পৃথিবীতে মৌলিক জনগোষ্ঠী আছে চারটি–ককেশীয়, মঙ্গোলীয়, অষ্ট্রিক ও নিগ্রো৷ অনেকে অবশ্য সেমিটিক জনগোষ্ঠীকে এর মধ্যে ফেলতে চান না৷ তাদের মতে সেমেটিকরা আলাদা জনগোষ্টী, এরা মধ্যপ্রাচ্যের লোক৷ আবার কারো কারো মতে এরা ককেশীয় ও নিগ্রোদের বিমিশ্রণ৷ ককেশীয়দের তিনটি শাখা রয়েছে–(১) নর্ডিক (Nordic), (২) এ্যালপাইন (Alpine), (৩) ভূমধ্যসাগরীয়৷ ‘নর্ডিক’ কথাটার অর্থ হচ্ছে ‘উত্তুরে’৷ লাতিন ‘নর্ড’ (Nord) কথাটা থেকে ‘নর্ডিক’ শব্দটি এসেছে৷ এ্যালপাইনরা বেশী উত্তরেও নয়, আবার বেশী দক্ষিণেও নয় অর্থাৎ এরা মধ্যদেশীয়, আল্প্স্ পর্বতের সানুদেশের বাসিন্দা৷
নর্ডিকদের নাক উঁচু, চুল সোণালী, রঙ লাল ও আকারে দীর্ঘ৷ এ্যালপাইনরা অপেক্ষাকৃত খর্বকায়৷ এদের রঙ ততটা লাল নয়, চুল নীলচে, চোখের তারা নীল৷ আর ভুমধ্যসাগরীয়দের রঙ শাদা, চুল কালো, চোখের তারা কালো, আকারে এ্যালপাইনদের চেয়ে কিছুটা খর্বকায়৷ এই তিনের মিলিত নাম হচ্ছে আর্য (Aryan)৷ ইংরেজী ‘Aryan’ কথাটি জার্মান থেকে এসেছে৷ বৈদিক ‘আর্য’ শব্দ থেকেই ‘Aryan’ শব্দের উদ্ভব৷ যতদূর মনে হয়, ‘আর্য’ শব্দটা বৈদিক ‘ঋ’ ধাতু থেকে এসেছে যার মানে চর্চা করা বা কর্ষণ করা অর্থাৎ ‘আর্য’ শব্দের মানে দাঁড়াচ্ছে কৃষ্টি–সংস্কৃতিসম্পন্ মানুষ বা জনগোষ্ঠী৷
আর্যদের আদি বাসস্থান হ’ল ইয়ূরোপ ও রাশিয়ার মধ্যাঞ্চলে ককেশীয় পর্বতমালার সন্নিহিত এলাকায়৷ ভারতের উত্তর–পশ্চিমাঞ্চলে তথা কশ্মীরে ককেশীয় বংশোদ্ভুত মানুস যথেষ্ট সংখ্যায় রয়েছেন৷ কিন্তু অবশিষ্ট ভারতে এঁদের সংখ্যা খুবই নগণ্য৷ অল্প–বিস্তুর যা আছেন তাও বিমিশ্র অবস্থায়৷ অর্থাৎ খুঁটিয়ে খুঁজে বের করতে গেলে রীতিমত অসুবিধায় পড়তে হবে৷ ককেশীয়–কেন্দ্রিক বর্ণাভিজাত্যের একটা ভুল ধারণা মনে বাসা বেঁধে থাকার ফলে, স্পষ্ট কথা বললে অনেকেই আবার অসন্তুষ্ট হতে পারেন অর্থাৎ অসন্তোষ এড়াবার জন্যে, ক্ষুদ্রকায় মানুষকেও আর্য বলে মানতে হবে, কৃষ্ণকায়কেও আর্য বংশোদ্ভূত ৰলে মানতে হবে, অবনত নাসাকেও আর্য বলে স্বীকৃতি দিতে হবে–এ কী ধরনের কথা হ’ল আমি আমার মূল বক্তব্যে ফিরে এসে বলছি, ভারতবর্ষে এই ককেশীয় বংশোদ্ভবদের কশ্মীর ও উত্তর পশ্চিম অঞ্চল বাদে অন্যত্র না থাকারই সামিল৷ ভারতের এই ককেশীয়রা যতদূর সম্ভব বাইরে থেকে এসেছিলেন–এঁরা ভূমধ্যসাগরীয় উপশাখার অন্তর্ভুক্ত, এ্যালপাইন বা নর্ডিক নন৷ অনেকে এঁদের কশ্মীরের আদি বাসিন্দা বলে মনে করেন কিন্তু এঁরা আসলে তা নন৷ কশ্মীরের আদি বাসিন্দারা ছিলেন কশ্’ বা খশ্ উপজাতির মানুষেরা৷ এঁরা ছিলেন ঈষৎ মৃত্তিকা বর্ণের মানুষ–কিছুটা খর্বকায়, নাক কিছুটা অবনত৷
