পলিটিক্যাল স্টেট নয়–সামাজিক অর্থনৈতিক  অঞ্চলই সমাধানের পথ

লেখক
আচার্য মন্ত্রসিদ্ধানন্দ অবধূত

রাষ্ট্র শব্দটির সঙ্গে ভারতবর্ষের পরিচয় খুব বেশীদিনের নয়৷ বিদেশী বণিকের নানা আদব–কায়দার সঙ্গে রাষ্ট্র শব্দটি ভারতবর্ষে অনুপ্রবেশ করে৷ ভারতীয় সভ্যতার মূলে ছিল সমাজ৷ ভারতবর্ষে অসংখ্য ছোট ছোট রাজ্য ছিল, তথাপি রাজার আইন অপেক্ষা সামাজিক বিধিনিষেধকে মানুষ অনেক ক্ষেশী মর্যাদা ও মান্যতা দিত৷ রাজার আইন মানুষ ভয়ে মানতো৷ কিন্তু সামাজিক বিধিকে মানুষ ঈশ্বরের বিধান বলেই বিশ্বাস করতো৷ যদিও ওই সব সামাজিক বিধিনিষেধের মধ্যে অনেক ভাবজড়তা ও কুসংস্কার ছিল৷ তথাপি ভারতীয় সমাজে ঐক্যের যে বাঁধন ছিল তা ওই সব সামাজিক বিধি–নিষেধের ডোরেই  বাঁধা ছিল৷ ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী ভাবাবেগই ভারতবর্ষকে একটি রাষ্ট্রীয় কাঠামোর রূপ দিয়েছিল৷ জাতি–ধর্ম–বর্ণ নির্বিশেষে সকল শ্রেণীর মানুষই ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে আন্দোলনে ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল৷ ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের  বিদায়ের পর ব্রিটিশ বিরোধী ভাবাবেগও স্তিমিত হয়ে যায়৷ ভারতবর্ষের রাষ্ট্রকাঠামো দুর্বল হয়ে যায়৷ ভারতের রাষ্ট্র কাঠামোকে দৃঢ় করার পক্ষে কোন ভাবাবেগ তৈরী করতে ব্যর্থ হয় ভারতের রাজনৈতিক নেতারা৷

‘‘বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্য’’–এই ঐতিহ্যের মধ্যে রাষ্ট্র কাঠামোয় কোন প্রভাব নেই৷ নানা ভাষা, কৃষ্টি, সংস্কৃতি, পোষাক–পরিচ্ছদ, আচার–আচরণ, রীতি–নীতির মধ্যে যে বৈচিত্র্য, সেখানে সামাজিক গুণেরই প্রভাব৷ ভারতবর্ষে রাষ্ট্রের আইন নয়, জন–জীবনের নিয়ন্ত্রণক ছিল সমাজশাস্ত্র৷ ইয়ূরোপের আমদানিকৃত রাষ্ট্র–সভ্যতা যেমন রাষ্ট্র হিসাবে ভারতকে ঐক্যবদ্ধ করেছিল, আবার সেই ঐক্যের মধ্যে বিচ্ছিন্নতার বীজও বপন করেছিল৷ সেই বীজই রাজ্যে রাজ্যে মহীরুহ হয়ে মাথা তুলে দাঁড়াচ্ছে৷ কারণ ব্রিটিশ পরবর্তী স্বাধীন ভারতে কোন ভারতীয় সেন্টিমেন্ট বা ভাবাবেগ রাষ্ট্র নেতারা তৈরী করতে পারেননি যার দ্বারা ভারতের রাষ্ট্র কাঠামোকে মজবুত রাখা যায়৷ বরং রাজ্যে রাজ্যে বিচ্ছিন্ন হওয়ার প্রবণতা যেভাবে মাথা তুলে দাঁড়াচ্ছে তা একদিন ভারতবর্ষের রাষ্ট্র কাঠামোকে শুধু যে দুর্বল করবে তা নয়, ভেঙে টুকরো টুকরো করে দিতে পারে৷

