সামাজিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন চাই

লেখক
আচার্য মন্ত্রসিদ্ধানন্দ অবধূত

৭৭তম স্বাধীনতা দিবসে প্রধানমন্ত্রী তাঁর ভাষণে অর্থনীতিকে কোন দিশা দেখাতে পারেনি৷ তাঁর ভাষণ ছিল আত্মপ্রচারের বাগাড়ম্বর৷ তার কথায় না ছিল সারবত্তা, না ছিল সত্যতা৷ দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি, সুইসব্যাঙ্কের  কালোটাকা  বছরে দুকোটি  চাকরী না এসব নিয়ে  তাঁর ভাষণে একটি কথাও বার হয়নি৷ শুধু দেশ এগিয়ে চলেছে  জিডিপির হাত ধরে৷ ‘জিডিপি’‘জিডিপি’ করে নেতা মন্ত্রীরা দেশবাসীকে চমকে দিচ্ছে৷ সাধারণ দেশবাসী জিডিপি বৃদ্ধির ঠিক মানেও বোঝেন না, তাদের শুধু এইটুকু বোঝানো হয়, দেশের অত্যন্ত  দ্রুত উন্নয়ন হবে৷ জিডিপি বৃদ্ধি মানেই তো দেশের সামগ্রিক উৎপাদন বৃদ্ধি৷ দেশের কলকারখানা বাড়বে, কৃষিজ সম্পদ বাড়বে,খনিজ সম্পদ বাড়বে, পরিষেবা বাড়বে, দেশে আয় বাড়বে৷ কিন্তু এতে কি সত্যিটা বোঝা যায়! কাদের আয় বাড়বে, জিডিপির উন্নতির সঙ্গে  তাল রেখে দেশের দরিদ্র শ্রেণীর ক্রয়ক্ষমতা বাড়বে কি? তাদের স্বাচ্ছন্দ বাড়বে কি? তাদের ও তাদের ছেলেমেয়েদের স্বাস্থ্য ও শিক্ষার উন্নতি হবে কি?

২০১৯ সালের অক্সফ্যাম রিপোর্ট বলছে, দেশের সবচেয়ে বিত্তবান ১শতাংশ মানুষের হাতে রয়েছে দেশের ৭৩ শতাংশ সম্পদ৷ আর ১ বছর আগে এই ১ শতাংশ বিত্তবান মানুষের হাতে ছিল ৫৮ শতাংশ সম্পদ৷ তার মানে ধনিক শ্রেণীর সম্পদ বিপুল হারে বেড়ে চলেছে৷ অন্যদিকে নীচু তলার ৫০ শতাংশ মানুষের আয় এই এক বছরে বেড়েছে মাত্র ১ শতাংশ৷ তারপর যদি মূল্যবৃদ্ধির সঙ্গে তুলনা করা যায় তাহলে তো ক্রয়ক্ষমতা বরং কমেছে৷

অর্থাৎ দেশের উন্নতি হচ্ছে ঠিকই, কিন্তু ধনীদের উন্নতি হচ্ছে, তাদের সম্পদ হু-হু করে বাড়ছে৷ তাতে গরীবের দুঃখমোচন হচ্ছে কি?

আসলে বর্তমান দেশের অর্থনীতি পুঁজিবাদী অর্থনীতি৷ বছরের পর বছর পুঁজিপতিদের সম্পদ ফুলে ফেঁপে ঢাক হচ্ছে৷ সাধারণ গরীবদের দারিদ্র্য ও বেকার সমস্যা বেড়েই চলেছে৷ শুধু ভারতের কেন আমেরিকা, ফ্রান্স, ইংল্যাণ্ড-এর মত অর্থোন্নত দেশগুলিতেও প্রচণ্ড বেকার সমস্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে৷ যৎসামান্য করে বেকারভাতা দিয়ে রাখছে৷ মাঝে মাঝে বিক্ষোভ দেখা দেয়, কিন্তু জোর করে সেই বিক্ষোভকে  দমন করা হয়৷

