নারী প্রগতির একাল সেকাল

লেখক
লীনা দাস

লেখিকা পরিচিতি

লেখিকা জন্ম থেকে সেরিব্রাল পলসিতে আক্রান্ত হওয়ার কারণে অনেকটা শারীরিক ও কিছুটা মানসিক প্রতিবন্ধকতার স্বীকার হয়েছে৷ চিকিৎসার জন্য যে সকল জায়গায় নিয়ে যাওয়া হয়েছিল তার সর্বত্র ওকে ও ওর অভিভাবকদের জানান হয়েছিল--- এ ধরণের কারুর এ পর্যন্ত মাধ্যমিকের গন্ডি পার হওয়ার নজির নেই৷ এ কথায় ও খুবই কষ্ট পেয়েছিল৷ তবে তা ওকে দমাতে পারে নি৷ ধাপে ধাপে বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্র্বেচ্চ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছে পরীক্ষায় লেখার জন্য সাহায্যকারী নিয়ে ৷ দর্শন বিষয়ে আগ্রহ অনুভব করে বলে ওকে ঐ বিষয়ে পঠন-পাঠনের ব্যবস্থা করা হয়৷ বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ২০১০ এ দর্শনে এম.এ. ও ২০১২তে বি.এড .পাশ করে৷ চাকুরীর পরীক্ষায় এখনও কোন সফলতা না আসায় অবসাদে ভুগছে৷ সে তার নিজের বুদ্ধি দিয়ে যতটা দর্শন শাস্ত্র আত্মস্থ করতে পেরেছে তা দিয়ে সর্বসাধারণের কাছে দর্শনকে বোধগম্য করার জন্য এই ‘‘লোকায়ত দর্শন’’ রচনায় প্রবৃত্ত হয়েছে৷ পাঠকবর্গের কাছে এটা সমাদৃত হলে ওর মানসিক তৃপ্তি আসবে৷      --- প্রকাশক


ভারতীয় জীবনার্দশে নারী প্রগতি অর্থাৎ নারীর আদর্শের সার্বিক ভিত্তিমূল গ্রাম, পৌরাণিক উপকথা, লোকগাথা এক কথায় আধ্যাত্মিকতা৷

ভারতীয় নারীর আদর্শ হল সেবা ধর্ম, ত্যাগব্রত, পরিবারের সকলের প্রতি কর্তব্য ও নিষ্ঠা৷ ভারতীয় নারীসত্ত্বা-ভারতীয় নারীর আত্মপ্রকাশ পিতৃগৃহে, আত্মপ্রতিষ্ঠা সংসারধর্মে৷ সেখানে বিবাহ একটি বন্ধন বা প্রতিষ্ঠান৷ তা কেবল মাত্র সামাজিক অনুষ্ঠান নয়৷ আত্মার সাথে আত্মার রমনে - বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে এখানে পুরুষ ও নারী উভয়েই বিবিধ সম্পর্কে আবদ্ধ হয়ে দৃঢ় বন্ধনে সংসার করেন৷ তা পুরুষতন্ত্র বা পুরুষ জাতিকে বাদ দিয়ে কখনই হতে পারে না৷ যা এখানে দৃঢ় ভাবে স্বীকৃত৷

ভারতবর্ষে অনেক কুসংস্কার ছিল৷ যা দূরীকরণের জন্য রামমোহন, বিদ্যাসাগর নারী শিক্ষার প্রচলন ঘটিয়েছিলেন৷ প্রাচীন কালে জমিদার গৃহের বা অভিজাত নারীগণ ছাড়া শিক্ষা ব্যবস্থায় কারও অধিকার ছিল না৷

ব্রাহ্মণ্য ও বৌদ্ধযুগের পর নারী স্বাধীনতা ধর্মের অজুহাতে ---পুরুষতন্ত্র হরণ করে৷ এবং নারীদের সংসারের মধ্যে ধর্মীয় দৃষ্টি দ্বারা আত্মনির্ভর করে তোলে৷ এরপর আধুনিক যুগে বিভিন্ন শিক্ষাবিদের দৃষ্টিকোণ থেকে নারী শিক্ষাকে ব্যাখ্যা করা হয়৷