গলদের শুরু ১৯৪৭ সালের ১৫ই আগষ্টের বহু আগে থেকে৷ প্রাউট–প্রবক্তা দার্শনিক শ্রীপ্রভাতরঞ্জন সরকার তাঁর ‘দেশপ্রেমিকদের প্রতি’ গ্রন্থে স্বাধীনতা সংগ্রামের দোষ–ত্রুটি নিয়ে পর্যালোচনায় যা বলেছেন তার সারকথা হ’ল–জাতীয় কংগ্রেসের নেতারা যদি রাজনৈতিক স্বাধীনতা আন্দোলনের পাশাপাশি অর্থনৈতিক স্বাধীনতার দাবীও তুলতেন, তাহলে দেশভাগের মতো দুর্ভাগ্যজনক ঘটনা হয়তো ঘটতো না৷ কারণ অর্থনৈতিক স্বাধীনতার আন্দোলনে দেশের সমস্ত শ্রেণীর মানুষকে সহজে সামিল করা যেত৷ এতে রাজনৈতিক স্বাধীনতার আন্দোলন থেকে দেশীয় পুঁজিপতিরা সাহায্যের হাত সরিয়ে নিত৷ হয়তো বা আন্দোলনের বিরোধিতাই করতো৷ তবু  অর্থনৈতিক স্বাধীনতার আন্দোলনই জাতীয় ঐক্যকে সুদৃঢ় করার একমাত্র সহায়ক ছিল৷ রাজনৈতিক স্বাধীনতার আন্দোলনে ছিল ক্ষমতার গন্ধ৷ সেই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ ভারতের সংখ্যালঘু মুসলীমদের বোঝাতে সক্ষম হয়েছিল যে স্বাধীন ভারতে তাদের চিরকাল হিন্দু শাসনাধীনে থাকতে হবে৷ অর্থনৈতিক স্বাধীনতার আন্দোলনে হিন্দু মুসলীম সমস্ত শোষিত মানুষ ঐক্যবদ্ধ হয়ে সামিল হতো, ব্রিটিশের পক্ষে জাতি বিদ্বেষের বীজ বপন করা দুরূহ হতো৷ কিন্তু ভারতের রাষ্ট্রনেতারা অর্থনৈতিক স্বাধীনতা লাভের আন্দোলনে যেতে সাহস পান নি৷ প্রথম কারণ দেশীয় পুঁজিপতিদের সাহায্য থেকে বঞ্চিত হতে হতো৷ দ্বিতীয় কারণ আন্দোলন চালনা করা অনেক কষ্টকর হতো ও স্বাধীনতা অর্জনও সময় সাপেক্ষ হতো৷

 দেশ ভাগের মতো দুর্ভাগ্যজনক ঘটনার মধ্য দিয়ে স্বাধীনতা লাভের পরও ভারতীয় রাষ্ট্র কাঠামোকে ঐক্যবদ্ধ রাখার পক্ষে কোন ভাবাবেগ তৈরী করতে ব্যর্থ হয়েছেন ভারতীয় রাষ্ট্র নেতারা৷ অপর দিকে হিন্দীকে রাষ্ট্রভাষা করেও ভাষা ভিত্তিক রাজ্য ঘটন করতে গিয়ে রাষ্ট্রীয় কাঠামোকে আরও দুর্বল করে দিয়েছে৷ কোন একটি ভাষা, কোন একটি ধর্মমত, কোন একটি তত্ত্ব বা দর্শন রাষ্ট্রীয় ভাবাবেগকে দীর্ঘদিন ধরে রাখতে সক্ষম নয়৷ তার অসংখ্য দৃষ্টান্ত পৃথিবীতে আছে৷ কোন একটি ভাষা, ধর্মমত বা তত্ত্ব রাষ্ট্র ঘটনে সহায়ক হলে সমগ্র ইয়ূরোপে কয়েকটি মাত্র রাষ্ট্র থাকতো, সমগ্র আরব দেশ মিলে একটি রাষ্ট্র ঘটিত হতো৷ চীন ভিয়েতনাম যুদ্ধে জড়াত না৷ ভারতীয় রাষ্ট্র নেতারা চোখের সামনে এতো নজির থাকতেও কোন শিক্ষা গ্রহণ করেননি৷ তাই সুদৃঢ় অর্থনৈতিক সংরচনা ও রাষ্ট্রীয় পরিকাঠামো–সব দিক দিয়েই ব্যর্থ হয়েছে ভারতের রাষ্ট্র নেতারা৷

