শোষণ–মুক্তির দিশারী–প্রাউট

লেখক
সৌমিত্র পাল

পূর্ব প্রকাশিতের পর

মার্ক্সবাদের ত্রুটি

পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় অবাধ ব্যষ্টিস্বাধীনতার মারাত্মক অভিশাপ যেভাবে শোষক আর শোষিতের মধ্যে (‘‘Have আর ‘Have not’ চূড়ান্ত ব্যবধানের রেখা এঁকে দেয়, তা মহামতি কার্লমাক্সের মনে বেদনা সৃষ্টি করে৷ তাই তিনি শোষণ–মুক্ত সমাজ গঠনের জন্যে পুঁজিবাদ তথা অর্থনৈতিক অবাধ স্বাধীনতাকে উচ্ছেদ করার জন্যে ডাক দেন এই বলে ঃ ‘‘Individuality is abstraction and Class is reality’ তিনি ব্যষ্টির হাত থেকে অর্থনৈতিক ক্ষমতার বলটা কেড়ে নিয়ে সমষ্টি(রাষ্ট্র)–র হাতে তুলে দিলেন৷ যার ফল পরবর্তীকালে তা আরো মারাত্মক রূপ নিল৷ ইতিহাসের পাঠক মাত্রেই জানেন যে পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় ধনতান্ত্রিক দেশগুলিতে যেমন ব্যষ্টিসন্ত্রাসের সৃষ্টি হয়েছিল, তেমনি মার্ক্সীয় পরিকাঠামোয় কমিউনিষ্ট দেশগুলিতে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের সৃষ্টি হ’ল৷ কমিউনিষ্ট  দেশগুলোতে যদিও মানুষ বেঁচে থাকার জন্য নূ্যনতম প্রয়োজনটা পেল, কিন্তু রাষ্ট্রশক্তির শোষণে মানুষকে হারাতে হ’ল তার বাক্ স্বাধীনতা, নাগরিক স্বাধীনতা, মানবিক স্বাধীনতা৷ তাই অত্যন্ত দুঃখের সাথে বলতে হয় যে, পুঁজিবাদ মানুষকে ভিখারীতে পরিণত করে আর মার্ক্সবাদ সেই ভিখারী মানুষের কাছ থেকে মানবিক অধিকার কেড়ে নিয়ে তাকে কেবল উদর–উপস্থ–সর্বস্ব্ পশুত্বের পর্যায়ে নামিয়ে আনে •‘‘Capitalist makes a man beggar and communism makes the beggar beast’’)

মিশ্র অর্থনীতির কুফল       

বর্তমান সমাজে কমিউনিজমের কুফল উপলব্ধি করে’ কিছু অর্থনীতিবিদ্ পুঁজিবাদ ও মার্ক্সবাদের সংমিশ্রণে তৈরী করেছেন এক গোঁজামিল অর্থনীতি যা মিশ্র অর্থনীতি বা ধনতান্ত্রিক সমাজবাদ হিসাবে পরিগণিত৷ এর ফল হয় আরো মারাত্মক৷ মিশ্র অর্থনীতি আসলে ছদ্মবেশী পুঁজিবাদ– যার মুখোশটা মার্ক্সবাদের হলেও মুখটা পুঁজিবাদের৷ এক্ষেত্রে ব্যষ্টিগত উদ্যোগ (Private Sector আর রাষ্ট্রিক উদ্যোগ Public Sector পাশাপাশি চলতে থাকে৷ এতে মানুষের ওপর শোষণের মাত্রা আরো তীব্রতর হতে থাকে৷ 

প্রাউটের আবির্ভাব

পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় মানুষের ক্ষুধার জ্বালার জন্যে আর মার্ক্সীয় ব্যবস্থায় মানসিক আর ক্ষেত্রবিশেষে আর্থিক স্বাধীনতার অভাবের ফলে মানুষের চাপা দীর্ঘশ্বাসে যখন মানব সমাজের আকাশ বাতাস ভারাক্রান্ত, সেই রকম যুগ–সন্ধিক্ষণে মহান ঋষি শ্রী প্রভাতরঞ্জন সরকার তাঁর অভিনব সমাজ দর্শন ‘প্রাউট’ বা ‘প্রগতিশীল উপযোগ তত্ত্ব’ মানব সমাজকে উপহার দিয়েছেন৷ অপূর্ব সমন্বয় করেছেন– ব্যষ্টিস্বাধীনতা আর সমষ্টি উন্নয়নের– বস্তুজগতের সঙ্গে পারমার্থিক জগতের ৷ প্রাউট বস্তুজগৎকে মানব কল্যাণে সর্বাধিক নিয়োজিত করে মানবতার উদ্বোধন ঘটিয়ে সমাজকে এক মহৎ আদর্শের লক্ষ্যে চালিত করার বজ্রকঠোর সংকল্প নিয়েছে৷

