অনেক দিন ধরে কোন একটা কাজ করে চললে অথবা কোন কাজ না করলে মানুষের মনে কুসংস্কার দানা বাঁধে৷ তাই দেখা যায় যখন অক্ষর আবিষ্কৃত হয়েছিল তার পরেও মানুষ বেদ ও অন্যান্য শাস্ত্রাদিকে অক্ষরবদ্ধ বা লিপিবদ্ধ করেনি৷ কেননা তারা মনে করত যে, যেহেতু পূর্বপুরুষেরা লেখেননি সেহেতু বেদকে অক্ষরের মধ্যে আবদ্ধ করা অন্যায় ও অবাঞ্ছনীয়৷ আসলে তখন যে অক্ষরই আবিষ্কৃত হয়নি এ কথাটা তাঁরা বেমালুম ভুলে থেকেছিলেন৷ অনেক পরবর্ত্তীকালে উত্তর–পশ্চিম ভারতে কশ্মীরের পণ্ডিতেরা যখন সারদা লিপিতে লেখা শুরু করেন তখন তাঁরা দেখলেন চারটে বেদকে একসঙ্গে মুখস্থ রাখা অসম্ভব৷ শুধু তাই নয় ততদিন বেদের ১০৮ অংশের মধ্যে ৫২টাই লুপ্ত হয়ে গেছে৷ তাই তাঁরা ঠিক করলেন বেদকে লিখে রাখতে হবে কেননা দেরী করলে হয়তো সবই লুপ্ত হয়ে যাবে৷ তখন বেদের অবশিষ্ট অংশ লেখা হ’ল সারদা লিপিতে৷ যে অংশটা লুপ্ত হয়ে গেছ্ল, সেটা আর লেখা হ’ল না৷ আজ হাজার সাধ্য সাধনা করলেও সে লুপ্ত অংশ আর খুঁজে পাওয়া যাবে না৷
চারটে বেদকে এক সঙ্গে মনে রাখা যখন অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছিল তখন পণ্ডিতরা ঠিক করলেন চারটে বেদের পরিবর্ত্তে একটা বেদকে মুখস্থ রাখলেই চলবে৷ এইভাবে একটা বেদকে যাঁরা মুখস্থ রাখতে পারলেন তাঁদের উপাধি দেওয়া হ’ল ‘পাণ্ডেয়’ (পাঁড়ে) অর্থাৎ যিনি একটা বেদে পণ্ডিত৷ (‘পণ্ডা’ শব্দের আসল অর্থ হচ্ছে বেদোজ্জ্বলা বুদ্ধি বা ব্রহ্মজ্ঞান–‘অহং ব্রহ্মাস্মীতি বুদ্ধিঃ তামিতঃ প্রাপ্তঃ পণ্ডিতঃ’ অর্থাৎ এই বেদোজ্জ্বলা বুদ্ধি যাঁর আছে তিনিই পণ্ডিত পদবাচ্য)৷ দু’টো বেদ যাঁদের মুখস্থ থাকত তাঁদের বলা হ’ত ‘দ্বিবেদী’ (দুবে), এইরূপ তিনটে বেদের পণ্ডিত হলে বলা হ’ত ‘ত্রিবেদী’ (তেওয়ারী)৷ চতুর্বেদে পণ্ডিত হ’লে বলা হ’ত চতুর্বেদী (চৌবে)৷ পরবর্ত্তীকালে যজুর্বেদ এত বড় হয়ে গেল যে তাকে দু’টো ভাগে ভাগ করা হল–(১) কৃষ্ণযজুর্বেদ ও (২) শুক্লযজুর্বেদ৷ যাঁরা শুক্লযজুর্বেদে পণ্ডিত হতেন তাঁদের বলা হ’ল শুক্ল (কথ্য ভাষায় ‘শুকুল’)৷ এইভাবে বেদ যখন বড় হ’তে হ’তে মুখস্থ রাখার ক্ষমতার বাইরে চলে গেল তখন বাধ্য হয়ে পণ্ডিতেরা বেদের লিখিত রূপ দিতে মনস্থ করেন৷ বেদের এই লিখিত রূপ ছাড়া অলিখিত অংশকে সাহিত্যের এক্তিয়ারের বাইরে রাখা যাবে না৷
