বাংলায় ‘গাছা’, ‘গাছি’, ‘গাছিয়া’, (‘গেছে’)–এইসব নামে প্রচুর স্থান রয়েছে৷ বাংলা ভাষায় এই ‘গাছ’ কথাটার উৎস জানা দরকার৷ গাছের সংস্কৃত প্রতিশব্দ ‘বৃক্ষ’ কিন্তু তাই বলে বাংলা ‘গাছ’ শব্দটা সংস্কৃত ‘বৃক্ষ’ থেকে আসে নি বা ‘গাছ’ শব্দটার মূল কোন সংস্কৃত শব্দ নেই৷ ‘গাছ’ শব্দটা এসেছে মাগধী প্রাকৃত ‘গ্রৎস’ শব্দ থেকে৷ ‘গ্রৎস’ মানে যে নড়াচড়া করে না৷ গ্রৎস> অর্দ্ধমাগধীতে ‘গচ্ছ’ > পুরোনো বাংলায় ‘গচ্ছা’ > বর্তমান বাংলায় ‘গাছ’৷ বারশ’ বছরের পুরোনো বাংলা কবিতায় আছে–
‘‘ওগগ্র ভত্তা রম্ভা পত্তা গাইক্ক ঘিত্তা দুগ্ধ সজত্তা৷
নালি গচ্ছা মুল্লা মচ্ছা দীজ্জই কন্তা খাএ পুণ্যবন্তা৷’’
মানে হচ্ছে গরমাগরম ভাত, যা’ পরিবেশন করা হয়েছে কলার পাতায়, তার সঙ্গে রয়েছে গরম গাওয়া ঘি ও জ্বাল দেওয়া ঘন দুধ, নাল্তে শাক আর রয়েছে মৌরালা মাছ৷ কান্তা দিচ্ছেন, আর পুণ্যবান খাচ্ছেন৷ লক্ষণীয় যে বারশ’ বছরের আগেকার ব্যাঙালীর খাদ্য সম্পর্কে রুচি আজও পাল্টায় নি৷ এক্ষেত্রে আর একটি জিনিস তোমরা লক্ষ্য করেছ কি? এতে যখন মাছের উল্লেখ রয়েছে তখন ধরে নিতে হবে যে লেখক যদি বঙ্গ–ডবাকের হয়ে থাকেন, তবে তিনি মাছ বলতে সরষে বাটা দিয়ে মাছের ঝালকে বোঝাতে চেয়েছেন৷ আর যদি তিনি কলকাতা অঞ্চলের লোক থেকে থাকেন তাহলে তিনি ধনে–জিরে–মরিচ বাটা দেওয়া ঝোলকে বোঝাতে চেয়েছেন৷ আর তিনি যদি রাঢ়ের মানুষ থেকে থাকেন তাহলে তিনি নিশ্চয়ই পাকা তেঁতুল দিয়ে তৈরী মাছের টক অর্থাৎ অম্বলকে বোঝাতে চেয়েছেন৷ কারণ রাঢ়ের মানুষ পাকাল মাছ পেলে টক রেঁধে খায়৷ কলকাতার মানুষ খায় মাছের ঝোল আর বঙ্গ–ডবাকের মানুষ খায় মাছের ঝাল৷
কিন্তু এমন একটি উৎকৃষ্ট খাদ্য–তালিকায় ডালের উল্লেখ নেই৷ না আছে রাঢ়ের মন–মাতানো বিরি কলাইয়ের কথা, না আছে নদীয়ার প্রাণ–তাতানো সোণা মুগের কথা, না আছে বরিশালের লঙ্কা–বাটা দেওয়া মুসুর ডালের কথা৷ তবে ব্যাপারখানা কী? বাঙলার মানুষ কি ডাল খেত না? প্রাচীন বাঙলার মানুষ হয়তো ডাল খেত, হয়তো বা ডাল খেত না৷ কিন্তু সাহিত্যে তার উল্লেখ নেই এমনকি বাংলা সাহিত্যে শিবের মুখ দিয়ে বলানো হয়েছে–
‘‘শাক নাই, শুক্তো নাই, ব্যঞ্জনও নাই৷
চাউল বাড়ন্ত, তবে ফ্যান–ভাত চাই৷৷’’
অর্থাৎ সেখানেও ডালের কথা নেই৷ বাংলা সাহিত্যে ডালের উল্লেখ পাওয়া যায় অনেক পরে–পাঠান আমলের গোড়ার দিকে৷ তখনকার ব্যাঙালী মুগ–ডাল দিয়ে তৈরী মুগ–শাউলি খেত৷ মুগ–শাউলির সঠিক পাক প্রণালী আধুনিক সৈরিন্ধ্রীদের জানা নেই৷ তবে অনুমিত হয় খোসা–ছাড়ানো গোটা মুগ দুধে সেদ্ধ করে তাতে চীনী, লবঙ্গ, তেজপাতা আর ভাজবার জন্যে কিঞ্চিৎ ঘৃত সহযোগে প্রস্তুত করা হত৷ সেকালে কতকটা অনুরূপ ভাবেই প্রস্তুত হ’ত মুগখণ্ড৷ মিষ্টান্ন হিসাবে মুগের বরফির ব্যবহার তখনও সম্ভবতঃ প্রচলিত হয় নি৷ শিউরীর (শিবপুরী>শিবৌরী)৷ ভুল করে ‘স’, ‘ড়’ ব্যবহার করা হয়৷ ইংরেজী নাম স্যুরী–Suri) কারিগরেরা সেখানকার সুপ্রসিদ্ধ মোরব্বা তৈরী করতে শুরু করেছিল আজ থেকে অনুমিত চারশ’ বছর আগে৷ সেখানকার মুগের বরফিও সম্ভবতঃ সেই সময় থেকে তৈরী হতে থাকে৷ সেখানকার শিউরী ছিল বীরভূমের একটি ক্ষৃহৎ শিক্ষিত ব্রাহ্মণদের গ্রাম মাত্র৷ সে যুগে বীরভূমের প্রাণকেন্দ্র ছিল অধুনা ধ্বংসপ্রায় রাজনগর৷ হ্যাঁ, ডালের কথায় আসা যাক৷ প্রাচীন বাঙলায় ডালের ব্যবহার থাক বা না থাক, ডাল জনপ্রিয় খাদ্য যে ছিল না এতে কোন সন্দেহ নেই৷ তবে শাক, সেকালকার বাংলায় ‘গচ্ছা’ অবশ্যই জনপ্রিয় ছিল৷ গিমা শাক, তিতা শাক, হেলেঞ্চা শাক (কলকাতার বাংলায় হিঞ্চে শাক) প্রভৃতি খাদ্য হিসেবে ব্যাপকভাবে ব্যবহূত হত৷ এই সকল শাকের নামগুলির কোনটি সংস্কৃত–জাত তদ্ভব, কোনটি বাংলা দেশজ৷ নটে শাক (সং–‘তণ্ডুলেরক’ চাল ধোয়া জল পচে আপনা থেকেই এই শাক জন্মায়৷ তাই এর নাম ‘তণ্ডুলেরক’), ডেঙ্গো ডাঁটা (যে ডাঁটার চাষ ডাঙ্গা জমিতে হয়)–এগুলি দেশজ বাংলা শব্দ৷ নালতে শাক (সং–‘নালিতা’৷ মৈমনসিং জেলার নালিতাবাড়ি গ্রামের নামের মানে হচ্ছে যেখানে প্রচুর পরিমাণে নাল্তে শাক পাওয়া যায়), পুনকো (সং–‘পুণ্যকা’ বর্দ্ধমানের বিখ্যাত মিষ্টি শাক) হিঞ্চে (রাঢ়ে ‘হেলেঞ্চা’ সংস্কৃতে ‘হিলমোচিকা’), বেথো শাক (সং–‘বাস্তুক’), কলমী (সং–‘কলম্বী’), পুঁই (সং–‘পুতিকা’, ‘পোতকী’, পোতিকা/উপদীকা/অমৃতবল্লরী বৈদিক ভাষায়–‘‘পোতক্যুপদীকা স্বাতু মানবামৃতবল্লরী’’), পালঙ (সং–‘পালঙ্ক্যা’), শুশনী (সং–‘শিখী’), থানকুনি (সং–‘ব্রাহ্মী’) প্রভৃতি সংস্কৃত–জাত তদ্ভব৷ পালঙ শাক সম্বন্ধে কারও কারও ধারণা, শাকটি বুঝি বিদেশাগত৷ না, এটা ঠিক নয়৷ পালঙ শাক এদেশেরই৷ প্রাচীন সংস্কৃতে এর উল্লেখ আছে৷ আয়ুর্বেদে বলা হয়েছে–
‘‘পালঙ্ক্যা মধুরা স্বাদু শ্লেষ্মলা হিতকারিণী৷
বিষ্টম্ভিণী মদশ্বাস–পিত্তরক্ত৷৷’’
অর্থাৎ কিনা পালঙ শাক খেতে মিষ্ট, সুস্বাদু, একটু শ্লেষ্মা বাড়ায়, শরীরের ওপর এর হিতকর প্রভাব রয়েছে ও কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করে, হূদরোগের উপশম ঘটায়, পিত্তরক্ত রোগের ঔষধি ও বিষক্রিয়া নাশক৷ এই ‘পলঙ্ক্যা’ শব্দ থেকে হিন্দীতে ‘পালক’ ও অঙ্গিকাতে ‘পালকী’ শব্দটা এসেছে৷ ফরিদপুর জেলার বিখ্যাত পালঙ্ গ্রামের সঙ্গে কিন্তু পালঙ শাকের কোন সম্বন্ধ নেই৷ দক্ষিণ বিক্রমপুরের অন্তর্ভুক্ত এই গ্রামের মানুষেরা এককালে খুব অতিথিবৎসল বা অতিথি পালনকারী ছিলেন–এই অর্থে গ্রামটির নাম হয়ে দাঁড়িয়েছিল পালঙ্ক্যা যা’ পরবর্তীকালে হয়ে দাঁড়িয়েছে ‘পালঙ’৷ যাই হোক, দেখা যাচ্ছে শাকও তুচ্ছ নয়৷ শাককে কেন্দ্র করে একটা সাহিত্য গড়ে উঠতে পারে৷ কিন্তু এখানে আমাদের আলোচ্য বিষয় ছিল ‘গচ্ছা’ শব্দটি৷ প্রাচীন বাংলায় এই ‘গচ্ছা’ শব্দটি থেকে বর্তমান বাংলায় ‘গাছ’ শব্দটি এসেছে৷