বর্তমান সমাজে যে সার্বিক অবক্ষয় দেখা দিয়েছে তাকে মোকাবিলা করতে হবে সমাজের সকল স্তরের মানুষকে ঐক্যবদ্ধভাবেই৷ তা না করে যদি কেবল পৃথক পৃথক ভাবে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দলে বিভক্ত হয়ে প্রতিবাদ ও মিছিল করা হয় তাতে কাজের কাজ হবে না৷ গোটা দেশে বিদেশী ইংরেজের শোষণের বিরুদ্ধে যে ঐক্যবদ্ধ তীব্র আন্দোলন হয়েছিল সেই আন্দোলনের ফলে ইংরেজ শোষক বুঝে নেয় যে তাদের শোষণ আর চলবে না৷ তারা চিন্তা করতে থাকে কি ভাবে প্রতিবাদী শক্তিকে প্রতিহত করবে৷ কিন্তু এমনই একটি পরিস্থিতির সৃষ্টি হয় দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধের ফলে যাতে ইংরেজ বাধ্য হয় এদেশ ছেড়ে যেতে৷ কিন্তু তারা রেখে যায় তাদের এজেন্টদের৷ সেই এজেন্টরাই আজ দীর্ঘ ৭৭ বছর দেশ স্বাধীন হওয়া সত্ত্বেও ১৪০ কোটির অধিক মানুষের সিংহভাগের ভাগ্য ফেরাতে তো পারেই নি বরং তাদের জীবন যন্ত্রণাকে শতগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে৷ আর দুর্নীতি, শোষণ–এর যাঁতাকলে তাদের পিষে মারছে ও মারার কূটচক্রের নোতুন নোতুন জাল বিস্তার করে চলেছে৷ যখন কিছু প্রকাশ পাচ্ছে তাতেই দেখা যাচ্ছে যে রক্ষকরাই ভোক্ষণ করছে৷ আর ছলচাতুরী করে সেই ভক্ষণের মারাত্মক পথকেই প্রশস্ত করে তুলছে৷ আজ সমস্যার উপর সমস্যার পাহাড় জমছে৷ কোন সমস্যারই সুরাহা দেখা যাচ্ছে না৷ সুষ্ঠু শাসন ব্যবস্থা প্রবর্ত্তন করতে যেটার প্রথম দরকার সেটা হ’ল প্রশাসনের মধ্যে দূর্ণীতি দুরীকরণ৷ আইন–শৃঙ্খলা রক্ষার দায় মূলতঃ যে পুলিশ প্রশাসনের উপর আছে সেই বিভাগটিতে সবচেয়ে বেশী দুর্নীতি আশ্রয় করে আছে৷
এদেশে সংসদীয় গণতন্ত্র চলছে৷ কয়েক ডজন বড়ো রাজনৈতিক দল আছে এদেশে৷ আর কয়েক শত দলছুট ছোট ছোট রাজনৈতিক দল সারা দেশকে মাকড়াসার জালের মতো আষ্টেপিষ্ঠে জড়িয়ে আছে৷ আর এই রাজনৈতিক দলের আশ্রয়ে বিশেষ করে যাদের হাতে শাসন ক্ষমতা আছে তাদের সঙ্গে দুর্নীতিগ্রস্তরা সরাসরি যুক্ত হয়েই দেশের সর্বনাশ করে চলেছে৷ দূর্নীতিগ্রস্তরা থানাগুলোর সঙ্গে বন্দ্যোবস্ত করেই দেশের আর্থিক, সামাজিক দিকগুলির সর্বনাশকে ত্বরান্বিত করছে৷ আইনশৃঙ্খলার ধার কেউ ধারে না যেহেতু এটা তথাকথিত গণতন্ত্র৷ ট্রাফিক আইন ড্রাইভাররা মানে না৷ অর্থনৈতিক পরিকাঠামোটা তিল তিল করে দীর্ঘ ৭৭ বছরে নষ্ট হয়ে গেছে৷ স্বাধীনতার পর স্বাধীনদেশের নিজস্ব যে অর্থনৈতিক কাঠামো গড়ে তোলার দরকার ছিল সেটা দেশের