প্রাউটের পঞ্চম মৌলিক সিদ্ধান্ত নিম্নরূপ ঃ---
‘‘দেশ কাল পাত্রৈঃ উপযোগাঃ পরিবর্ত্তন্তে,
তে উপযোগাঃ প্রগতিশীলাঃ ভবেয়ুঃ৷’’
---দেশ-কাল-পাত্রের পরিবর্ত্তন অনুযায়ী সমগ্র উপযোগ নীতির পরিবর্ত্তন হতে পারে আর এই উপযোগ হবে প্রগতিশীল স্বভাবের৷
এই সিদ্ধান্তের একটা নির্দিষ্ট বিশেষত্ব আছে৷ এখন দেখা যাক কোথায় এর বিশেষত্ব৷ এই বিশ্বের সৰকিছুই পরিবর্তননীল৷ স্থান-কাল-পাত্র এই আপেক্ষিক তত্তও পরিবর্তননীল৷ মানুষ ও সমাজ সহ সৰ কিছুই স্থান ও কালের পরিধির মধ্যে অবস্থান করছে৷ যদি দেশ ও কালের পরিধি হ্রাস করা হয় তাহলে স্থান, কাল, পাত্রের মধ্যে যথাযথ সামঞ্জস্য বিধান করে নিতে হবে৷ যদি এই সামঞ্জস্য বিধান না করা হয় তবে মানুষের অস্তিত্ব রক্ষা করাই অসম্ভব হয়ে উঠৰে৷
পরিবর্ত্তনই হলো প্রকৃতির নিয়ম৷ যদি কোন তত্ত্ব এই নীতির সঙ্গে সামঞ্জস্য না রেখে চলে তবে তা অবধারিত ভাবে নিশ্চিহ্ণ হয়ে যায়৷ অতীতের ৰহু তত্ত্ব, আদর্শ ও তথাকথিত ধর্ম পরিবর্তিত পরিস্থিতির সঙ্গে সামঞ্জস্য বিধানে অসমর্থ হওয়ায় নিশ্চিহ্ণ হয়ে গেছে৷ দৃষ্টান্তস্বরূপ তাঞিক, বামমার্গী বা দক্ষিণ মার্গী, যাই হোক না কেন, সমাজে বিশেষভাবে সম্মানিত হতেন৷ ৰাঙলায় যখন বৌদ্ধদের প্রভাব চলছিল এই তান্ত্রিকগণ সাধনার সময় ‘তঞচত্রু’ নামে বিশেষ এক প্রতীকের ওপর বসতেন---যেহেতু এই সাধকগণ ওই চক্রে বসতেন তাই এদের চক্রবর্তী পদবী দিয়ে সম্মানিত করা হয়েছিল৷ স্থান ও কালের পরিবর্ত্তনে চক্রবর্তী পদবী আর তেমন সম্মানের পরিচয় বহন করে না৷ মানুষ এখন চক্রবর্তী পদবীর তেমন বিশেষ কোন গুরুত্ব বা মর্যাদা দেয় না৷’’
স্থান ও কালের পরিবর্তন হচ্ছে, এই পরিবর্তনের সঙ্গে প্রাউট সামঞ্জস্য বিধান করে চলৰে৷ প্রাউটের মূল নীতির কোন পরিবর্তন হবে না বরং পরিবর্তিত পরিস্থিতির সঙ্গে প্রাউটের প্রয়োগ-বিধি সামঞ্জস্য বিধান করে চলৰে৷ স্থান ও কালের পরিবর্তনের স্বীকৃতি-দান ও তার সঙ্গে সামঞ্জস্য বিধান করে মানুষকে সম্মুখ পানে এগিয়ে চলতে হৰে৷ সামঞ্জস্য বিধান ও নমনীয়তা মানব প্রগতির জন্যে অপরিহার্য!
