প্রগতিশীল সমাজতন্ত্র

Baba's Name
শ্রী প্রভাতরঞ্জন সরকার

এ পৃথিবীতে পুরোপুরি স্ব–নির্ভর কেউ নয়৷ প্রত্যেকেই কোন না কোন ভাবে অন্যের ওপর নির্ভরশীল৷ প্রত্যেকেই নিজের অপূর্ণতা অন্যের কাছ থেকে সাহায্য নিয়ে পূরণ করে’ নেয়৷ যখনই কোন বিরাট জনগোষ্ঠী এইভাবে পারস্পরিক বোঝাপড়ার মাধ্যমে নিজেদের অপূর্ণতা পূর্ণ করার চেষ্টা করে, তখনই তাকে আমরা ‘সমাজ’ বলে’ থাকি৷ সামবায়িক প্রচেষ্টার দ্বারা সমস্ত সমস্যার সমাধানের মধ্যেই যথার্থ সমাজ প্রতিষ্ঠার তাৎপর্য্য৷ 

‘সমাজ’ শব্দটার ভাবগত অর্থ হ’ল–একসঙ্গে চলা৷ অর্থাৎ সমাজের প্রাণ সত্তা নির্ভর করছে দুটো তত্ত্বের ওপর৷ প্রথমটা হচ্ছে, তার অস্তিত্ব–একটা সামবায়িক সৃষ্টি আর দ্বিতীয় জিনিসটা হচ্ছে এই যে, তার মধ্যে একটা গতি থাকতেই হবে৷

ব্যষ্টি জীবনের চলার ধর্ম যেখানে সমষ্টির চলার ছন্দকে বিড়ম্বিত করে’ দেয় না, সেখানে এই বহু ব্যষ্টির মিলিত চলার মধ্যেই থেকে যায় সমাজ সৃষ্টির সম্ভাবনা৷

‘সমান্ম্ এজতি ইতি সমাজঃ’–অর্থাৎ সবাই মিলে যখন  ঠিক করলে যে তারা একসঙ্গে চলবে, সুখে দুঃখে একসঙ্গে থাকবে, তখন তাদের মিলিত নাম হ’ল সমাজ৷৩এ যেন একদল পথচারী–যারা তীর্থযাত্রায় চলেছে৷ এইভাবে একসঙ্গে চলতে গিয়ে মানুষের মধ্যে সহযোগিতা মূলক মানসিকতা জাগে–তা মানুষের মনকে ব্যপ্তির পথে নিয়ে যায়, তাদের মনের নীচতা–হীনতার বাধাগুলি চূর্ণ করে’ দেয়৷ সমাজ এমনই এক গোষ্ঠীবদ্ধ মানুষের তীর্থযাত্রা যেখানে সমস্ত মানুষ পারস্পরিক ভালোবাসার বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে হাতে হাত মিলিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে যাবে৷১

একটা সর্বজনগ্রাহ্য আদর্শের দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে যখন বিভিন্ন ব্যষ্টি একই লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে যায়, ও তাকে পাবার জন্যে সক্রিয় হয়ে ওঠে তখনই তা ‘সমাজ’ পদবাচ্য৷ কেবলমাত্র শেষ লক্ষ্য বিন্দু থাকলেই চলবে না, একটা প্রারম্ভিক বিন্দুও থাকতে হবে–যা সব সময় আমাদের সঞ্জীবনী শক্তি যুগিয়ে যাবে৷

নীতিবাদের স্ফুরণ থেকে বিশ্বমানবত্বে প্রতিষ্ঠা–এ দুয়ের মাঝখানে রয়েছে যেটুকু অবকাশ–তাকে অতিক্রম করবার যে মিলিত প্রয়াস, তারই নাম সামাজিক প্রগতি৷ আর যারা মিলে মিশে চেষ্টা করে’ এই অবকাশটুকু জয় করবার প্রয়াসে রত হয়েছে, তাদেরই নাম দোব একটা ‘সমাজ’৷