গণতান্ত্রিক শাসকগণ গড়ে তোলেননি৷ সেই ইংরেজ আমলের পুরাতন অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকেই আঁকড়ে ধরে চলেছে৷ ফলে পুরাতন আমলের কলকারখানার অবস্থা শোচনীয় হওয়াতে একে একে বন্ধ হয়ে গেছে৷ বেকার জনগণ দিশেহারা হয়ে পড়েছে৷ লোক সংখ্যা বৃদ্ধির ফলে চরম বেকার সমস্যায় দেশ মুর্মুষু হয়ে পড়েছে৷ ঘরে ঘরে বেকার৷ তাছাড়া দেশভাগে অনেক অবাঞ্ছিত অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে৷ বাইরের লোকের ভীড়ের দরুণ দারুণ আর্থিক, সামাজিক ও আইনশৃঙ্খলাজনিত নোতুন নোতুন সমস্যা দেখা দিয়েছে৷ ইংরেজ আমলের আগে দেশে যে একটা আর্থিক তথা সামাজিক ভারসাম্য ছিল ও গ্রামের অর্থনৈতিক অবস্থার যে ভারসাম্য কৃষি ও ক্ষুদ্রকুটির শিল্পের সমন্বয়ে গড়ে ওঠে সেটা ইংরেজ শাসকগণ ধ্বংস করে দেয়৷ গ্রাম শ্মশানে পরিণত হয়৷ নোতুন নোতুন শিল্প অঞ্চল হয়৷ গ্রাম ছেড়ে মানুষ এই শিল্প অঞ্চলে এসে ভীড় করে৷ দেশের জনসংখ্যার মধ্যে একটা মারাত্মক ভারসাম্যের অভাব ঘটে৷ সেই ভারসাম্যহীন দশাটা বেড়ে যায় দেশভাগের ফলে৷ পূর্বভারতের অর্থনৈতিক তথা সামাজিক অবস্থার যে বিপর্যয় সেটা বেড়েই চলেছে৷ স্থায়ী বাসিন্দাদের সমস্যা দিনদিন বাড়ছে৷ তারাই বেশী বঞ্চনার শিকার হচ্ছে এটা খুবই চিন্তার৷ স্থায়ী বাসিন্দাদের দুরবস্থার কেউই আন্তরিকতার সঙ্গে দেখছে না৷ শাসকদল সব কিছুকে যেন এড়িয়ে গিয়ে নিছক ভোটের হিসাব নিকাশেই সদা ব্যস্ত যাতে তারা গদীতে আসীন থাকে৷ অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তাটাই মূলতঃ দুর্নীতিকে হাজার গুণ বাড়িয়ে তুলেছে৷ আর সমাজতান্ত্রিক চিন্তা ভাবনার অভাবের দরুণই ধনতান্ত্রিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থার বেড়াজালে বৈশ্যশোষণ (ধনতান্ত্রিক শোষণ) হাজারগুণ বেড়েছে৷ লোকসংখ্যা বৃদ্ধিতে বহু চাষের জমি, রাস্তাঘাট, ঘরবাড়ি ইত্যাদি নষ্ট হয়েছে৷ তাই অনাবাদি জমির চাষের উপযুক্ত করে সংস্কার করাটা জরুরী৷ সেটা হয় নি৷ লোক–কর্মসংস্থান যাতে বেশী হয় তাই ছোট ছোট ক্ষুদ্র শিল্প ব্লকে ব্লকে গড়ে তোলাটা জরুরী৷ গ্রামে গ্রামে কৃষি পণ্যর উপর শিল্প গড়ে তুলে কর্মদ্যোগ অবশ্যই বাড়াতে হবে৷ বেকার সমস্যা তাতে দূর হবে৷ শহরের দিকে চাকুরীর সন্ধানে লোকাগমন কমবে৷ তাছাড়া পরিবেশ দূষণ থেকে শিল্প অঞ্চল রক্ষা পাবে৷