প্রাউট-প্রবক্তা পরম শ্রদ্ধেয় শ্রী প্রভাতরঞ্জন সরকার বলেছেন, যতদিন না অর্থনীতির  বিকেন্দ্রীকরণ করা হয়, ততদিন দেশের প্রকৃত সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়৷ জিডিপি বা মাথা পিছু  গড় আয় বৃদ্ধি এগুলো অর্থনীতির উন্নতির লক্ষণ নয়, পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় এতে ধনীদেরই সম্পদ বৃদ্ধি হয়, ধনীদের হাতে দেশের সম্পদের কেন্দ্রীকরণ হচ্ছে৷ তাতে ধনীদের হাতে শুধু দেশের অর্থনৈতিক চাবিকাঠিই নয়, রাজনৈতিক সাংসৃকতিক --- সমস্ত  চাবিকাঠিই কুক্ষিগত হচ্ছে৷ তারা তো প্রধানতঃ মুনাফাটাই বোঝে৷ মুনাফার জোরেই তার ধনী৷ তাই অর্থশক্তি দিয়ে তারা সারা দেশকে নিজেদের কুক্ষিগত করে৷ দেশের বৈশ্যশোষণ চরম হতে থাকে৷

আজ আমরা কথায় কথায় ‘গণতন্ত্র গণতন্ত্র’ বলে  শ্লোগান তুলছি৷ গণতন্ত্রের জয়গান গাইছি৷ কিন্তু আমরা কি ভেবে দেখেছি, এই গণতন্ত্র বর্তমানে পুঁজিপতিদের হাতের পুতুল৷ ধনীরা টাকার জোরে গণতন্ত্রকে হাটে বাজারে বিক্রি করতে পারে৷ যেমন বস্তা বস্তা টাকা সহজে গণতান্ত্রিক নির্বাচনের মোড় ঘুরিয়ে দেয়৷ কালোকে শাদা আর শাদাকে কালো করে দেয়৷ নগদ টাকা  দিয়ে, চাল, কাপড়, মদ দিয়ে বোট vote) কেনা যায়৷ ধনীরা  টাকার জোরে তাদের মনোমত প্রার্থীদের সহজে জিতিয়ে আনতে পারে৷ এটা তো বাস্তব অভিজ্ঞতা৷ তাই অর্থনৈতিক গণতন্ত্র ছাড়া রাজনৈতিক গণতন্ত্র অর্থহীন৷ অর্থনৈতিক গণতন্ত্র মানে দেশের প্রতিটি মানুষের নূ্যনতম চাহিদা পূরণের গ্যারান্টি৷ না, দান দক্ষিণার দ্বারা নয়, তাদের যুগোপযোগী ক্রয়ক্ষমতা দিতে হবে৷ আর স্থানীয় অর্থনৈতিক শক্তির নিয়মক হবে স্থানীয় মানুষেরা৷

জগতের সম্পদ সীমিত৷ প্রকৃতি দত্ত সম্পদে সমাজের  সমস্ত  মানুষেরই অধিকার আছে৷ তাই, কারুর জিম্বায় বিপ ল সম্পত্তি থাকবে, আর  অঢেল  বিলাসিতায় জীবন অতিবাহিত  করবে,  সম্পদের অপচয়  করবে, আর  অন্যদিকে না খেয়ে অভাবের  তাড়নায় মানুষ শুকিয়ে মরবে, অর্থনীতির এই বৈষম্য কিছুতেই মেনে নেওয়া সম্ভব নয়৷ এ ব্যবস্থা কখনই ন্যায়সঙ্গত হতে পারে না৷ এই ধনতান্ত্রিক অর্থনীতির খোলনলচে পাল্টাতে হবে মানুষের সার্বিক উন্নয়নের লক্ষ্যে৷

তাই এই সামাজিক  অর্থনৈতিক ব্যবস্থার  আমূল পরিবর্তন  চাই৷ আর সেই কারণেই প্রাউট প্রবক্তা দিয়েছেন, অর্থনৈতিক  গণতন্ত্রের আদর্শ৷ এই অর্থনৈতিক গণতন্ত্রের আদর্শ ছাড়া সমাজের  সর্বস্তরের মানুষের প্রকৃত উন্নয়ন সম্ভব নয়৷