আবার দেখো, যেটা মানস–রাজনৈতিক শোষণ হ্মব্দম্ভন্তুড়প্স–হ্ম্ অথবা রাজনৈতিক স্তরের শোষণ, সেটা কীরকম ভাবে হয়৷ একটা জনগোষ্ঠী আরেকটা জনগোষ্ঠীর ওপর সবলে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করে৷ তাদের পেছনে মুখ্য উদ্দেশ্য থাকে যে, ওই শোষিত জনগোষ্ঠী বা শোষিত দেশ (এখানে দেশের চেয়েও জনগোষ্ঠী বড় কথা)–ওই ভূমিটাকে আমি কাঁচামালের যোগানদার হিসেবে নোব কাঁচামাল তৈরী হবে আমার এক্তিয়ারের মধ্যে, আর ওই শোষিত ভূমিটাকে আমার তৈরী মালের বাজার হিসাবে পাবো৷ যে সমস্ত জনগোষ্ঠী আর্থিক দিক থেকে অনুন্নত, তারা শক্তিশালী জনগোষ্ঠী অথবা শক্তিশালী দেশের কাছে মাথা বিকিয়ে দিতে বাধ্য হয়–হয় শক্তির অভাবের জন্যে, ভীতম্মন্যতার ফলে, অথবা আর্থিক অনটনের ফলে৷ আর দ্বিতীয় স্তরে তারা তাদের ভূমিকে বা জনগোষ্ঠীকে কাঁচামালের যোগানদার হিসেবে, ও মাল কেনবার বাজার হিসেবে দেখতে পায়৷ অর্থাৎ তাদের ভবিষ্যৎ অন্ধকার হয়ে যায়৷
এই পলিটিকো–ইকনমিক শোষণের বলি পৃথিবীর অধিকাংশ দেশ এককালে ছিল, এখনও অনেক দেশ রয়েছে শুধু দেশ বলি কেন, জনগোষ্ঠীও৷ অর্থনৈতিক শোষণের হাত থেকে (সে পলিটিকো–ইকনমিক হোক আর মানস–র্থনৈতিক হোক) মানুষকে বাঁচাতে গেলে তাদের মধ্যে সচেতনতা ন্তুপ্সুব্দন্তুন্প্সব্ভব্ আনতে হবে৷ সচেতনতা না আনলে তারা মানস–র্থনৈতিক শোষণের বিরুদ্ধে তো দাঁড়াতে পারবেই না, পলিটিকো–ইকোনমিক শোষণের বিরুদ্ধেও দাঁড়াতে পারবে না৷
সবল মানুষ দুর্বলের ওপর করে’ চলেছে অত্যাচার–বিচার৷ সবল মানব–গোষ্ঠী দুর্বল মানবগোষ্ঠীর ওপর করে’ চলেছে শোষণ৷ এ অবস্থায় সৎ মানুষ মাত্রেরই কর্তব্য অন্যায়কারীর বিরুদ্ধে সংগ্রাম করা৷ নৈতিক উপদেশ কবে কাজ দেবে তার জন্যে অনন্তকাল বসে থাকা চলে না৷ তাই সৎব্যষ্টিগণকেও সংঘবদ্ধ হতে হবে৷ দানবের বিরুদ্ধে সংগ্রামের জন্যে প্রস্তুতিও চালিয়ে যেতে হবে৷ সামূহিক জীবনের ওপর অথবা কোনো মানব–গোষ্ঠীর ওপর যারা নির্যাতন চালায় তাদের ক্ষমা করা চলে না৷ সে ক্ষেত্রে ক্ষমা শুধু দুর্বলতাই নয়, তাতে অন্যায় প্রশ্রিত হয়–অন্যায়কারী বেপরোয়া হয়ে ওঠে৷ ব্যষ্টিগত জীবনে কোন নির্দোষ ব্যষ্টির ওপর অসাধুরা যদি জোর–জুলুম চালায় সেক্ষেত্রে ওই নির্দোষ ব্যষ্টি নিজের সহ্যশক্তি পরীক্ষা করবার জন্যে অথবা অন্য যে কোনো কারণে জুলুমবাজকে ইচ্ছা করলে ক্ষমা করলেও করতে পারে৷ কিন্তু ওই জুলুমবাজেরা যদি কোনো মানব–গোষ্ঠীর উপর অত্যাচার চালায় সে ক্ষেত্রে ওই গোষ্ঠীর প্রতিনিধিরূপে কোনো ব্যষ্টিবিশেষ অন্যায়কারীকে ক্ষমা করতে পারে না, ক্ষমা করবার অধিকার তাঁর নেই৷ তিনি যদি নিজের অধিকার বহির্ভূত কাজ করেন সেক্ষেত্রে তিনি যাদের প্রতিনিধিত্ব করছেন তারাই তাঁকে ধিক্কার দেবে৷ তাই বলতে হচ্ছে ক্ষমা ব্যষ্টিগত জীবনের সাধনা–সামূহিক জীবনের নয়৷৩