হাজরা ঃ বাংলায় ব্যবহূত ‘হাজরা’ শব্দটি একটা সামরিক র্যাঙ্ক বা পদবিশেষ৷ এক সহস্র (ফার্সীতে, ‘হজার’) সৈনিকের যিনি অধিপতি তিনি হলেন ‘হজারা’৷ ভুল করে একেই বলা হয় ‘হাজরা’৷ তেমনি আসলে ফার্সী শব্দটা হচ্ছে ‘হজারিবাগ’৷ বাংলায় যখন ‘হাজারিবাগ’ বলি তখন কিন্তু কাউকেই হাসতে দেখি না অর্থাৎ ভুল উচ্চারণটাই মেনে নেওয়া হয়েছে৷
নায়ক, পট্টনায়ক ঃ পাঠান–মোগল যুগে প্রদেশকে বলা হ’ত ‘সুবা’ আর সুবার শাসনকর্তাকে বলা হ’ত ‘সুবাদার’ বা ‘সুবেদার’৷ এরূপ ‘মনসবদার’ আর একটি সামরিক বিভাগের উপাধি৷ অল্প সংখ্যক সৈনিক নিয়ন্তাকে সংস্কৃতে বলা হয় ‘নায়ক’৷ কয়েকজন নায়কের ওপরে থাকতেন ‘পট্টনায়ক’৷ ‘পট্ট’ কথাটা থেকেই বাংলায় ‘পাট’ কথাটা এসেছে৷ রূপকথার পাটরাণী কথাটা এসেছে ‘পট্টরাণী’ থেকে৷ পাট বোঝাতে পূর্ব বাংলার অনেক জায়গায় ‘কষ্টা’ও বলা হয়৷ ‘কষ্টা’ শব্দ সংস্কৃত ‘কষ্টক’ (যার অর্থ, ছাল) থেকে এসেছে৷
দস্তিদার ঃ ‘দস্ত্’ শব্দযুক্ত অনেক ফার্সী শব্দ বাংলায় রয়েছে৷ যেমন, দরাজদস্ত্, দস্তানা, দস্তাবেজ, দস্তখৎ, দস্তিদার প্রভৃতি৷ ফার্সীতে ‘দস্ত্‘ কথাটার মানে হ’ল হাত৷ যার হাত খুব উদার সে হ’ল ‘দরাজদস্ত্’৷ হাতের চিহ্ণ হ’ল ‘দস্তখৎ’৷ হাতে যা পরা হয় তা হ’ল ‘দস্তানা’৷ হাতের লিখিত প্রমাণ ‘দস্তাবেজ’৷ সরকার বা শাসককুলের যিনি হস্তস্বরূপ তিনি হচ্ছেন ‘দস্তিদার’৷ বাঙলায় ‘দস্তিদার’ পদবীযুক্ত অনেক লোক আছেন৷
হিন্দু ঃ স্পষ্ট কথা প্রাচীনকালে ‘হিন্দু’ শব্দটি ছিল না৷ ‘হিন্দু’ শব্দটি হচ্ছে একটি ফার্সী শব্দ, যার মৌল অর্থ হচ্ছে সিন্ধু নদীর অববাহিকা অথবা তৎসন্নিহিত এলাকায় যে জনগোষ্ঠী বাস করে থাকেন৷ তা’ তাঁরা যে কোন ধর্মমতাবলম্বী হউন না কেন, তাঁরা সবাই হিন্দু৷ অর্থাৎ ‘হিন্দু’ শব্দটি সম্পূর্ণতই একটা দেশবাচক শব্দ৷ আজকাল যাঁদের হিন্দু বলি তাঁরা দেশবাচক অর্থে হিন্দু তো বটেই, ধর্মগত কারণে ‘আর্ষ’ মতাবলম্বী৷ কিন্তু বর্ত্তমানে যেহেতু আর্ষ মতের বদলেও ‘হিন্দু’ শব্দটা ব্যবহূত হচ্ছে তাই আজ যাঁরা তথাকথিত হিন্দু তাঁরা দেশবাচক অর্থেও হিন্দু মতগত বিচারেও হিন্দু৷ কিন্তু ভারতে যাঁরা তথাকথিত অন্যান্য সম্প্রদায়ের লোক রয়েছেন তাঁর দেশবাচক অর্থে হিন্দু কিন্তু মতগত বিচারে হিন্দু নন, তাঁদের নিজের নিজের ধর্মমত বা রেলিজন্ •religion— রয়েছে৷