‘কশ্’ বা ‘খশ্’ শব্দ থেকেই ‘কশ্মীর’ শব্দ এসেছে৷ পুরোনো সংস্কৃতে দেশ অর্থে ‘মেরু’ শব্দ ব্যবহূত হয়ে এসেছে৷ যেমন–অজেয়মেরু>অজমীর’৷ মূল শব্দটা হচ্ছে ‘কশমেরু’৷ ‘কশ্’দের মেরু এই অর্থে ‘কশ্মেরু’৷ অনেকে ‘কশ্মীর’–এর পরিবর্তে ‘কাশ্মীর’ লিখে থাকেন৷ তা ঠিক নয়৷ ‘কশ্মীর’ শব্দের উত্তর ‘ষ্ণ’ প্রত্যয় করে ‘কাশ্মীর’ শব্দ নিষ্পন্ন হয়েছে, যার মানে কশ্মীর দেশের বাসিন্দা বা কশ্মীর দেশ সম্বন্ধীয়৷ জাফরান কশ্মীর দেশে উৎপন্ন হয়, তাই সংস্কৃতে জাফরানকে কাশ্মীর বলা হয়৷ ‘কাশ্মীর’ শব্দ থেকে হিন্দীতে ‘কেশরীয়া’ শব্দ এসেছে যার মানে গৈরিক বর্ণ৷ কশ্মীরের ব্রাহ্মণকে আমরা বলতে পারি কাশ্মীর ব্রাহ্মণ–কাশ্মীরী ব্রাহ্মণ নয়৷ ‘কাশ্মীর’ মানে কশ্মীর দেশীয়া নারী৷ কল্হনের ‘রাজতরঙ্গিনী’–তে কশ্মীর দেশের সীমানা বর্ণনা করতে গিয়ে বলা হয়েছে–‘‘সারদামঠমারভ্য কুমকুমাদ্রিতটংতক তাবৎ কশ্মীরদেশস্যাদ্ পঞ্চাশৎ যোজনাত্মকঃ৷’’ অর্থাৎ সারদামঠ থেকে কুমকুম পর্বত পর্যন্ত পঞ্চাশ যোজন পরিমিত ভুখণ্ডই কশ্মীর দেশ৷
ভারতের, বিশেষ করে সংস্কৃত ভাষায় একটি বর্ণাঢ়্য সাহিত্য রয়েছে কিন্তু ইতিহাস–সাহিত্য নেই বললেই চলে৷ দার্শনিক বিভ্রান্তির ফলেই ভারতের মানুষের মধ্যে দীর্ঘকাল ধরে ইতিহাস সম্বন্ধে একটা অনীহা রয়ে গেছে৷ সেই অনীহাই ভারতবাসীকে ইতিহাস রচনায় বিমুখ করে রেখেছিল৷ ‘‘রাজতরঙ্গিনী’’ ছাড়া ত্রিপুরার ‘রাজমালা’–তে, অসমিয়া ‘‘বুরঞ্জি’’–তে যা’ আছে তা’ কতখানি ইতিহাস পদবাচ্য সেটা পণ্ডিতদের বিবেচ্য৷ ভারতের মধ্যযুগীয় ইতিহাস বলতে যা বোঝায় সেগুলি অধিকাংশ ক্ষেত্রেই আমরা বৈদেশিক পর্যটকদের রোজনাম্চা থেকেই সংগ্রহ করতে বাধ্য হয়েছিলুম৷ ইতিহাসের একটা পাতা লিখতে গেলেও আমাদের ফা–হিয়েন, মেঘাস্থিনিস, ইউং চুয়াং, ইবনবতুতা প্রভৃতির দ্বারস্থ হতে হয়েছিল৷ পাঠান আমলে ও মোঘল আমলে নবাব–বাদশাহদের আগ্রহে কিছু কিছু ইতিহাস লিখিত হয়েছিল, তবে সেগুলিও কতটা প্রামাণ্য বলা শক্ত৷ তবে একথা হলফ করে বলা যেতে পারে যে সেগুলিতে পুকুর চুরি না হলেও ডোবা চুরি অবশ্যই হয়েছে৷
(পরবর্তী অংশ আগামী ১৫ই জানুয়ারী সংখ্যায়)