যারা শোষণ করছে, প্রত্যক্ষভাবে বা পরোক্ষভাবে, তারা শোষিতদের কেবল যে শোষণই করে তা নয়–শাসনও করে৷ কারণ শাসন কাজ অব্যাহত থাকলে শোষণ ভালোভাবে চলে৷ আর যারা পরোক্ষভাবে করে, তারা নিজেরা শাসন করে না–শাসকদের অর্থ বলে ক্রয় করে’ নেয়৷ আর এই অর্থবলে ক্রয় করার পরিণামটা হয়–শাসককুল যাদের অর্থে ক্রীত হচ্ছে তাদেরই মনোরঞ্জন করে, তাদের টাকায় নির্বাচনে জয়ী হয়, আর মুখে তারা আর্থিক, রাজনৈতিক, সামাজিক শোষণের বিরুদ্ধে কথা বলে৷ কিন্তু কার্যক্ষেত্রে তলে তলে এই জিনিসটাকে সমর্থন করে৷ এই যে জিনিসটা, একে আমি নাম দিয়েছি ‘বাকসর্বস্ব বিপ্লবী’ প্সন্তুত্রপ্ত ব্জন্দ্ব্লপ্সপ্তব্ভব্ধ৷ এরা মুখে বড় বড় কথা বলবে শোষণের বিরুদ্ধে, আর কার্যক্ষেত্রে তলে তলে সেইটাই করে’ যাবে৷ এর চেয়ে কিছুটা ভালো হ’ল রিফর্মিষ্ট–যারা বলে ধীরে ধীরে আস্তে আস্তে করা যাক৷ কিন্তু তাদের মতলব থাকে যাতে শোষণের রথ অব্যাহত থাকে৷ তোমরা পৃথিবীতে অনেক রিফর্মিষ্ট দেখেছো, কার্যক্ষেত্রে তারা সমাজের কল্যাণ চায়নি–তারা একটু উনিশ–বিশ করে’ প্রতিষ্ঠা বজায় রাখতে চেয়েছিল৷
যুগ–সংস্কারক ত্মন্দ্বন্দ্রপ্সব্জপ্প যাঁরা তাঁরা সমাজের কল্যাণকামী নন৷ বরং তাঁরা সমাজের ত্রুটিগুলোকে আরও দীর্ঘস্থায়ী করতে চান৷ তাদের পাকে–প্রকারে জিইয়ে রাখতে চান৷ তাদের মধ্যে হয় ভীতম্মন্যতা ছিল অথবা ছিল শঠতার নোংরামি৷
সাংস্কৃতিক শোষণ ঃ মানস–র্থনৈতিক, মানসিক স্তরেও পঙ্গু করার আর একটা পথ হচ্ছে সাংস্কৃতিক শোষণ৷
অভিব্যক্তির যেটা মধুরতর সূক্ষ্মতর ভাব সেটাকেই আমরা সাধারণতঃ সংস্কৃতি বলে থাকি৷ মনে করো, তোমাকে কেউ খেতে দিলো–তুমি হাত মুখ না ধুয়ে দু’হাতে করে’ খেতে পার, আবার হাত মুখ ধুয়ে শুদ্ধ ভাবেও গ্রহণ করতে পার৷ এই যে শুদ্ধাচার ও স্বাস্থ্য সম্মত বিধি অনুযায়ী খাওয়া–এটাই হ’ল খাওয়ার কালচার৷ যে সকল কর্মে এই মধুরতর, সূক্ষ্মতর অভিব্যক্তিগুলো রয়েছে সেগুলোই হচ্ছে কালচার৷ সংস্কৃতি মানুষের এক, তবে বিভিন্ন জায়গায় এর অভিব্যক্তির ধরণ–ধারণে একটু স্থানিক পার্থক্য থাকে৷
