতে৷ এমন সময়ে কুমীর এসে ননদকে ধরে নিয়ে গেল৷ ভাজ কিন্তু কথাটি চেপে রাখল৷ মনে মনে তার খুব আনন্দ, কারণ ননদ তাকে জ্বালা দিত৷
‘‘ননদিনী রায়বাঘিনী, ননদিনী কুলের কাঁটা,
উঠতে বসতে দেয় গো খোঁটা৷৷’’
সে বাড়িতে এসে কাউকে কিচ্ছুটি বললে না, একবারও মুখটি খুললে না, কেননা মুখ খুললেই তো বিপদ৷ খাওয়া–দাওয়া শিকেয় উঠবে.......রাঁধা ভাতের হাঁড়ি ফেলে দিতে হবে.......শুক্তো–ঘণ্ট–ডাঁটা–চ গোরু–ছাগলে খাবে৷ ভাজ তাই মুখে কুলুপ এঁটে রইল৷ তারপর পেট ভরে ৰেড়াল ডিঙ্গোতে পারে না এমন পরিমাণ ভাত খেয়ে, লাউডগা–পোস্তবাটা থেকে শুরু করে ঝালের ঝোল, অম্ৰল সব কিছু চেটেপুটে খেয়ে হাতে ভর দিয়ে উঠে দাঁড়াল৷ আর মনে মনে বললে, কী জ্বালা হয়েছে, এঁটো পাতা আবার আমাকেই তুলতে হবে!
‘‘ঢ়লাঢ়লা পুঁইয়ের পাতা মলুকচালের ভাত ৷
খেয়ে দেয়ে রইনু বসে কে ফেলাবে পাত৷’’
বউ কোনোক্রমে গেল আঁচাতে৷
কুম্ভীরবর্গীয় সমস্ত জানোয়ারেরাই চলবার সময় একটু লাফাতে লাফাতে যায় (সে বিরাট আকারের কুমীর থেকে শুরু করে টিকটিকি পর্যন্ত সবাই এই রীতিতেই চলে) ও এই একই রীতিতে শিকার ধরে ৷ শিকার ধরে মুখে নিয়ে যাবার সময় তারা নিজেরা লাফাতে লাফাতে যায় বলে দেখে মনে হয় শিকারটাও ৰোধহয় নাচতে নাচতে যাচ্ছে৷ কুমীর যখন ননদকে ধরে নিয়ে যাচ্ছিল তখন কুমীরটা নিশ্চয় ওই ভাবেই যাচ্ছিল৷ বউ দেখলে খ্যাঁটনের পালা তো চুকে গেছে৷ এখন ননদকে কুমীরে নিয়ে গেছে বললেও ক্ষতি নেই৷ হাঁড়ি যদি ফেলে দেওয়াও হয়, হাঁড়িতে এক কণা ভাতও অবশিষ্ট নেই৷ বউ সবই চেটেপুটে খেয়ে নিয়েছে৷ তাই বউ (অর্থাৎ ভাজ) আঁচাতে আঁচাতে ঘাটের আর সবাইকে ডেকে বললে ঃ
‘‘ভাল কথা মনে পড়ল আঁচাতে আঁচাতে৷
ঠাকুরঝিকে নিয়ে গেল নাচাতে নাচাতে৷৷’’
সবাই বললে–তোমার ঠাকুরঝিকে কুমীরে নিয়ে গেছে এই খবরটা এতক্ষণ চেপে রেখেছিলে কেন ভাজ বললে– এতক্ষণ কথাটা মনে ছিল না৷ আঁচাতে আঁচাতে মনে পড়ল৷