আরও কয়েকটি উদাহরণ নিয়ে দেখা যাক৷ অতীতে মানুষ দল বেঁধে পুণ্যম্নানে গঙ্গায় যেত৷ কিন্তু বর্তমানে তেমনটি আর বিশেষ দেখা যায় না৷ অতীতে যখন পরিবারে কোন সংকট দেখা দিত তখন ৰাৰা-মা তাদের সর্বকনিষ্ঠ সন্তানকে গঙ্গায় বিসর্জন দিত৷ তারা বিশ্বাস করত, সর্বকনিষ্ঠ সন্তানকে গঙ্গায় বিসর্জন দিলে বিপদের হাত থেকে তারা রক্ষা পাৰে৷ এখন কোন মা-ৰাৰা এইভাবে সন্তান বিসর্জন করে না৷ এমন কি এ ধরণের কথা শুণলেও শিহরিত হয়ে উঠে৷ মানুষ অতীতের এইসৰ প্রথা আর মানছে না, মানতে রাজী নয়৷ এই হল সমাজের নমনীয়তার লক্ষণ৷ যদি পুরোণো কোন প্রথাকে নির্বিচারে কোন সমাজ অনুসরণ করতে থাকে তবে সে সমাজ তার গতি হারিয়ে ফেলৰে ও নিশ্চিহ্ণ হয়ে যাৰে৷
কোনো এক ‘ধর্ম-শাস্ত্রে’ লেখা আছে সুদে টাকা খাটানো পাপ৷ যদি জনগণ এই নীতি কঠোরভাবে মেনে চলে তাহলে ব্যাঙ্ক ব্যবস্থাকে ৰাতিল করতে হয়৷ আর তাতে গোটা সমাজকে তার জন্যে ভুগতে হবৰে৷ ঠিকভাবে সরকার পরিচালনা করতে গেলে নেতাদের হয় এই নীতি লঙ্ঘন করতে হবৰে আর তা না করে’ যদি তাঁরা তাঁদের ধর্মমতের ওই নির্দেশ অনুসরণ করেন তাঁরা ভাবজড়তার dogma) দ্বারা প্রেষিত হচ্ছেন৷ এই সৰ ভাবজড়তাকে যাঁরা আঁকড়ে ধরে রাখৰেন আধুনিক যুগে তাঁরা পরিত্যক্ত হবেন৷ বর্তমান বিশ্বে প্রায় সমস্ত তথাকথিত ধর্মমতকেই এ জাতীয় উভয় সঙ্কটের মধ্যে পড়তে হচ্ছে৷
যদি হিন্দুরা তাদের বর্ণপ্রথা কঠোরভাবে মেনে চলেন তবে তাঁরাও সমাজের ক্ষতি করৰেন৷ অতীতে হিন্দু বিধবাগণ মোটা শাদা থান-কাপড় পরতেন ও চুল ছোট ছোট করে কাটতেন৷ কিন্তু বর্তমানে বিধবাগণ আর তা মানেন না৷ আজকাল যদি তোমরা কেউ কোন বিধবা মহিলাকে এই ধরণের প্রথা মানৰার জন্যে ৰোঝাৰার চেষ্টা কর তাহলে তোমরা অপমানিত হবৰে৷ সুতরাং প্রতি ক্ষেত্রেই স্থান, কাল, পাত্রের মধ্যে সামঞ্জস্য বিধান করে চলতে হৰে৷ যদি কোন মানুষ স্থান-কাল-পাত্রের সঙ্গে সামঞ্জস্য বিধান করে না চলেন তাহলে নিঃসন্দেহে তার ঠাই হবে সেকেলের দলে৷
প্রায় ১৫০ বছর আগে কার্লমার্কস সমাজের শোষণ ও বৈষম্য লক্ষ্য মূল কারণ৷ তাই তিনি ভাবলেন, সমাজে যদি ব্যষ্টিগত আয় না থাকে ও জনগণ যদি ‘কমিউনে’ এক সঙ্গে বাস করে আর সরকার যদি খাদ্য, বস্ত্র সরবরাহ করতে থাকে তাহলে সমাজে কোন অবিচার থাকৰে না৷ কিন্তু সত্যিই কি কমিউনিষ্ট দেশগুলোর সামাজিক-অর্থনৈতিক সমস্যাগুলির সমাধান হয়েছে?
