শব্দের ইতিহাস ও তার ভুল প্রয়োগ

লেখক
খগেন্দ্রনাথ দাস

পৃথিবীর ছোট বড় সব ভাষার প্রতিটি শব্দের যেমন অর্থ রয়েছে তেমনই শব্দের উৎপত্তি বা আবির্ভাবের পেছনেও একটা ইতিহাস রয়েছে৷ সেই ইতিহাসটুকু যখন আমরা বিস্মৃত হই বা কোনভাবে বিকৃত হয়ে যায় তখন সেই বিশেষ শব্দটি তার অর্থগৌরব হারায়৷ শব্দের এই অর্থগৌরব হারানো অর্থ বিত্ত হারিয়ে যাওয়ার মত সাধারণ ঘটনা নয়৷ শব্দার্থের এই বিস্মৃতি বা বিকৃতি বহু বিপত্তিরও কারণ হয়ে উঠে৷

আমরা এখানে তেমনই দুয়েকটি শব্দের উৎপত্তির ইতিহাস ও বৈয়াকরণিক ব্যাখ্যা এখানে তুলে ধরছি৷ ভারতবর্ষে আর্যদের আগমনের সময়কাল ও পথ নিয়ে পণ্ডিতদের  মধ্যে কিছু কিছু মতপার্থক্য থাকলেও আর্যরা ভারতের উত্তরপশ্চিম দিক থেকে প্রবেশ করেছিলেন প্রভাতরঞ্জন সরকারের এই মতের সঙ্গে অনেকেই একমত৷ শ্রীসরকার বলেছেন---‘‘এরপর আর্যরা চললেন আরও পূর্বে৷ ক্রমশ বেড়ে চলল শ্যামলিমা---বাড়তে  থাকল সবুজের সমারোহ৷ এত সবুজ তাঁরা ইতোপূর্বে কখনও দেখেননি৷ বৈদিক ভাষায় ‘ধান্য’ মানে গাছপালা৷ তাই সপ্তসিন্ধু পেরিয়ে এসে পূর্বদিকের  নোতুন স্থানটির তাঁরা নাম দিলেন ‘হরিৎধান্য’ যা শৌরসেনী প্রাকৃতে হয়ে দাঁড়াল ‘হরিহান্য---অর্দ্ধ শৌরসেনীতে ‘হরিহানা’ বর্তমান হরিয়ানবী ভাষায় (যা হিন্দির অতি নিকট জ্ঞাতি) ‘হরিয়ানা’৷ অনুরূপভাবে এসেছে লুধিয়ানা শব্দটি৷ প্রাচীনকালে আর্যরা লোধ্র নামে এক অরণ্য বৃক্ষের ফুলের রেণু প্রসাধনে ব্যবহার করতেন৷

‘‘ধারাযন্ত্রে স্নানের শেষে

ধূপের ধোঁয়া দিত কেশে,

লোধ্রফুলের শুভ্র রেণু

মাখত মুখে বালা৷

কালাগুরুর গুরু গন্ধ

লেগে থাকত সাজে

কুরুবকের পরত চূড়া

কাল কেশের মাঝে৷’’

(কণিকা কাব্যগ্রন্থের ‘সেকাল’, কবিতা, রবীন্দ্র-রচনাবলী চতুর্থ খণ্ড, সুলভ সংস্করণ, পৃঃ১৯৮)

লোধ্রধান্য- লোধ্‌ ধহান্য-লুধিহানা-লুধিয়ানা৷ (বর্ণ বিজ্ঞান শ্রীপ্রভাতরঞ্জন সরকার, প্রথম সংস্করণ ১৯৮৩ পৃষ্ঠা ২৪৯/৫০ শ্রীপ্রভাতরঞ্জন সরকার তাঁর ভাষাতত্ত্বের দশ সহস্রাধিক পৃষ্ঠাব্যাপী আলোচনা মধ্য দিয়ে এই রকম অসংখ্য শব্দের মূল অর্থের সঙ্গে আমাদের পরিচিত করেছেন৷