গান্ধীজী নারীশিক্ষা সম্পর্কে বলেছিলেন, যদিও নারীদের ভূমিকা পুরুষের থেকে আলাদা তবুও নারী ও পুরুষের সমমর্যাদা ও সমদর্শীতা থাকা আবশ্যক৷ শিক্ষা প্রণালীর ক্ষেত্রে তিনি নারী ও পুরুষের জন্য পৃথক পৃথক শিক্ষা ব্যবস্থার দাবী করেছিলেন৷ সব প্রয়োজন পূরণ করা সম্ভব নয়৷ নারীকে শিক্ষা দিয়ে স্বনির্ভর করে তুলতে পারলে নারী আপনিই তার প্রয়োজন বুঝে নেবে৷

পাশ্চাত্যে নারীরা অনেক বেশি স্বাধীন৷ কারণ পাশ্চাত্যের সামাজিক কাঠামোয়--- এক একজন নারীর পক্ষে আর্থিক, মানসিক ও সামগ্রিক ভাবে সাবলম্বী হওয়া সম্ভব৷ পাশ্চাত্যের বিবাহদর্শ আত্মার সঙ্গে আত্মার রমন নয়৷ সামাজিক ঐক্যবদ্ধ অনুষ্ঠান বা প্রতিষ্ঠান নয়, সেখানে বিবাহ একটি সামাজিক চুক্তি মাত্র৷ অন্যদিকে সেখানে লিভ টুগেদার ও স্পার্মব্যানের মাধ্যমে এলিজাবেথিয়ান সিস্টেমে মাতৃত্ব স্বীকৃত হয় একজন পুরুষকে বাদ দিয়েই৷ প্রাচ্যে মাতৃত্ব-পিতৃত্ব মানুষের সত্ত্বার প্রকৃত পরিপূরক যা একটি জাতি স্বরূপ৷ এখানে মাতা-পিতা বা মাতৃত্ব-পিতৃত্ব অর্থে কেবল মাত্র কর্ণের সহজাত কবজ কুণ্ডলের ন্যায় আপন পিতা-মাতা বা সন্তানটি নয়, সকল পিতৃ-মাতৃ স্থানীয় ব্যক্তিই হল নিজ পিতা মাতার ন্যায় শ্রদ্ধাভাজন৷ সমস্ত সম্ভানবৎ স্নেহ ভাজন ব্যক্তিই হল সন্তানসম৷

সারদা মা---নিবেদিতা ও সুধীর দিদিকে দিয়ে নারীশিক্ষার পত্তন করেছিলেন৷ পাশ্চাত্য থেকে আমরা নেব নারীর প্রত্যয় আর প্রাচ্য থেকে দেব নারীর জীবনবোধ৷ পাশ্চাত্য থেকে প্রযুক্তিনির্ভর শিক্ষায় এসেছে যুগান্তকারী বিপ্লব ও সচেতনতা যা যুগিয়েছে নারীর অর্থনৈতিক, মানসিক স্বাধীনতা৷ যেমন গ্রামীণ কুটির শিল্প, বয়স্ক শিক্ষা, নাইট স্কুল, ইন্টারনেট, মোবাইল, লাইব্রেরী, ওয়েভ নির্দেশনা প্রভৃতি শিক্ষা প্রণালী ভারতীয় নারীকে এনে দিয়েছে স্বনির্ভরতা৷ কিন্তু এই শিক্ষা প্রণালী প্রাচ্যে সর্বতোভাবে কার‌্যকর নয়৷

প্রাচ্যের মৌলিক শিক্ষা হল পারিবারিক নিষ্ঠা, একাত্মতা ও আধ্যাত্মিকতা৷ এই শিক্ষায় ভারতীয়রা সান্নিধ্য ধন্য ও স্নেহধন্য হতে পারে৷ এখানে ভারতীয় শিশুরা যন্ত্রনির্ভর নয়৷ পরিবার, বংশগতি, পরিজন ও শিক্ষা ও উত্তম গুণের আদর্শে বয়স ও অভিজ্ঞতা সম্পন্ন হয়ে গড়ে ওঠে৷ যা প্রতিটি ভিন্ন ভিন্ন পারিবারিক ভাবধারার আদর্শ অনুযায়ী মানব গোষ্ঠী ও ব্যক্তিকে গড়ে তোলে৷