এই কমিউন ব্যবস্থায় দক্ষ বা বিশেষ গুণসম্পন্ন বুদ্ধিমান মানুষও অতি সাধারণ মানুষের সমান আয় করে৷ সেখানে কঠোর পরিশ্রমের জন্যে উৎসাহ দান বা কোন বিশেষ সুবিধা দানের (ইনসেন্টিব) ব্যবস্থা নেই৷ সৰাইকে একই মজুরী বা বেতন দেওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে স্বভাবতই কাজের মূল্য সম্পর্কে সেখানে মানুষের মনে প্রশ্ণ জাগছে৷ এমতাবস্থায় কোন মানুষই তার পূর্ণ ক্ষমতাকে কাজে লাগাৰে না ও প্রতিভাবানের প্রতিভাও প্রকাশের সুযোগ পাৰে না৷ রাজা ভোজ যিনি অত্যন্ত জ্ঞানী ও বুদ্ধিমান ছিলেন তিনি তার রাজসভায় যদি একজন মূর্খের সমান মর্যাদা পেতেন তাহলে তার রাজ্যই চৌপট হয়ে যেত৷ কম্যুনিষ্ট দেশে এটাই হয়েছে ও হচ্ছে৷ তাই কমিউনের উৎপাদন-ব্যবস্থায় ব্যষ্টিগত উৎসাহ ও উদ্যোগকে কাজে না লাগানোর ফলে ও প্রতিভাবানদেরও উৎসাহ দানের ব্যবস্থা না থাকার ফলে এই নীতি আজ এক অবাস্তব নীতি ৰলে প্রমাণিত হয়েছে৷ এটাই কমিউন ব্যবস্থার ব্যর্থতার প্রধান কারণ৷ রাশিয়া তার জনগণের ক্ষমতা ও যোগ্যতাকে ঠিকভাবে কাজে লাগাতে পারছে না৷ তাই আজ জনগণের ভরণ-পোষণের নিমিত্ত যথেষ্ট কৃষি-জমি থাকা সত্ত্বেও কানাডা, আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র বা অস্ট্রেলিয়ার মত ধনতান্ত্রিক দেশ থেকে রাশিয়াকে গম ত্রয় করতে হচ্ছে৷ কমিউন-ব্যবস্থার প্রয়োগ বিধি আজ অচলাবস্থায় এসে পৌছেছে ও একরকম হিষ্টিরিয়াগ্রস্ত হয়ে পড়েছে৷ কমিউনিষ্টরা সমস্ত যুক্তি বিচার ভুলে আজ হিষ্টিরিয়া রোগীর মতই চিৎকার করে বেড়াচ্ছে৷ তাদের আশা, মানুষ ভয় পেয়ে তাদের অনুসরণ করৰে৷ যুক্তির পথ ধরে চলতে গেলে বৌদ্ধিক নমনীয়তা অত্যাবশ্যক৷ যখন এই নমনীয়তার অভাব দেখা দেয় তবে শুন্যগর্ভ চিৎকারে ঢাকা পড়ে যায় যুক্তিপূর্ণ ভাবনা৷
আজকের দিনে কি ধর্মমত, কি বিজ্ঞান, কি সমাজ সর্বত্রই এই নমনীয়তার অভাব দেখা দিয়েছে৷ বিজ্ঞানে ডাল্টনের পরমাণুবাদ ইতোমধ্যে অচল হয়ে পড়েছে৷ অনেক ক্ষেত্রেই নূতন নূতন মতবাদ এসে পুরোনোকে সরিয়ে দিয়েছে৷ অন্যান্য ক্ষেত্রেও এই পরিবর্তনের হাওয়া লেগেছে৷ উদাহরণ স্বরূপ রসায়ন বিজ্ঞানের কথাই ধার যাক৷ যদি দুটো কোম্পানীর একই লবণ নিয়ে এসে পরীক্ষা চালানো হয়, দেখা যাবে কোথাও না কোথাও পার্থক্য বা স্ব-বিরোধিতা দেখা দিচ্ছে, এর মূল কারণ হ’ল দুই কোম্পানীর লবণে মাইক্রোবাইটামের সংখ্যার পার্থক্য রয়েছে৷ মাইক্রেবাইটাম তত্ত্ব দেশ ও কালের সঙ্গে বিজ্ঞানের সামঞ্জস্য এনে দেৰে৷
