সাম্রাজ্যবাদী শোষক গোষ্ঠী বাঙলাকে ধবংস করতে চায়

লেখক
মনোজ দেব

‘সুদূর বৈদিক যুগ থেকেই শুরু হইয়াছে তৎকালীন অঙ্গ, বঙ্গ কলিঙ্গ ও প্রাগজ্যোতিষপুরের ওপর তথাকথিত আর‌্যদের অত্যাচার ও অবিচার৷ মহারাজা শশাঙ্কের সময় পর্যন্ত অবশ্য বাঙলা আর্যদের কাছে নতি স্বীকার করে নাই৷ কিন্তু বাঙলার চিরকালীন দুর্ভাগ্যই হইল একই সময়ে সে বীর প্রশবিনী এবং ষড়যন্ত্রকারীদের স্তন্যদাত্রীও৷ মহারাজা শশাঙ্কের সময়েও এর ব্যতিক্রম হয় নাই৷ তাই আর‌্যদের পক্ষে সম্ভব হয়েছিল রণনীতির দ্বারা নয়, কূটনীতির দ্বারা বাঙলাকে পরাজিত করা৷ কিন্তু সামগ্রিকভাবে বাঙলা এমনকি পাঠান মোঘল যুগেও বশ্যতা স্বীকার করে নাই৷ তার প্রমাণ বারো ভূঁইয়া৷

ব্রিটিশ বেনিয়া রাজের রথ চক্রের নির্মম পেষনে যখন আসমুদ্র হিমাচল ভারতবর্ষের নাভিশ্বাস শুরু হইয়াছে তখনও বাঙলার যুবশক্তি নিজেদের ঐতিহ্য বজায় রাখিয়া সৃষ্টি করিয়াছে অগ্ণিযুগের৷ তাইsettled fact কেunsettled করিতে দেরি করে নাই তৎকালীন সর্বশ্রেষ্ঠ সাম্রাজ্যবাদ৷ অগণিত যুবকের মৃত্যুবরণের বিনিময়েই দ্বিখন্ডিত বাঙলা একদিন রাহুমুক্ত হইয়াছিল৷

প্রতাপাদিত্য, ইশাখা, দীনেশ-বিনয়-বাদলের বাঙলা আবার মীরজাফর মিরনেরও জন্মভূমি৷ তাছাড়া জাতি হিসেবে বাঙালীর বিশ্বাস প্রবণতা প্রায় অপরাধের সমতুল্য৷ কংগ্রেসের ভেদনীতি বা কূটনীতির স্বরূপও সাধারণভাবে বাঙলার নরনারী উপলব্ধি করতে পারে নাই৷ পারিয়া ছিল বাঙলার যুবশক্তি আর শ্রদ্ধেয় শ্রীশরৎচন্দ্র বসু, মৌলভী ফজলুল হক ইত্যাদি মুষ্টিমেয় কয়েকজন রাজনীতিবিদ৷ ভারতবর্ষের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জহরলাল নেহেরু, গান্ধী বৈবাহিক রাজাগোপাল আচারী ইত্যাদিদের প্রত্যক্ষ অনুমোদন এবং ‘রামধূন’ প্রচার কর্তা মহাত্মা গান্ধীর ইঙ্গিতের ফলে ১৯০৫ সালের সমস্ত প্রচেষ্টাকে ব্যর্থ করিয়া বাঙলাকে আবার ১৯৪৭ সালে দ্বিখন্ডিত করা হয়৷ সামগ্রিকভাবে বাংলাদেশ ১৯৪৭ সাল হইতেই নিপীড়িত হয় হিন্দুস্থান এবং পাকিস্তানের ডিক্টেটরদের দ্বারা৷ দুয়েরই মিলিত অভিযান ছিল ভারতবর্ষের মানচিত্র হইতে বাঙলার অবলুপ্তি করিতে৷ দিনের পর দিন তাই শোষণেরও সীমা ছিল না৷ পরে অবশ্য কেদার রায় চাঁদ রায়ের বাঙলা সমুচিত উত্তর দিয়াছে নিজেকে সম্পূর্ণ পৃথক করিয়া৷ আজও পারে নাই এপার বাঙলার লোকেরা৷’

শ্রীরমেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় ও শ্রীমতি সাধনা বন্দ্যোপাধ্যায়ের রচিত ‘ভারতের অন্যতম উপনিবেশ পশ্চিমবাংলা’ গ্রন্থের ভূমিকা উপরের অংশটি৷