যারা জাতপাত, জাতিবাদ, প্রাদেশিকতাবাদ, সঙ্কীর্ণতাবাদ, জাতীয়তাবাদ এমনকি আন্তর্জাতিকতাবাদকে সমর্থন জানায় তারা বৃহত্তর মানব সমাজের শত্রু৷ মানুষের সমাজ কেবল মাত্র একটি ‘ইজ্ম্’–এর ওপরেই আধারিত হওয়া উচিত৷–আর সেই ‘ইজ্ম্’ হ’ল Universalism বা ‘বিশ্বৈকতাবাদ’৷

বিনা দ্বিধায় বলতে হয় যে এখনও পর্যন্ত মানুষ যথাযথ ভাবে সমাজ জিনিসটা গড়তে শেখেনি৷ গড়া তো দূরের কথা, সমাজ জিনিসটার প্রয়োজনীয়তা আজও তার কাছে আব্ছা, ধোঁয়াটে রয়ে গেছে৷২ তীর্থ যাত্রীর মতো যথার্থ মানসিকতা নিয়ে একসঙ্গে চলতে শেখেনি৷

তোমরা সামগ্রিক জীবনে, সামূহিক জীবনে কড়া নজর রাখবে–কেউ যেন উপেক্ষিত না হয়, কেউ যেন বঞ্চিত না হয়৷ এ কথাটা মনে রাখার মধ্যেই সমাজের পরিস্ফূরণের বীজ নিহিত রয়েছে৷ অন্যের স্বার্থের কথা ভাববে সব সময়ে৷৫সকলকেই এমন সুযোগ দিতে হবে, বা এমন অনূকূল পরিবেশ তৈরী করতে হবে যাতে কেউ যেন ভাববার সুযোগ না পায় যে, তার ভাগ্য চিরকালের জন্যে অবরুদ্ধ হয়ে গেল৷ সকলেই যেন অনুভব করে যে, এ পরিদৃশ্যমান বিশ্বের সকলে এক বৃহত্তর মানব পরিবারের সদস্য৷

মানব সমাজ এক ও অবিভাজ্য৷ মানুষে মানুষে কোন মূলগত পার্থক্য নেই৷ সকল মানুষই তার সঞ্জীবনী রস ও জীবনীশক্তি পেয়ে চলেছে সেই এক অদ্বিতীয় উৎস থেকে৷ তাই বিচ্ছিন্নতাবাদী মনোভাব ও বৈষম্যের কথা মানবতা বিরোধী৷

আমাদের এই যে যুগ–এটা হ’ল নব্যমানবতাবাদের যুগ–যে যুগে মানবতাবাদ সকল জীবের জন্যেই প্রাণরস যুগিয়ে যাবে৷ আমরা সকলের জন্যেই, আর সবাইকে নিয়েই আমাদের একটা নোতুন সামাজিক সংরচনা–নব্যমানবতাভিত্তিক  একটা নোতুন সমাজ গড়ে’ তুলতে হবে৷

পারস্পরিক সহযোগিতার ভিত্তিতে যতখানি সমস্যার সমাধান করা হবে, সমাজের পক্ষে তা ততখানিই কল্যাণকর৷ মনে রাখতে হবে, এ ব্যাপারে অধিকার ও দায়িত্ব সকলের সমান৷ অধিকার ও দায়িত্ব সম্বন্ধে চেতনার অভাব সামাজিক জীবনে মানুষকে বিপর্যয়ের দিকে ঠেলে দেয়৷

আলো–হাওয়া–জলের মত জাগতিক প্রতিটি সম্পদই জীবমাত্রেরই সাধারণ সম্পত্তি, কোনটাই কারও ব্যষ্টিগত বা পৈত্রিক সম্পত্তি নয়৷ প্রকৃতিদত্ত সম্পদ সবাইকার মিলে–মিশে ব্যবহারের জন্যে, কারও এতে মৌরসীমোকররী পাট্টা নেই৷