তাই এখানে শ্রীমার কথা---মাতা কেবল আপন পুত্রের মাতা নয় পরের পুত্রেরও মাতা হয়ে উঠতে পারেন এবং পুত্র কেবল আপন মাতার পুত্র না হয়ে পরের মাতার পুত্র হয়ে উঠতে পারেন৷ তাই এখানে ধর্মপুত্র বা ভিক্ষাপুত্রের আদর্শ পালন করা সম্ভব যা অচ্ছেদ্য ও চিরায়ত ৷ পাশ্চাত্যে হ্যারিয়েড রিচার্ডসটো, টঙ্কাকার কেবিন ও সিম দ্য বোভেয়ারের লেখায় যতই নারী জাতির জয়গান করা হোক না কেন তাতে ভারতীয় আদর্শ কখনই পরিপূর্ণতা পায় না৷ যদিও দেবদাসী প্রথা ভারতের এক কলঙ্কিত অধ্যায় ভারতের নারীদের লক্ষ্মী, দুর্গা ও শক্তি রূপে মান্যতা প্রদান করা হয়৷ এটাই হল চিরায়ত নারী জাতীর সম্মান ও ঐতিহ্য৷ যার সাথে যুগ-ধর্মের সম্মিলন ঘটেছে৷ অতীত, বর্তমান, ভবিষ্যতে প্রাচ্যে আদর্শ বিচ্যুত নারী মাত্রই নরকের দ্বার হিসাবে ভর্ৎসিত হয়ে থাকে৷

‘মা’ শব্দটি দেশ কাল ধর্মের প্রভেদের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়--- তা শ্রীশ্রী মা দেখিয়েছেন৷ তিনি ছিলেন অসীম সাগরের মত অপার৷ মায়ের কাছে সন্তান কেবল মাত্র সম্তান৷ সন্তানের কাছে মা কেবল মাতা৷ তিনি কেবল গর্ভধারিনী হবেন তা নয়৷ শুধুমাত্র নিজের সন্তানের মধ্যে মাতৃত্ব পরিপূর্ণ রূপ পায় না৷ এখানে পাঁচ প্রকার মাতৃস্থানীয়াকে মা বলে স্বীকার করা হয়েছে৷ সন্তানসমকে সন্তানবৎ স্নেহ দান করাই মাতৃত্বের পরিপূর্ণতা, যাতে মাতৃত্ব তার আদর্শ জীবনবোধ ও জীবনশৈলী পরিগ্রহ করে৷ কিন্তু মাতৃত্বের সার্থক বিকাশ হয় প্রতিটি নারীর মাতৃভাবের সহজাত প্রবণতার মধ্য দিয়ে৷

প্রতিটি মানবেতর প্রাণীর মত যদি মানবকন্যা বধূমাতারা আপন সন্তানের মত বাৎসল্য ভাব প্রকাশ করতে পারেন তা হয় নিটোল, অপার শান্তিময় ও প্রাণময় প্রকৃত জীবনবোধ৷ তবেই মাতৃত্বের সম্পর্ক সাফল্য লাভ করে৷

পাশ্চাত্যে মাতৃত্বের সঙ্গেও এক দেনাপাওনা বৃত্তিগত সাফল্য প্রদান নির্দেশনা করা হয়৷ সেটা এতটাই বস্তুগত হয়ে যায় যে মাধুর্যময় মাতৃভাবটাই ম্লান হয়ে যায়৷ সেখানে জীবনদর্শন ও জীবনশৈলী আদর্শণত ভাবে শূন্য- গর্ভতায় পর্যবসিত হয়৷

প্রাচ্যে কিন্তু জীবন দর্শন, জীবনশৈলীর সাথে শুধু যুক্তই নয় এখানে জীবনবোধ সমগ্রতায় অনেক বেশি ব্যাপক ও বিস্তৃত৷ জীবন দর্শন অখণ্ড, জীবনশৈলী হল তার খণ্ড৷ ভগ্ণী নিবেদিতার কথায় শ্রীমা কি পুরাতনের শেষ প্রতিনিধি না আধুনিকতার অগ্রদূত৷ আবার মিসেস আলিসারাবুল বলেছেন শ্রীমা যেন ভালবাসার প্রতিমূর্তিখানি৷