ধর্ম তেমনই একটি শব্দ৷ যার প্রকৃত অর্থের সঙ্গে সাধারণ মানুষ দূর অস্ত পণ্ডিত মহলেরও খুব বেশি সম্পর্ক এখন আর নেই৷ এই না থাকার ফলেই ‘সেকুলার’ শব্দের ভারতীয় ভাষায় অনুবাদ করা হয়েছে ‘ধর্মনিরপেক্ষ’৷ এই ধর্মনিরপেক্ষ শব্দটি ভারতীয় রাজনীতি ও সমাজজীবনে কতটা বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি করে চলেছে তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না৷ এর একমাত্র কারণ ‘ধর্ম’ ও  ‘সেকুলার’ এই দুটি শব্দের অর্থ বিকৃতি৷ আমরা  সেকুলার শব্দের উৎপত্তির ইতিহাস ও ধর্ম শব্দের যথার্থ অর্থ তুলে ধরছি৷ প্রথমেই সেকুলার এর কথা, যার পেছনে দুই তিন হাজার বছরের একটা ইতিহাস রয়েছে---‘‘পশ্চিম ইউরোপের লোক যখন খ্রিষ্টধর্ম গ্রহণ করে তখন ধর্মগুরু ও ধর্ম সংঘের প্রতি তাদের সকলের আনুগত্য দেখে খ্রিষ্টেনডম  বা খ্রিষ্টরাজ্য নামক ধারণাটি মানুষের মনে বসে যায়৷ রাজ্য একাধিক, কিন্তু পোপ এক৷ রাষ্ট্র একাধিক কিন্তু চার্চ এক৷ প্রত্যেক দেশেই পোপের অধীনস্থ ধর্মযাজকের দল একজোট হয়ে কাজ করে যায়, এক দেশ থেকে আরেক দেশে বদলি হয়, ল্যাটিন ভাষায় উপাসনা করে, ল্যাটিন ভাষায় নাম রাখে৷ চার্চের তুলনায়  রাষ্ট্র অনেকটা ক্ষীণবল,রাজা অনেক সময় চার্চের হাতের পুতুল৷ এই দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে চার্চ তার নিজের আদালত বসায়, বিচার করে দণ্ড দেয়, আগুনে পোড়ায়, খাজনা আদায় করে৷ এমন এক সময় আসে যখন দেখা যায় পোপের হাতে কেবল নৈতিক বা সামাজিক ক্ষমতা নয়, রাজনৈতিক বা সামরিক ক্ষমতাও এসে পড়েছে৷ কেউ যদি বিধর্মী হয় তাকে তিনি কেবল সমাজচ্যুত করে ক্ষান্ত হবেন না,ধনে-প্রাণে ধবংস করবেন৷ পৃথিবীর চারদিকে সূর্য ঘুরছে কেউ যদি এই তত্ত্ব অস্বীকার করে বলে সূর্যের চারিদিকে পৃথিবী ঘুরছে তা হলে আর রক্ষা নেই৷ অমনি বিধর্মী হয়ে গেল৷ চিন্তার স্বাধীনতা, বাক্যের স্বাধীনতা, কর্মের স্বাধীনতা, সবকিছু ধর্মের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত৷ ধর্ম বলতে বোঝায় ধর্মগুরু ও ধর্মসঙ্ঘ৷ তাঁদের হাতে ইহলোকের সব রকম যন্ত্রণার যন্ত্র৷

শেষ পর্যন্ত এই স্থির হল যে ইংল্যাণ্ডের মতো দেশে পোপের চেয়ে রাজা বড়ো, রাজার চেয়ে প্রজা বড়ো৷ প্রথম চার্লসের মাথা কেটে ও দ্বিতীয় জেমসকে সিংহাসন থেকে সরিয়ে ইংল্যাণ্ডের লোক কেবল পোপকে নয় রাজাকেও সমঝিয়ে দেয় যে সবার উপর মানুষ সত্য তাহার ওপর নাই৷ প্রজা প্রভাবিত রাষ্ট্রই হলো চার্চের চেয়ে বড়ো৷ প্রজাদের রাষ্ট্র ধীরে ধীরে অলক্ষিতে সেকুলার স্টেট হয়ে ওঠে৷ এক শতক পরে যখন আমেরিকার যুক্তরাষ্ট্র গঠিত হয় তখন তার মূলনীতি হয় সেকুলারিজম৷ তার কিছুদিন পর যখন ফরাসি বিপ্লব ঘটে তখন সেকুলারিজমের জয়জয়কার৷’’ (শ্রেষ্ঠ প্রবন্ধ, অন্নদাশংকর রায়, পৃষ্ঠা ১০২/৩)

একটু দীর্ঘ হলেও সেকুলারিজমের অতীত প্রেক্ষাপটটি অনুধাবন করার জন্য উদ্ধৃতিটি ব্যবহার না করে আমাদের উপায় ছিল না৷ এবার আসা যাক ধর্ম শব্দটির প্রসঙ্গে৷

উপর্যুক্ত উদ্ধৃতিতে ধর্ম শব্দটি যে অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে তাতে বিষয়টি বুঝতে কোন অসুবিধা না হলেও ধর্ম তার অর্থগৌরব থেকে বিচ্যুত হয়েছে৷ ‘ধম’ শব্দটিকে ব্যবহারিক বা বৈয়াকরণিক যেদিক থেকে ব্যাখ্যা করা হোক না কেন প্রচলিত ব্যবস্থায় অর্থের সঙ্গে বাস্তবের কোন মিল নেই৷

ধর্ম শব্দের ব্যৈবহারিক ব্যাখ্যায় শ্রীশ্রীআনন্দমূর্ত্তি বলেছেন---‘‘ধর্ম শব্দের অর্থ হ’ল সত্তাগত বৈশিষ্ট্য বা গুণ৷ ইংরেজী প্রতিশব্দ হ’ল নেচার, বা আগুনের ধর্ম বা স্বভাব দহন করা৷ আগুন ও তার ধর্ম এ দুটো জিনিস যেমন অবিচ্ছেদ্য, মানুষ ও তার ধর্ম ব্রহ্মানুসন্ধিৎসা-এও ঠিক তেমন ধারা জিনিস (আনন্দমার্গ, আনন্দমার্গের প্রারম্ভিক দর্শন, শ্রীশ্রীআনন্দমূর্ত্তিজী, প্রথম সংস্করণ ১৯৫৫ পৃষ্ঠা ২/৩) ধৃ ধাতু  মন প্রত্যয় করে ধর্ম শব্দের ব্যাখ্যাও একই৷ সুতরাং ধর্মের কোন পক্ষ হয় না তাই ধর্ম নিরপেক্ষ শব্দটি অর্থহীন একটি শব্দ৷ সেকুলারিজম অর্থাৎ খ্রীষ্টান মতবাদের করাল থাবা থেকে প্রজাতন্ত্রে উত্তরণের ইতিহাস৷ সুতরাং সেকুলার বা ধর্ম নিরপেক্ষ দুটো শব্দই আমাদের দেশে বিকৃতভাবে ব্যবহার হয়ে আসছে৷ আর এর ফলে প্রজা সাধারণের মধ্যে তৈরি হচ্ছে মনোমালিন্য, অহেতুক সংঘাত৷