শুধু খাদ্য শষ্য উৎপাদন নয়, প্রয়োজন অন্যান্য অর্থকরী বস্তু উৎপাদনেও দৃষ্টি দিতে হবে৷ বনাঞ্চল বাড়াতে হবে৷ নদ–নদীর সংস্কার করে চাষের উপযোগী জল সরবরাহ করতে হবে৷ প্রকৃতি দত্ত জৈব ও অজৈব সার ব্যাপক ব্যবহারে জোর দিতে হবে৷ ব্যাপক হারে পশুপালন করতে হবে৷ তাদের খাদ্য উৎপাদনের দিকে নজর দিতে হবে৷ তাহলেই কর্মসংস্থান বাড়বে৷
ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র শিল্প গড়ার ক্ষেত্রে জনগণকেই উৎসাহিত করতে হবে৷ বড় বড় রাস্তার পাশে যে সব অনাবাদি জমি ও পরিখা অব্যবহূত অবস্থায় আছে সেগুলিকে কাজে লাগাতে হবে স্থানীয় পঞ্চায়েৎ মিউনিসিপ্যালিটির মাধ্যমে৷ রাস্তাঘাটের সংস্কার মূলতঃ স্থানীয় স্বায়ত্বশাসনগুলির মাধ্যমে স্থানীয় ব্যষ্টিদের দ্বারা রক্ষা করার দায়িত্ব নিতে হবে৷ নাগরিকগণের নূ্যনতম যে দায়িত্ব আছে সেটির দিকে আগ্রহ বাড়াবার চিন্তা ভাবনা শাসকগণকে নিতে হবে৷ বেসরকারী উদ্যোগকে সর্বস্তরে কাজে লাগাতে হবে৷
বিভিন্ন সংস্থার কাজের সময় কমিয়ে কর্মী সংখ্যা বাড়াতে হবে৷ তাতে কর্মীনিয়োগ বাড়বে ও বেতন–এর পরিমাণ কম হলেও পরিবারে বেকার বেশী থাকবে না৷ বেকারের সংখ্যা বেড়ে যাওয়াতে অনেক অসামাজিক কাজ বেড়ে যাচ্ছে৷
পরিশেষে বলি, শিক্ষা ব্যবস্থায় অবশ্যই নৈতিক শিক্ষার দিকে দৃষ্টি দেওয়ার ব্যবস্থা করা খুবই জরুরী৷ সুশিক্ষা, নিয়মানুবর্ত্তিতার উপর যদি দৃষ্টি না দেওয়া হয় তাহলে গণতন্ত্র সার্থক হয়ে উঠতে পারে না৷ বাজারে নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসের দাম বৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণের দিকে সরকারকে দৃষ্টি দিতে হবে৷ অসাধু ব্যবসা যাতে মাথাচাড়া না দিতে পারে সেদিকে প্রশাসনের নজর থাকাটা কাম্য৷ ভোগ্যবস্তুর উৎপাদন বৃদ্ধি ও বন্টননীতিটা যাতে সঠিক ভাবে নিয়ন্ত্রিত হয়৷ সেই কারণে রেশনিং ব্যবস্থাকে আরো সার্থকভাবে সচল করে তোলাটা সরকারের পবিত্র দায়–দায়িত্ব বলেই মনে হয়৷ বর্তমানে দ্রব্যমূল্য যেভাবে আকাশছোঁয়া হয়ে পড়েছে তাতে সাধারণ নিম্নমধ্যবিত্তের দারিদ্র্যসীমার নীচে বসবাসকারীদের জীবন–যাপনটা দুর্বিসহ হয়ে পড়েছে৷
মহার্ঘভাতা বৃদ্ধিতে তো সাধারণ জনগণ উপকৃত হবে না, এতে অন্যদিক দিয়ে বাজারে জিনিসের দাম বৃদ্ধির প্রবণতাটা স্থায়ীত্ব লাভ করে আর সাধারণ মানুষ অত্যন্ত আর্থিক সংকটে পড়ে৷ তাই সবকিছুর দিকে নজর দিয়ে গণতন্ত্রের রক্ষক হয়ে জনগণের বন্ধু শাসককে সেবামূলক কাজকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে৷
- Log in to post comments