পরিবর্ত্তন যেমন প্রাকৃতিক নিয়ম, আকর্ষণ হ’ল তেমনি প্রাকৃতিক নিয়ম৷ বস্তুতে বস্তুতে যেমন আকর্ষণ আছে তেমনি আবার ব্যষ্টিতে ব্যষ্টিতেও পারস্পরিক আকর্ষণ রয়েছে৷ এটাই স্বাভাবিক৷ যদি অন্ধকার রাতে কোন মানুষ জঙ্গলে হারিয়ে যায় ও হঠাৎ টর্চের আলো দেখতে পায়, তবে ওই টর্চধারী চোর বা খুনী কিনা---এসব না ভেবেই তার সমীপবর্তী হৰে৷ অপরদিকে টর্চধারী লোকটিও জঙ্গলে হারিয়ে যাওয়া লোকটির চরিত্র বিচার শুরু করবে না৷ বরং ভাবৰে ওই লোকটিকে নিরাপদ জায়গায় পৌছে দেওয়াই তার কর্তব্য৷ এটা হ’ল মানুষের পারস্পরিক আকর্ষণের একটি জ্বলস্ত দৃষ্টান্ত৷
অন্য উদাহরণও দেওয়া যেতে পারে, কেউ কেউ ভাবেন মানুষের মত পণুরা তাদের সন্তানদের ততটা ভালবাসে না৷ কিন্তু এটা ঠিক নয়, পশুরাও তাদের সাধ্যানুযারী তাদের সপ্তানকে ভালবাসে৷ দেশ-কালল-পাত্র ভেদে মানুষের ভালবাসাতেও পার্থক্য দেখা দেয়৷ মা তার ছেলেকে প্রাণ দিয়ে ভালবাসে৷ কিন্তু যখন ছেলে বিয়ে করে ও মা দেখেন তার ভালোবাসায় অনেকটাই পুণবধূ ছিনিয়ে নিচ্ছে তখন মায়ের ভালবাসায় কিছুটা ভাঁটা পড়ে৷ এই ক্ষতি পুরণ করতে মা তখন অবিবাহিত অন্য ছেলে মেয়েদের অধিক ভালবাসতে শুরু করে৷ এর পেছনে মনস্তত্ব হ’’ল, স্বার্থপরতা বৃদ্ধি পেতে থাকলে মানুষের মধ্যে পারস্পরিক আকর্ষণ হ্রাস পেতে থাকে৷
আমাদের অবশ্যই এই ভালবাসা বা আকর্ষণের ক্ষেত্রকে বৃদ্ধি করতে হবৰে৷ আমাদের এই ভালবাসা পশু-পাখী-উদিদ সৰার মাঝে ছড়িয়ে দিতে হবে৷ এদের প্রত্যেকেরই প্রাণ আছে---প্রত্যেকেরই আছে অনুভূতি৷ আমাদের ভাবতে হৰে, আমার যেমন অনুভূতি আছে সৰার তেমন অনুভূতি আছে৷ কেউ পর নয়, সৰাই আপন৷ এই ৰোধ নিয়ে সমস্ত প্রাণীন এমন কি অপ্রাণীন সত্তাকেও আপন করে নিতে হয়, এটাই হল নব্যমানবতাবাদ৷ আর এই নব্যমানবতাবাদ মানব মনের সার্বিক উন্নয়নের জন্যে অপরিহার্য৷
সুতরাং মানুষ সহ সমস্ত সৃষ্টির প্রতি কল্যাণ ভাবনার ধারা-প্রবাহকে অব্যাহত রাখতে আমাদের এমন এক তত্ত্ব গ্রহণ করতে হৰে যাতে রয়েছে নমনীয়তা ও স্থিতিস্থাপকতা৷ ইলাষ্টিকের বন্ধনী দেওয়া কোন পোষাকের বন্ধনের নমনীয়তা যখন আর থাকে না তখন সে পোষাক পরিত্যক্ত হয়৷ তেমনি কোন বজায় রাখতে না পারে তাও পরিত্যক্ত হয়ে যায়৷ কোন নীতির প্রয়োগ বিধি policy) দেশ-কাল-পাত্রের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে পরিবর্তন. করতে হৰে৷ কিন্তু মূল নীতি principle)-গুলি অপরিবর্তনীয় থাকৰে৷ কারণ, তা সর্বনুস্যুত ও এগুলির সাক্ষী সত্তা সর্বজ্ঞানের আধার৷
বর্তমানে এই পরিবর্তনের যুগে তোমরা তোমাদের চোখের সামনে দেখছো বহু তত্ত্ব পরিবর্তিত ও পরিত্যক্ত হয়েছে৷ যদি কেউ অতীতের কঙ্কালকে জড়িয়ে ধরে থাকে, তাহলে সেও সমাজে পরিত্যক্ত হয়ে যাৰে৷ বুদ্ধিমান মানুষ পুরাতন সেকেলে চিন্তা-ভাবনাকে জড়িয়ে ধরে থাকৰে না বরং যে তত্ত্ব দেশ-কাল-পাত্রের সঙ্গে সামঞ্জস্য বিধান করে’’ শ্বাশ্বত কালের জন্যে টিকে থাকৰে সেই তত্ত্বকেই তারা আলিঙ্গন করৰে৷ (কলিকাতা, ১৬ই মার্চ, ১৯৮৮)