প্রকৃতি বিশ্বের কোন সম্পত্তিই ব্যষ্টি বিশেষের নামে লেখাপড়া করে দেন নি৷ ব্যষ্টিগত মালিকানার সৃষ্টি করেছে স্বার্থপর সুবিধাবাদী মানুষেরা, কারণ এই ব্যবস্থার রন্ধ্রপথে তারা অন্যকে শোষণ করে’ নিজেদের স্ফীতদোর করবার সুযোগ পায়৷

এ জগতের মূল উপাদান মানুষ তৈরী করতে পারে না৷ জড় থেকে উৎসারিত তরঙ্গকে নিয়েই আমাদের কারবার৷ আমরা তার রূপগত পরিবর্ত্তন করে’ ভৌতিক হ্মড়ম্ভব্দন্ন্তুত্রপ্ত্ মিশ্রণ বা রাসায়নিক যৌগ তৈরী করি মাত্র৷ তাই জগতের সকল সম্পদের মালিকানা স্বত্ব কেবলমাত্র ব্রহ্মেরই আছে–ব্যষ্টিগত কারও নেই৷

এ বিশ্বজগৎ আমাদের সকলকার পৈত্রিক সম্পত্তি৷ আমরা সকলে এক বিশ্বভিত্তিক যৌথ পরিবারের সদস্য৷ পরম পুরুষ আমাদের পিতা৷ যৌথ পরিবারের সদস্যদের মতই আমাদের উচিত ‘নিজে বাঁচ ও অপরকে বাঁচাও’ নীতি নিয়ে চলা৷ বিশ্বের ব্যবহূত সমস্ত সম্পদ কোন বিশেষ ব্যষ্টি, রাষ্ট্র বা জাতির সম্পত্তি নয়৷ সকলের কেবল এই সম্পদ ভোগ করবার অধিকার আছে মাত্র৷ এই ‘ভূমা–উত্তরাধিকার’ মেনে নিয়ে যাবতীয় লোকায়ত ও লোকত্তর সম্পদের সদ্ব্যবহার আমাদের করতে হবে৷ এটাই আমাদের সামাজিক ধর্ম৷ কেবলমাত্র সামাজিক বিবেচনার দিক থেকেই নয়, যুক্তি ও ন্যায় বিচারের দিক থেকেও এটাই একমাত্র পথ৷ এটাই যথার্থ সমাজদর্শন৷

যথার্থ সমাজদর্শনের পঞ্চ–মূল প্রয়োগভৌমিক সিদ্ধান্ত

  1. কোন ব্যষ্টিই সামবায়িক সংস্থার (collective body) সুস্পষ্ট অনুমোদন ছাড়া ভৌতিক সম্পদ সঞ্চয় করতে পারবে না৷
  2. বিশ্বের যাবতীয় জাগতিক, মানসিক ও আধ্যাত্মিক সম্পদের সর্বাধিক উপযোগ গ্রহণ করতে হবে, ও যুক্তিসঙ্গত বণ্ঢন করতে হবে৷
  3. মানব সমাজের মধ্যে ব্যষ্টিগত ও সমষ্টিগত যত প্রকার আধিভৌতিক, আধিদৈবিক ও আধ্যাত্মিক সম্পদ আছে, সব কিছুরই সর্বাধিক উপযোগ গ্রহণ করতে হবে৷
  4. জাগতিক, মানসিক, আধিভৌতিক ও আধ্যাত্মিক উপযোগ সমূহের মধ্যে সুনির্দিষ্ট বিবেচনা ও সামঞ্জস্য থাকা অবশ্য প্রয়োজনীয়৷
  5. দেশ–কাল–পাত্রের পরিবর্ত্তন অনুযায়ী সমগ্র উপযোগ নীতির পরিবর্ত্তন হতে পারে, আর এই উপযোগ হবে প্রগতিশীল স্বভাবের৷