প্রাউটের ভিত্তিভূমি হ’ল আধ্যাত্মিকতা যেখানে বস্তুজগৎ আর চৈতন্যজগৎ এক সূতায় গাঁথা হয়েছে৷ প্রাউট প্রবক্তার মতে, বস্তু হ’ল চৈতন্যেরই এক বিশেষ রূপ৷ প্রাউট মানুষকে ভাবতে শেখায় যে মানুষ সহ তার চারিপাশে অনান্য জীব নিয়ে এই বিরাট বিশ্ব হ’ল এক বৃহৎ পরিবার আর সেই পরিবারের সর্বময় কর্তা হলেন পরমেশ্বর– যিনি সকল জীবের পরম আশ্রয়স্থল– আত্মার পরমাত্মীয়৷ এই আত্মিক দৃষ্টিকোণ থেকে প্রতিটি জীব বিশ্বভ্রাতৃত্বের আত্মীয়তার পবিত্র বন্ধনে আবদ্ধ৷ প্রসঙ্গতঃ বলি, অনান্য জড়বাদী দর্শনগুলি মানুষ সহ অন্যান্য জীবের মধ্যে এই পবিত্র আত্মিক সম্পর্ক স্থাপনে ব্যর্থ৷ কারণ সর্বজীবের স্রষ্টা ঈশ্বর সেখানে অস্বীকৃত ...... পিতৃসত্তার অস্বীকৃতিতে বিশ্বমানবের তথা বিশ্বভ্রাতৃত্বের সম্পর্কও অলীক থেকে গেছে৷ প্রাউট তাই আধ্যাত্মিকতাকে ভিত্তিভূমি করে এক ভৌম আদর্শের দ্বারা গোটা বিশ্বে বিশ্বভ্রাতৃত্ব তথা এক অখন্ড বিশ্বপরিবার তৈরী করতে সক্ষম৷ শুধু আবার ভাবজগতের মধ্যেই নয়– এই আধ্যাত্মিকতাকে কেন্দ্র করে প্রাউট অর্থনৈতিক, রাষ্ট্রনৈতিক, ও সমাজের সার্বিক সংরচনা গড়তে প্রয়াসী৷

