পরিবেশ বিজ্ঞানকে Ecology) মানুষ স্বার্থের প্রেষণায় প্রতি পদে উপেক্ষা করে চলেছে৷ আমাদের মনে রাখা দরকার যে আকাশ-বাতাস-পাখী-বন্যজন্তু-সরীসৃপ-কীটপতঙ্গ-মাছ- জলজজীব-জলজউদ্ভিদ- সমুদ্র সবাইকার সঙ্গে সবাইকার অচ্ছেদ্য সম্পর্ক৷ মানুষ সেই অভিন্ন মহাসমাজের একটি অংশ মাত্র৷ কাউকে বাদ দিয়ে কেউ টিকতে পারবে না৷ মানুষও পারবে না৷ নির্র্বেধের মত অরণ্য ধবংস করে, বন্য পশুকে হত্যা করে, মৎস্যকুল ও পক্ষীকুলকে নির্মূল করে মানুষের কোন স্বার্থই সাধিত হবে না৷ এ পৃথিবীতে যে আসে সে যায়--- কেবল প্রকৃতি নির্দিষ্ট একটা সময় পর্যন্ত পৃথিবীতে বেঁচে থাকে৷ মানুষের এই নির্বুদ্ধিতার জন্যে অনেক কিছুই প্রকৃতি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত বাঁচবে না৷ তার আগেই কালের অন্ধকারে হারিয়ে যাবে৷ মানুষ তার নির্ৰুদ্ধিতায় অনেক কিছুকে ধবংস করেছে ও তা করে’ সে নিজের চিতাই সাজিয়ে চলেছে৷ এই নির্বুদ্ধিতা অসহনীয়৷ এখনই মানুষকে সতর্ক হতে হবে ও পরিবেশ বিজ্ঞানসম্মতভাবে তার সমস্ত চিন্তা, কর্ম ও পরিকল্পনাকে ঢেলে সাজাতে হবে৷ অন্য কোন পথ নেই৷ হ্যাঁ, বলছিলুম যে মানুষের নিৰুর্দ্ধিতার জন্যে কেবল ইলিশ ও তোপসে মাছই নয়, অনেক কিছুকেই পৃথিবীর আলো থেকে সরে যেতে হয়েছে৷ মানুষকে এ পাপের প্রায়শ্চিত্ত করতে হবে৷ একটু আগেই ৰলছিলুম, প্রকৃতি-সৃষ্ট সবাইকার সঙ্গে সবাইকার অচ্ছেদ্য সম্পর্ক ও সবাই এক একটা প্রাকৃতিক নিয়ম মেনে চলে৷ ছোটবেলায় শুনতুম ইলিশ প্রতি তিনবছরে বেশী মাত্রায় আসে প্রতি দশ বৎসর অন্তর আরও বেশীমাত্রায় আসে প্রতি ত্রিশ বৎসর অন্তর খুব বেশীমাত্রায় আসে৷ আজ মানুষ পরিবেশ বিজ্ঞানের বিরোধিতা করায় সেই নিয়মমত কাজ হতে দেখা যাচ্ছে না৷ ইলিশের সম্বন্ধে যে নিয়ম আঁৰের (আমের) সম্বন্ধেও সেই একই নিয়ম প্রযোয্য৷ আঁৰের বাড়ানোর জন্যে মানুষ অনেক অনৈসর্গিক ব্যবস্থা গ্রহণ করায় সে নিয়মও আজ ভেঙে গেছে৷ ছোটোবেলায় আমরা শুণতুম ‘‘আমে ধান, তেঁতুলে বান’’৷ আজকাল কিন্তু এ রকম কোন ঘটনা ঘটছে না৷ ‘কোটরাবন’ বলতে ৰোঝায় যে বনে অনেক কোটরযুক্ত গাছ আছে৷ কিন্তু যোগারূঢ়ার্থে ‘কোটরাবন’ বলতে ৰোঝায় সস্তা ও অল্প কাজে লাগে এমন গাছের বন৷ যে