নারীর মর্যাদা মানব সমাজ ও নারী

লেখক
অবধূতিকা আনন্দ মধুব্রতা আচার্যা

আজ থেকে প্রায় ১০ লক্ষ বছর আগে প্রথম মানব শিশুর জন্ম হয়েছিল৷ সে যুগের মানুষ মস্তিষ্ক দিয়ে বেশী চিন্তা করতে পারতো না৷ কারণ তার ক্ষমতা ছিল সীমিত৷ কিন্তু এখন তার পার্থক্য অনেক৷ মানুষের বুদ্ধির বিকাশ ঘটেছে৷ তার মধ্যে সাংস্কৃতিক, বৈজ্ঞানিক, আধ্যাত্মিক চিন্তা প্রভৃতি জেগেছে৷ মানুষের চিন্তাধারার মধ্যে পরিবর্তন ঘটেছে৷

মানব সমাজ সৃষ্টি হ’ল, মানব সমাজের উন্নতি হ’ল ঠিকই কিন্তু সত্যিই কী নারী তার যোগ্য মর্যাদা পেয়েছে

ইতিহাসের পাতা খুললেই দেখি শৈব্যতান্ত্রিক যুগে এক পাহাড়ের পুরুষেরা অন্য পাহাড়ের নারীদের জোর করে ধরে নিয়ে এসে তাদের বিবাহ করত৷ পরবর্তীকালে দেখি সতীদাহ প্রথা, মরণাপন্য পুরুষের সঙ্গে জোর করে বিবাহ, স্বামী মারা গেল সেই অল্প বয়সের বিধবার আর বেঁচে থাকার কোন অধিকারই ছিল না৷ একই চিতায় স্বামীর সঙ্গে সহমরণে যেতে বাধ্য করা হত৷

কিন্তু অন্য দিকে দেখা যায় ঝাঁসীর রাণী লক্ষ্মীবাঈ, দেবী চৌধুরাণী, প্রীতিলতা, মাতঙ্গিনী হাজরা প্রভৃতি নারীকে, যাঁরা পুরুষের চাইতে কোন অংশে কম ছিলেন না৷ শারীরিক বিচারে পুরুষের চাইতে নারীর স্নায়ুগত পার্থক্য আছে৷ কিন্তু তা সত্ত্বেও সমাজে নারীর মূল্য পুরুষের চাইতে এক পাইও কম নয়৷ স্বার্থপর কিছু পুরুষ নারীর দুর্বলতার সুযোগটুকুই ষোল আনা নিয়েছে৷ মুখে মাতৃজাতি বলে ঘোষণা করলেও আসলে তাদের অবস্থাটা করে রেখেছে ঠিক গৃহপালিত গোরু–ভেড়ার মত৷ নারীকে পুরুষেরা ক্রীতদাসী হিসাবে দেখতে চায়৷

প্রাগৈতিহাসিক যুগে নারী–পুরুষ প্রকৃতির কোলে একসঙ্গে নেচে–গেয়ে, হেসে–খেলে জীবন কাটিয়ে দিত৷

পৌরাণিক যুগে বলা হতো নারীরা মুক্তি বা মোক্ষ পাবে না৷ জন্ম–জন্মান্তরের তপস্যায় সে যদি পুরুষ দেহ লাভ করে তবেই সে মুক্তি–মোক্ষের অধিকারিণী হবে৷ যতক্ষণ সে নারী ততক্ষণ তার কাছে পতি সেবাই পরম ধর্ম৷ ‘‘পতি ধ্যান, জ্ঞান, স্বর্গ ও ভাগ্য বিধাতা৷’’

আনন্দমার্গ দর্শনে নারীকে তার যোগ্য মর্যাদা দেওয়া হয়েছে৷ সমাজে নারী ও পুরুষের সমান দায়িত্ব ও অধিকার আনন্দমার্গে স্বীকৃত৷ এখানে নারী–পুরুষের মধ্যে কোনরকম ভেদ সৃষ্টি করা হয়নি বা নারীর অধিকার কোন ভাবেই খর্ব করা হয়নি৷ আনন্দমার্গে নারী–পুরুষকে সমান দৃষ্টিতে দেখা হয়৷

নারী–পুরুষ উভয়েই একই পরমপিতার সন্তান৷ যেহেতু উভয়েই পরম পিতার সন্তান, তাই জীবনের অভিব্যক্তি ও স্বাধিকারের ক্ষেত্রে উভয়েরই সমান অধিকার৷

তাই শ্রীপ্রভাতরঞ্জন সরকার বলেছেন–‘‘মানব ইতিহাসে আমরা দেখেছি নারী কেবল নারীত্বকেই গৌরবান্বিত করেনি, সমস্ত মানব জাতিকে গৌরবান্বিত করেছে৷ দর্শনে, আধ্যাত্মিকতায়, সমাজ সংস্কারে, শিক্ষাক্ষেত্রে, বিজ্ঞানে, প্রযুক্তিতে কোথাও নারী–পুরুষের চেয়ে পিছিয়ে নেই৷ জটিল দার্শনিক তত্ত্বের সমাধানই হোক অথবা সামাজিক বা শিক্ষানৈতিক সংস্কারই হোক, সব ক্ষেত্রে মেয়েরা পুরুষের মতই সক্রিয় ভূমিকা গ্রহণ করেছে৷ বিপদে–আপদে পুরুষকে প্রেরণা জোগাতেও নারীর ভূমিকা অনস্বীকার্য৷’’

তাই বর্তমানে নারীদের মধ্যে সৃষ্টি করতে হবে এক বলিষ্ঠ গতিশীল ও বৈপ্লবিক সমাজচেতনা৷ যাতে নারীজাতি নব–প্রেরণায় উজ্জীবিত হয়ে সর্বপ্রকার দাসত্বের বন্ধন ও ভাবজড়তাগুলোকে নিশ্চিহ্ণ করে এগিয়ে চলতে পারে৷ আজকের নারী জাতি হোক নূতন বিপ্লবের অগ্রদূত৷ গৌরবোজ্জ্বল ভবিষ্যতের জন্যে মানবতার এই অভ্যুত্থান অত্যাবশ্যক৷