প্রাউটের অর্থনৈতিক চিন্তা

পৃথিবীর বেশির ভাগ দেশ তা সে পুঁজিবাদীই হোক আর মার্ক্সবাদীই হোক অর্থনীতির ক্ষেত্রে প্রত্যেকে কেন্দ্রীকরণ নীতি নিয়ে চলেছে৷ পুঁজিবাদী দেশগুলিতে রাষ্ট্রীয় সম্পদ কেন্দ্রীকরণ আর সমস্ত রকম অর্থনৈতিক নীতি নির্ধারণের ক্ষমতা মুষ্টিমেয় পুঁজিপতিদের হাতেই সীমাবদ্ধ থাকে আর মার্ক্সীয় দেশগুলিতে রাষ্ট্রশক্তির পরিচালক হিসাবে মার্ক্সবাদীদের হাতেই কেন্দ্রীভূত থাকে৷ এই ভাবে কেন্দ্রিত অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় দেশের বিভিন্ন স্তরে অর্থনৈতিক পরিকল্পনার ভার মুষ্টিমেয় মানুষের ইচ্ছার উপর নির্ভর করে৷ কেন্দ্রীয় স্তর থেকে Planning গুলিকে দেশের সার্বিক স্তরে চাপিয়ে দেওয়ায় কেন্দ্রিত অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় •Centralized economy) জনগণের উপর আর্থিক শোষণ বন্ধ করা সম্ভব হয়নি৷ প্রাউট সমাজের সার্বিক স্তরে অর্থনৈতিক শোষণ বন্ধ করার জন্যে অর্থনীতির জগতে কেন্দ্রিত ভাবনাকে সরিয়ে দিয়ে বিকেন্দ্রিত ভাবনাকে স্বাগত জানিয়েছে৷ বলা বাহুল্য প্রাউটের অর্থনৈতিক বিকেন্দ্রীকরণ •Decentralized economy) দ্বারা সমাজের সার্বিক প্রগতি সম্ভব৷ এই বিকেন্দ্রিত অর্থনৈতিক পরিকল্পনায় কিন্তু ওপর থেকে কোন Planning জোর করে সমাজের সর্বস্তরে চাপিয়ে দেওয়া যাবে না, বরং একেবারে নীচু তৃণমূল স্তর অর্থাৎ ব্লক স্তর থেকে Planning গুলিকে ধীরে ধীরে উপরের দিকে নিয়ে যেতে হবে৷ আর এই অভিনব বিজ্ঞানভিক্তি প্রয়াসকে সার্থক রূপ দেবার জন্য প্রাউট প্রবক্তা গোটা দেশকে ৪৫টা ও বিশ্বকে মোট ১৬৪ টি স্বয়ং– সম্পূর্ণ সামাজিক অর্থনৈতিক অঞ্চলে ভাগ করেছেন৷ তিনি বলেছেন প্রতিটি Socio-economic Zone তৈরী হবে সেখানকার ভৌগলিক পরিবেশ, মানুষের রুচি–চাহিদা, কর্মদক্ষতা প্রভৃতির ভিত্তিতে আর সেই এলাকার যাবতীয় অর্থনৈতিক নীতি নির্ধারণ, উন্নয়ন, কর্মসংস্থান প্রভৃতির ভার থাকবে সাধারন মানুষের হাতে৷ এটাই হল অর্থনৈতিক গণতন্ত্রের প্রথম ধাপ৷ প্রতিটি ব্লক তথা Socio-economic Zone–এর সমস্ত রকমের মানব সম্পদ ও প্রাকৃতিক সম্পদের উপযোগ নিতে হবে৷ কৃষি–শিল্প–বাণিজ্য প্রভৃতির উন্নয়নের জন্যে প্রাউট প্রবক্তা অভিনব বিজ্ঞানভিত্তিক Planning  তৈরী করে ১০০ শতাংশ কর্মসংস্থানের গ্যারেন্টি দিয়েছেন৷ তিনি বলেছেন, কৃষিতে ৩০–৪০ শতাংশের বেশী লোক  নিযুক্ত করলে কৃষি ওপর চাপ বাড়বে, উৎপাদন ব্যহত হবে৷ বাকী সংখ্যক মানুষের মধ্য থেকে ৩০–৪০ শতাংশ মানুষকে কৃষিভিত্তিক ও অকৃষি ভিত্তিক শিল্পে নিয়োগ করতেই হবে৷ আর বাণিজ্য ১০ শতাংশ আর বাকী ১০ শতাংশ চাকুরীজীবি রাখতেই হবে৷ প্রাউট এইভাবে শুষ্ঠু গ্রামোন্নয়ন, বিজ্ঞানভিত্তিক উপায়ে দারিদ্র্য দূরীকরণ, ব্লকভিত্তিক পরিকল্পনা প্রভৃতির ক্ষেত্রে এক সামজ্ঞস্য পূর্ণ অর্থনীতি •Balanced economy) সৃষ্টি করে অর্থনৈতিক গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে চূড়ান্ত ভাবে প্রয়াসী৷

প্রাউটের অর্থনৈতিক গণতন্ত্রের উদ্দেশ্য

পৃথিবীর সমস্ত দেশে যে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত তা কেবল রাজনৈতিক গণতন্ত্র বলেই পরিচিত যেখানে কেবল ভোট দেওয়াতেই মানুষের অধিকার, তাদের খাওয়া পরা, আশ্রয় কম, চিকিৎসা ও শিক্ষায় সম্পূর্ণ কোন অধিকার নেই৷ আর্থিক বৈষম্য সমাজের সর্বত্রই– সমাজের একটা ব্যাপক অংশ অস্তিত্ব রক্ষার জন্য চরম অন্ধকারে মাথা কুটে মরছে৷ প্রাউট প্রবক্তার মতে, বিশ্বে অর্থনৈতিক গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হলেই মানুষ তার অস্তিত্ব রক্ষার পূর্ণ সুযোগ পাবে, ও তা জনগণকে অর্থনৈতিক মুক্তির পথ  দেখাবে নিম্নলিখিত উদ্দেশ্যগুলিকে সামনে রেখেঃ

(১) নূন্যতম চাহিদা (অন্ন–বস্ত্র–বাসস্থান্ ও শিক্ষা) পূর্ত্তি সবার জন্য সুনিশ্চিত করা৷