গাছে কোটর থাকে তা ভাল কাজে লাগে না৷ ভাল আসবাবপত্রও তৈরী হয় না৷ সে কাঠ সস্তা হয়৷ আর যোগারূঢ়ার্থে ‘কোটরাবন’ বলতে সস্তা গাছের জঙ্গলকে ৰোঝায়৷ যেমন সুন্দরবন অঞ্চলের অধিকাংশ গাছই সস্তা প্রজাতির৷ ভাল বা দামী গাছ যে নেই এমন নয়, তবে তাদের সংখ্যা খুবই কম৷ তবে জলপাইগুড়ির বনাঞ্চলে বেশীর ভাগ গাছই ভাল প্রজাতির৷ বেশ কিছু সস্তা গাছও আছে৷ কিন্তু বাঁকুড়া বা পশ্চিম রাঢ়ের বনাঞ্চলের অধিকাংশ গাছই শাল বা শালবর্গীয়৷ এরা সবই খুব দামী গাছ৷ তাই সুন্দরবন অঞ্চলের একবর্গ কি.মি এলাকা থেকে যে বাৎসরিক আয় হয় জলপাইগুড়ি বনাঞ্চল থেকে তার ৮ থেকে ১০ গুণ অধিক আয় হয়৷ আবার জলপাইগুড়ি বনাঞ্চলের ১ বর্গ কি.মি. থেকে যে বাৎসরিক আয় হয় রাঢ়ের বনাঞ্চল থেকে আয় হয় তার চেয়েও দেড় থেকে দু’গুণ বেশী৷
জমিদারী প্রথা যতদিন বলবৎ ছিল রাঢ়ের জঙ্গলগুলি সুবিন্যস্ত সুরক্ষিত ছিল৷ জমিদারী প্রথা উঠে যাবার পর রাঢ়ের.......শুধু রাঢ়ে কেন সমগ্র ৰাঙলায় সরকারী অরণ্যগুলি নিঃশেষ হতে চলেছে৷ দেশে বৃষ্টিপাত কমে চলেছে......বন্যা বেড়ে চলেছে......ভূমিক্ষয় বেড়ে চলেছে.........বনগত সম্পদ হ্রাস পেয়ে চলেছে..........পশুপক্ষীর সংখ্যা কমে যাওয়ায় উদ্ভিদ,আরণ্য প্রাণী ও মানুষের ত্র্যম্বক সামঞ্জস্য নষ্ট হতে চলেছে ..........বায়ু কলুষিত হচ্ছে..........বায়ুমণ্ডলে অক্সিজেনের অনুপাতও কমে চলেছে........বাতাবরণে বিষাক্ততা বেড়ে চলেছে..........কর্কট রোগ বাড়ছে ........মস্তিষ্করোগ, হৃদরোগ ও চক্ষুরোগও বেড়ে চলেছে.......জলের স্তর নেবে চলেছে...........বাপী-কূপ-তড়াগাদির জলধারণ ক্ষমতা হ্রাসপ্রাপ্ত হয়ে চলেছে............মানুষের চিত্তভূমিতে সরসতা ও ভাবমাধুর্য ক্রমশঃ অপসৃত হয়ে চলেছে.........মানসিকতায় রুক্ষতা দ্রুত তালে বৃদ্ধি পাচ্ছে৷ হ্যাঁ, এখন আসল কথায় আসা যাক৷ মানুষকে যদি বাঁচতেই হয়, প্রাণীজগৎকে যদি বাঁচাতে হয়, বাহ্যিক সৌম্য শ্রীকে যদি অব্যাহত রাখতে হয় তবে অরণ্যকে বাঁচাতেই হবে৷ আর অরণ্য যত মূল্যবান সম্পদে আকীর্ণ থাকে মানুষ-পশু-পক্ষীর বৈয়ষ্টিক লাভ তাতে বেশী৷
(শ্রীপ্রভাতরঞ্জন সরকার রচিত আমাদের প্রতিবেশী পশু ও পক্ষী গ্রন্থ থেকে সংকলিত)