আজ যে ভাবে রাজ্যে রাজ্যে আবার বিচ্ছিন্ন হবার প্রবণতা মাথাচাড়া দিচ্ছে তা ভারতীয় যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে এক অশনি সংকেত৷ ব্রিটিশ রাজত্বে রাজনৈতিক প্রদেশগুলোতে শাসনকার্যের সুবিধাকেই গুরুত্ব দেওয়া হতো৷ জনসাধারণের সার্বিক কল্যাণের কথা বিদেশী শাসক কখনই ভাবেনি৷ কিন্তু ব্রিটিশ পরবর্তী স্বাধীন ভারতেও সার্বিক কল্যাণের কথা না ভেবে সংকীর্ণ ভাবাবেগকেই গুরুত্ব দিয়েছে৷ তারই পরিণতিতে আজ রাজ্যে রাজ্যে বিচ্ছিন্নতার আবাজ উঠেছে৷ যারা হিন্দীকে রাষ্ট্র ভাষা করে দেশের সংহতি রক্ষা করতে চাইছে তারা কানে তুলো গুঁজে চোখে ঠুলি পরে বসে আছে৷ নতুবা দেখতে পেতেন জোর করে ঊর্দু চাপানোর পরিণামে পূর্ব পাকিস্থানের পরিণতি কি হয়েছে৷  অবশ্য ভারতীয় নেতাদের কাছে বিকল্প কোন পথের হদিসও নেই৷ মিশ্র অর্থনীতির ন্যায় সোনার পাথর বাটী হাতে তারা কল্পনার আকাশে উড়ে বেড়াচ্ছেন৷ মাটির মানুষের সঙ্গে এঁদের কোন যোগ নেই৷ তাই ভারতবর্ষের মতো বহুভাষা–কৃষ্টি–সংস্কৃতি সম্পন্ন মানুষের দেশে অর্থনৈতিক বিকাশ জনসংহতির কোন পথই এদের সামনে নেই৷

বর্তমান ভারতের সংকট সম্পর্কে অনেক আগেই রাষ্ট্র নেতাদের সাবধান করেছিলেন মহান দার্শনিক ঋষি পরম শ্রদ্ধেয় শ্রীপ্রভাতরঞ্জন সরকার তাঁর রচিত ‘‘দেশ প্রেমিদের প্রতি’’ গ্রন্থে৷ কিন্তু দেশের রাষ্ট্র নেতারা এতই সংকীর্ণমনা যে গ্রন্থটির প্রতি দৃষ্টিপাত করার প্রয়োজন বোধ করেননি৷ অথচ বর্তমান সামাজিক অর্থনৈতিক সংকট থেকে বেরিয়ে এসে একটি বলিষ্ঠ সামাজিক-অর্থনৈতিক ব্যবস্থা গড়ে তোলার সুস্পষ্ট পথ নির্দেশনা দিয়ে গেছেন শ্রীপ্রভাতরঞ্জন সরকার তাঁর প্রগতিশীল উপযোগ তত্ত্বে যা সংক্ষেপে ‘প্রাউট’৷

আজকের পৃথিবী ক্ষুদ্ররাজ্য ও বৃহৎ প্রাণীর পক্ষে অযোগ্য হয়ে পড়েছে৷ জড় সম্পদের ও বিজ্ঞানের অপরিণামদর্শী ব্যবহার প্রকৃতির পরিবেশকে নষ্ট করছে, অপর দিকে ক্ষুদ্র রাজ্যের পরিধির মধ্যেও জীবন ধারনের প্রয়োজনপূর্ত্তির সব রকম রসদ মিলবে না৷ পলিটিক্যাল স্টেটগুলো অর্থনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে তৈরী না হওয়ায় একটি স্টেটের মধ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ সামাজিক-অর্থনৈতিক অঞ্চল নাও গড়ে উঠতে পারে৷ তাই প্রাউট প্রণেতা রাষ্ট্র ও সমাজের সমন্বয় সাধন করে এক একটি স্বয়ং সম্পূর্ণ সামাজিক-অর্থনৈতিক অঞ্চল ঘটনের পরিকল্পনা দিয়েছেন৷ এই ধরনের স্বয়ংসম্পূর্ণ অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলি সার্বিকভাবে মানুষকে অর্থনৈতিক শোষণের হাত থেকে মুক্ত করবে আবার স্থানীয় ভাষা, ঐতিহ্য, সাহিত্য, সংস্কৃতি প্রভৃতিকে অবদমনের হাত থেকে মুক্ত করে সার্বিক বিকাশের দ্বার খুলে দেবে৷ ফলে প্রতিবেশী স্বয়ংসম্পূর্ণ অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলির মধ্যে একটা প্রীতির সম্পর্ক গড়ে তুলবে ও মানব সমাজের বৃহত্তর ঐক্যের পথ প্রশস্ত করবে৷ সেই যে সমস্ত ক্ষুদ্র ও সংকীর্ণ সেন্টিমেন্ট মানব সমাজে ফাটল ধরায় সেগুলো দূর হয়ে যাবে৷ প্রাউটের সামাজিক-অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলি গড়ে তোলার লক্ষ্যও তাই৷