আর জি করের ঘটনা অবশ্যই বেদনাদায়ক, অপরাধীদের কঠোরতম সাজা প্রতিটি শুভবুদ্ধি সম্পন্ন মানুষই চাইবে৷ কিন্তু আর জি করের ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে এখন যে আন্দোলনটা চলছে তার উদ্দেশ্য কিন্তু বাঙলার কৃষ্টি সংস্কৃতিকে রক্ষা করতে আরজি করের মত ঘটনার বিরুদ্ধে নয়৷ আর জি কর সেই অশুভ শক্তিকে সেই মীরজাফর মিরন দের উত্তরসূরী দিল্লির দালালদের একটা সুযোগ এনে দিয়েছে ভারতবর্ষ থেকে বাঙালী জাতিকে ধবংস করার৷ আর জি কর অকসাৎ দুর্বৃত্তদের মধ্যরাতের সুযোগ নিয়ে ঘটিয়ে ফেলা কোন ঘটনা নয়৷ স্বাধীনতার পর থেকেই বাঙালী জাতিকে ধবংস করা, বাঙলার কৃষ্টি সাহিত্য সংস্কৃতিকে ধবংস করার বাঙলার সম্পদ লুণ্ঠনের যে ষড়যন্ত্র শুরু হয়েছে আর জি কর সেই ষড়যন্ত্রের এক টুকরো অংশ৷ তাই মূল অপরাধীর পরিচয় নিয়েও বিভ্রান্তি ছড়ানো হচ্ছে৷ সঞ্জয়কেউ লিখছে রায়, কেউ লিখছে রাই, ভিন রাজ্যের বাসিন্দা৷ সঞ্জয়ের পরিচয় যাইহোক, ঘটনা ঘটেছে কলকাতায়৷

তাই শুধুমাত্র আরজিকরের ঘটনা নিয়ে নয়, বাঙলার এবার লড়াইটা শুরু হোক হাজার বছরের শোষণ বঞ্চনা দমন পীড়নের বিরুদ্ধে যা গত ৭৭ বছরে ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছে৷ নেহেরু থেকে নরেন্দ্র মোদি দিল্লীর সব শাসকই এই এক জায়গায় সবাই এক৷ যে কোনো ভাবে ভারত থেকে বাঙালীকে অবলুপ্ত করতে হবে৷ শুধু শিল্প সাহিত্য ও সংস্কৃতিতে নয়, অর্থনীতিতেও বাঙলা পরাধীন ভারতে ছিল সবার আগে অন্য সব রাজ্য থেকে অনেক উন্নত৷ সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশ ভারত ছেড়ে ছিল কোন মুচলেখা বিপ্লবীর ভয়ে নয় কোন অহিংসার পুজারীর (?) আবেদনে নয়৷ ব্রিটিশ বুঝেছিল বাঙলা তাকে ছাড়তেই হবে৷ আর সেটা বাঙলার বিপ্লবীদের ভয়ে৷

সেই সময় দেশীয় পুঁজিপতিরা ভেবেছিল কোনভাবে সুভাষচন্দ্র যদি ভারতে ফিরে আসে ব্রিটিশকে তাড়িয়ে স্বাধীন দেশের সরকারের প্রধান হয়ে বসে তাহলে তাদের শোষণের স্বর্গ রাজ্য ধুলিসাৎ হয়ে যাবে৷ তাই ব্রিটিশের সঙ্গে বোঝাপড়া করে বাঙলা পঞ্জাবকে ভাগ করে ক্ষমতা হস্তান্তর করিয়ে নেয় দেশীয় পুঁজিপতি শোষকরা৷ তখন থেকেই শুরু হয়ে ভারতে বাঙালীকে অবলুপ্ত করার চক্রান্ত৷

তাই আর জি করের ঘটনা থেকে তৎপরবর্তী আন্দোলন সবই সেই ভয়াবহ শোষণের কারিগরদের নিপুন ষড়যন্ত্রের ফল৷ বাঙালীর এবার অন্তত বোধোদয় হোক৷ বাঙালী জাত পাত দলমত সম্প্রদায়গত বিভেদ বিদ্বেষ ভুলে ঐক্যবদ্ধ হয়ে আর একটা আন্দোলন শুরু করুক৷ না, ১৯৪৬ এর পুনরাবৃত্তি নয়, এবার দিল্লি দেখবে ১৯০৫ সাল ও তার পরবর্তী অগ্ণিযুগের দস্যি দামালদের স্বরূপ, যা ভারতবর্ষে বাঙালীর অধিকার কে প্রতিষ্ঠিত করবে সব শোষণ ও বঞ্চনার অবসান ঘটিয়ে৷