(২) মাথা পিছু আয় নয়, প্রত্যেকের ক্রয় ক্ষমতাকে সুনিশ্চিত করা৷ মাথা পিছু আয় দেখে মানুষের অর্থনৈতিক উন্নতির সঠিক অবস্থান বোঝা যায় না, বোঝা যায় তার ক্রয় ক্ষমতা দেখে৷ পুঁজিবাদী পরিকাঠামোয় অর্থনীতিবিদরা মাথা পিছু আয়ের তত্ত্বটি মানুষকে বোকা বানানোর জন্যে প্রচার করে থাকেন৷ আর কমিউনিষ্ট সমাজের ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধির কোন নিশ্চিততা দেওয়া হয় না৷ এখানে সবকিছুই থাকে রাষ্ট্রের হাতে৷ রাষ্ট্র পরিচালকের খেয়াল–খুশিই এখানে প্রধান্য পায়৷ প্রাউট কিন্তু মানুষের ক্রয়ক্ষমতাকে পরিস্থিতির নিরিখে বাড়ানোর ব্যবস্থা রাখে৷ সমাজে ১০০ শতাংশ মানুষের কর্ম সংস্থান সৃষ্টি ও যে সব পণ্য নূ্যনতম চাহিদা পূরণ করে তার যোগান সুনিশ্চিত করতে হবে৷ সেই সাথে ঐসব পণ্যের মূল্যও এমনভাবে নিয়ন্ত্রিত হবে যাতে করে সমাজের একেবারে নীচু তলার কর্মীও ঐসব পণ্য সংগ্রহ করতে পারে৷ তাতে মুদ্রাস্ফীতিকে রোধ করা যাবে৷ মাঝে মাঝে মজুরী ও মাসিক আয় বাড়ানোর ব্যবস্থা রাখতে হবে৷ চিকিৎসা ও শিক্ষাব্যবস্থা থাকবে সম্পূর্ণ নিঃশুল্ক্ (ফ্রী)৷

(৩) সমস্ত অর্থনৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও বাস্তবায়নের ক্ষমতা স্থানীয় জনসাধারণের হাতেই থাকবে৷

(৪) স্থানীয় অর্থনীতিতে বহিরাগতদের প্রবেশ সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ থাকবে৷ তা না হলে ঐ বিশেষ অঞ্চল থেকে প্রচুর সম্পদের বহিঃস্রোতে ঘটবে ও সেখানকার অর্থনৈতিক উন্নতি ক্রমান্বরে বিপর্যস্ত হতে থাকবে৷

প্রাউটের সামবায়িক মানসিকতা

প্রাউটের অর্থনৈতিক গণতন্ত্রের নীতিকে বাস্তবায়িত করবার বিজ্ঞানভিত্তিক মাধ্যম হ’ল–সমবায়৷ সমবায় প্রথার অভ্যন্তরীণ ভাবটি হ’ল–বন্ধুত্বপূর্ণ সহযোগিতা৷ কেবল এই মানবিক ভাবের ভিত্তিতেই মানব সমাজের সুষ্ঠু ও সামঞ্জস্য পূর্ণ প্রগতি ঘটানো যাবে৷ সমবায়কে সাফল্যমণ্ডিত করতে গেলে তিনটে জিনিসের সুসন্তুলন চাই–

(১) সমবায় পরিচালনায় নীতিবাদী মানুষ৷

(২) দুর্নীতি দমনে কড়া তত্ত্বাবধান৷

(৩) জনগণের হূদয় দিয়ে সমবায়কে গ্রহণ করা৷

প্রসঙ্গতঃ বলি, অতীতে সমবায়গুলি ভেঙ্গে যাওয়ার মূলে ছিল রাজলনৈতিক দুরভিসন্ধি, যোগ্য নেতৃত্বর দ্বারা দুর্নীতি দমনের অভাব প্রভৃতি৷

প্রাউটের নীতি অনুযায়ী সমবায় হবে দু ধরনের–(১) উৎপাদক সমবায় Producers’ co-operative) ও (২) উপভোক্তা সমবায় (Consumers’ co-operative)৷ উৎপাদিত দ্রব্য উপভোক্তা সমবায় দ্বারা বাজারে সুষ্ঠুভাবে বণ্ঢন করার জন্যে থাকবে অত্যাধুনিক ব্যবস্থা৷ এখানে মধ্যসত্ত্বলোভী বা ফড়েদের সার্বভৌমত্ব বন্ধ হবে৷ উৎপাদক সমবায়ের আওতায় থাকবে–(১) কৃষি সমবায়, (২) কৃষিভিত্তিক সমবায়, (৩) কৃষি সহায়ক সমবায়, (৪) অকৃষি–দ্রব্য উৎপাদক সমবায়৷ সমবায়ের যা কিছু লভ্যাংশ তা সমবায়ের সদস্য ও শ্রমিকদের মধ্যে বণ্ঢিত হবে৷ প্রাউটের সমবায়ের উৎপাদন জনগণের চাহিদামুখী হওয়াতে কোন অনিশ্চিততার পরিবেশই তৈরী হবে না৷ সমস্ত পণ্যের মূল্য সার্বিকভাবে জনগণের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে যাতে থাকে তার জন্যে যথোপযুক্ত ব্যবস্থা থাকবে৷ এতে করে জনগণের জীবনযাত্রার মান উন্নত হবেই৷