স্বয়ংসম্পূর্ণ সামাজিক-অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলি গড়ে তুলতে প্রাউট যে বিষয়গুলি বিবেচনা করেছে তা হ’ল সম–অর্থনৈতিক সমস্যা, সম–র্থনৈতিক সম্ভাবনা, জনগোষ্টীগত বৈশিষ্ট্য, সাংবেদনিক উত্তরাধিকার, একই ধরনের ভৌগোলিক বৈশিষ্ট্য৷ অর্থাৎ একটি অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তুলতে হলে যে সমস্ত সমস্যার সম্মুখীন হতে হবে তা এক এক ধরনের জনগোষ্ঠীর ক্ষেত্রে এক এক ধরনের৷ যেমন, উৎপাদিত পণ্যের উপযুক্ত বাজার, উদ্বৃত্ত বা ঘাটতি শ্রম যোগাযোগ, পরিবহন ইত্যাদি সমস্যাগুলি বাঙালীস্তান ও পার্শ্ববর্ত্তী বিহারের ক্ষেত্রে একই ধরনের নয়৷ তেমনি অর্থনৈতিক সম্ভাবনাগুলিও এক প্রকার হবে না৷ আবার জনগোষ্ঠীগত ভাষা, সংস্কৃতিগত পার্থক্য প্রভৃতি বিষয়গুলিও স্বয়ং–সম্পূর্ণ অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তোলার ক্ষেত্রে বিবেচ্য৷

উপরোক্ত বিষয়গুলি বিচার বিবেচনা করে প্রাউট একাধিক পলিটিক্যাল স্টেটের মধ্যে একটি অর্থনৈতিক অঞ্চল আবার একটি পলিটিক্যাল স্টেটের মধ্যে একাধিক অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তোলার প্রস্তাব দিয়েছে৷ যেমন পশ্চিমবঙ্গ ত্রিপুরা ও অসম, বিহার, মেঘালয়, ঝাড়খণ্ড ও ওড়িষ্যার কিছু কিছু অংশের অঞ্চলের মানুষের অর্থনৈতিক  সমস্যাগুলি একই ধরনের, আবার ভাষা কৃষ্টি সংস্কৃতিগতভাবে একই জনগোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত৷ তাই এই সব একাধিক স্টেটের মধ্যে একটি মাত্র অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে উঠবে৷ আবার বিহারে–অঙ্গিকা, মৈথিলী, ভোজপুরি প্রভৃতি জনগোষ্ঠীগত পার্থক্য থাকায় একটি স্টেটের মধ্যেই একাধিক অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে উঠবে৷ এইভাবে প্রাথমিক পর্যায়ে অর্থনৈতিক শোষণ ও ভাষাসংস্কৃতিগত অবদমনের হাত থেকে জনগোষ্ঠীগুলিকে মুক্ত করতে ভারতবর্ষে ৪৪টি অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে উঠবে৷ পরবর্তীকালে এই সকল অঞ্চলগুলি যখন আপন শক্তি ও স্বাধীনতার বলে সমমর্যাদার আসনে প্রতিষ্ঠিত হবে তখন সমগ্র ভারতবর্ষে একটি মাত্র অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তোলা সম্ভব হবে৷ এইভাবে শুধু ভারতবর্ষের সংহতি নয়, আঞ্চলিক শ্রীবৃদ্ধির পথ ধরে বিশ্বৈকতাবাদের পথ প্রশস্ত করবে৷ তাই বর্তমান ভারতবর্ষে রাজ্যে রাজ্যে যে বিচ্ছিন্নতাবাদ মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে তাকে প্রতিহত করতে ও অর্থনৈতিক শোষণ ও সামাজিক অবদমনের হাত থেকে জনগোষ্ঠীগুলোকে মুক্ত করতে প্রাউটের পথে এলাকা ভিত্তিক সামাজিক-অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তুলতে হবে৷ অর্থনৈতিক সঙ্কট ও সামাজিক অবক্ষয়ের হাত থেকে মুক্তির অন্য কোন পথ নেই৷