যে জনগোষ্ঠী অন্যকে শোষণ করতে চায় সে অন্যের স্থানিক অভিব্যক্তিগুলোকে নষ্ট করে’ দিতে চায়৷ জোর করে’ একের ওপরে অন্যের ভাষা চাপায়, জোর করে’ একের ওপরে অন্যের পোষাক চাপায়, অন্যের চিন্তাধারা চাপায়৷ এইভাবে মানসিক দিক দিয়ে তাদের পঙ্গু করে’ দিয়ে শোষণের আরো সুবিধা করে’ নেয়৷ সাংস্কৃতিক জীবনে এইভাবে চলে শোষণ৷
মানুষের স্বাভাবিক মন অধোমুখী৷ নীচের দিকে যত সহজে যায়, ওপরের দিকে তত তাড়াতাড়ি ওঠে না৷ সুতরাং খারাপ সিনেমা, খারাপ নাটক–অর্থবলে যদি তাদের ঘাড়ে চাপিয়ে দেওয়া হয়, তাহলে তাদের মেরুদণ্ড ভেঙ্গে যাবে, পঙ্গু হয়ে যাবে৷ আর এই পঙ্গু মানুষগুলো শোষণের বিরুদ্ধে মাথা তুলে যুথবদ্ধ ভাবে দাঁড়াতে পারবে না–পারতেই পাারে না৷
এই যে সাংস্কৃতিক জীবনে শোষণ, যেটা করা হয় অসংস্কৃতির মাধ্যমে, সেই অসংস্কৃতির বিরুদ্ধে প্রতিটি সৎ, প্রতিটি ধার্মিক, প্রতিটি বিচারশীল মানুষকে রুখে দাঁড়াতে হবে৷ সেই সঙ্গে অন্যকেও একাজে প্রেরণা জোগাতে হবে৷ তা না হলে মানুষের ভবিষ্যৎ অন্ধকার৷ মানুষ রাজনৈতিক শক্তির জন্যে লড়াই করে’ গেল, সামাজিক মুক্তির জন্যে লড়াই করে’ গেল–বুঝলুম কিন্তু যদি সাংস্কৃতিক মেরুদণ্ড ভেঙ্গে গেল, তাহলে সব ব্যর্থ হয়ে যাবে৷ তা হবে ভস্মে ঘৃতাহুতির সামিল৷ যদি কারো মেরুদণ্ড ভেঙ্গে পড়ে, সে মাথা তুলে দাঁড়াতে পারবে না৷ অসংস্কৃতির বোঝায় যার ঘাড়–পিঠ ভেঙ্গে দুমড়ে গেলে সে কি মাথা উঁচু করে’ জীবনে অন্য কোনো ভূমিতে সংগ্রাম করতে পারবে? কিছুতেই পারবে না৷ তাই অসংস্কৃতির হাত থেকে নিরীহ মানুষকে রক্ষা করা প্রতিটি বিচারশীল মানুষের অবশ্য কর্ত্তব্য৷
মানুষের মধ্যে চেতনা এনে দাও, জ্ঞানাঞ্জন–শলাকায় তাদের চোখ খুলে দাও৷ তারা বুঝতে শিখুক, কী, কেন, কোথায়, কী হচ্ছে৷
জড় জগতে যে অর্থনৈতিক বন্ধন, রাজনৈতিক দাসত্ব, নানান ধরণের সামাজিক পরাধীনতা–এসব থেকে মুক্তি লাভের যে প্রয়াস সেটাই হ’ল জড় জগতের মুক্তি৷ এই ধরণের জাগতিক বন্ধন–মুক্তির জন্যে মানুষকে চেষ্টাশীল হতে হবে৷
আমরা দেখেছি, যেখানে জাগতিক পরাধীনতা–সেটা অর্থনৈতিক হোক, রাজনৈতিক হোক, সামাজিক হোক–সেখানে মানুষের অন্তর্নিহিত গুণগুলো বা তার প্রতিভার সম্যক্ বিকাশ সুদূর পরাহত হয়৷ তাই জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রেই মুক্তি চাই, জড়ের বন্ধন থেকে মুক্তি তো চাই–ই৷
জড়ের চেয়ে সূক্ষ্ম হল মন৷ মানসিক দাসত্ব থেকে মনকে মুক্ত করতে হবে৷ আমরা দেখতে পাই, মানুষের সমাজে কত রকম মানসিক চাপ, কত রকম শোষণ চলেছে৷ এই শোষণ, এই অত্যাচার, এই মানসিক বন্ধন থেকে মুক্তির জন্যে মানুষকে অবশ্যই প্রয়াসশীল হতে হবে৷