প্রাউটের কৃষিনীতি ঃ প্রাউট প্রযুক্তি ও বিজ্ঞানকে সর্বাধিক কাজে লাগিয়ে উন্নত প্রথায় চাষকেই সমর্থন করে৷ ধনতান্ত্রিক দেশে কৃষিজমি পুঁজিপতিদের হাতে কুক্ষিগত থাকায় যেমন মানুষকে চরম সংকটে পড়তে হয়, তেমনি কমিউনিষ্ট ব্যবস্থায় কমিউন প্রথাও মানুষের চাহিদা মেটাতে ব্যর্থ৷ এখানে ব্যষ্টিগত উৎসাহ বা Insentive– অভাব, জমির প্রতি চাষীর মমত্ববোধের চূড়ান্ত অভাব ব্যর্থতার মূল কারণ৷ প্রাউট চাষীর পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতির কথা চিন্তা করে সামবায়িক প্রথায় চাষকে ব্যাপকভাবে সমর্থন জানায়৷ ধীরে ধীরে ক্ষুদ্র ভূমিখণ্ডগুলিকে সংযুক্ত করে বৈজ্ঞানিক প্রথায় চাষোপযোগী করে তোলা হবে৷ এখানে একের পরিবর্তে অনেকের মূলধন একত্রিত হওয়ার ফলে উৎপাদনে সুবিধা হবে ও সম্মিলিতভাবে ব্যাঙ্ক থেকে অর্থ সংগ্রহেরও সুবিধা হবে৷

কৃষিজমির সর্বাধিক উপযোগ গ্রহণ করতে হবে দুটো দিক থেকে–

(১) প্রতি ইঞ্চি জমিকে কাজে লাগিয়ে ও বছরের প্রতিটি দিনকে সর্বাধিক কাজে লাগাতে হবে৷

(২) চাষের পদ্ধতির পরিবর্তন আনতে চাষের ক্ষেত্রে একসঙ্গে তিনটে পদ্ধতিকে কাজে লাগাতে হবে–

(ক) মিশ্রচাষ ঃ–একটা প্রধান ফসলের সাথে একই সঙ্গে জমিতে অন্য অপ্রধান ফসলের চাষকে মিশ্র চাষ বলে৷ তবে মাথায় রাখতে হবে যে একটা ফসল যেন অন্যের সহায়ক হয়৷ যেমন ডাল চাষের সঙ্গে ভূট্টা, কিংবা গম চাষের সঙ্গে পোস্ত চাষ প্রভৃতি৷

(খ) অনুপূরক চাষ ঃ বর্ষাকালীন ধান জমিতে কোন শস্যের চাষ করা না গেলেও সেই জমিতে যে জল থাকে, তাতে মাছ চাষ করা যায়৷ একে অনুপূরক চাষ বলে৷

(ঘ) পর্যায়ক্রমিক চাষ ঃ জমিকে বছরের প্রতিটি দিনই চাষের কাজে ব্যস্ত রাখতে একটার পর একটা ফসল তুলে নেওয়ার ব্যবস্থাই পর্যায়ক্রমিক চাষ৷ যেমন ধান চাষের কথাই ধরা যাক৷ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে বছরের ৪ বার ফসল পর্যায়ক্রমিক ভাবে ফসল ফলানো যাবে৷ আর সেই সাথে প্রতিবারেই প্রধান ফসলের সাথে মিশ্র চাষের সাহায্য নিয়ে দুই থেকে তিনটে অপ্রধান ফসল তোলা যাবে৷ সেই হিসাবে ৪x৩=১২টা ফসল বছরে পাওয়া যাবে৷ এইভাবে ব্লকে ব্লকে কৃষির উৎপাদন বাড়িয়ে জীবনযাত্রার মান বাড়াতে হবে৷